রাজ্জাক–সোহেল রানা–আলমগীর – বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের তিন শক্তিমান অভিনেতা। প্রত্যেকের অভিনয়ের অভিজ্ঞতা তিন থেকে চার দশকের। এই তিন গুনী শিল্পীকে একত্রিত করেছিলেন পরিচালক দিলীপ বিশ্বাস তার ‘জিঞ্জির’ চলচ্চিত্রে, ১৯৭৮ সালে। ৩৫ বছর পরে ২০১৩ সালে এফ আই মানিক পরিচালিত ‘জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার‘ চলচ্চিত্রে আবার একত্রিত হলেন এই তিন গুনী শিল্পী। চলচ্চিত্রে এই তিনজন ব্যতীত বর্ষীয়ান শিল্পীদের তালিকায় আছে সুচরিতা, প্রবীর মিত্র, সাদেক বাচ্চু, আহমেদ শরীফ, আমির সিরাজী, রেহানা জলি এবং এই যুগের শিল্পীদের অন্যান্যদের মধ্যে মিশা সওদাগর, শাকিব খান এবং পূর্ণিমা। স্বাভাবিকভাবেই – মুক্তির আগেই এই ছবি প্রত্যাশা তৈরী করেছে অনেক, ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমায় সন্ধ্যা ছটার শো-তে হলভর্তি দর্শক তারই প্রমাণ দেয়।
মুঘল সম্রাজ্যের শেষ সময়ে শাহ সুজা যখন আরাকান রোড দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তার সাথে ছিল কোহিনূর হীরার চেয়েও আকৃতিতে বড় এবং মূল্যবান হীরা শাহীনূর। পর্তুগীজ দস্যুদের আক্রমনে শাহ সুজা মারা গেলে মহামূল্যবান সেই হীরকখন্ড হাতছাড়া হয়ে যায়। কয়েক শতাব্দী পরে সেই হীরা স্মাগলারদের মাধ্যমে আবার প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। দেশের সম্পত্তি দেশেই রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে হীরকখন্ড প্রায় যখন হাতের মুঠোয়, তখনই ছিনিয়ে নিয়ে যায় ভিক্টর। ভিক্টর হল ডন অব দ্য ডনস, কৌশলী এবং অপ্রতিরোধ্য। ‘ভিক্টরকে অ্যারেস্ট করা … নাথিং … বাট ইম্পসিবল’ – ভিক্টরের মুখ থেকেই শোনা যায়। হীরক উদ্ধার এবং ভিক্টরকে গ্রেফতার – এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার ছবির গল্প এগোয়।
জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার চলচ্চিত্রের কাহিনী লিখেছেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, সংলাপ মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান। শাহীনূর হীরা-কে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্র সামনের দিকে অগ্রসর হলেও এটি ছবির মূল প্লট নয়, সাবপ্লট। মূল প্লটে আছে তিন বন্ধুর গল্প। বন্ধুদের একজন জজ, একজন ব্যারিস্টার, অন্যজন পুলিশ অফিসার থেকে পদোন্নতি নিয়ে পুলিশ কমিশনার। এই তিন বন্ধুর কাজকর্মই অপরাধ ও অপরাধীদের সাথে সংশ্লিষ্ট। অন্যায়-অনৈতিকতার সাথে যুদ্ধ করতে হয় সর্বক্ষন ভিন্ন ভিন্ন পেশার এই তিন বন্ধুকে। বিশ বছর আগে সৎ সিদ্ধান্তের কারণে অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল বিচারপতিকে। বিশ বছর পরে আরও জটিল অবস্থার সম্মুখীন হলে তিনি এবং তার বন্ধুরা কি আচরণ করবেন – সেই গল্পকে ছবির মূল প্লট হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
অর্থনীতি পড়াতে গিয়ে এক শিক্ষক বলেছিলেন – বাংলাদেশে এসে অর্থনীতির নিয়মগুলো আর নিয়ম থাকে না, ব্যতিক্রম হয়ে যায়। জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার ছবির মূল প্লট এবং সাবপ্লট বিশ্লেষন করতে গেলে অর্থনীতির এই কথা এখানেও প্রযোজ্য হয়ে পড়ে। একদা সিনেমায় শৈশবে হারিয়ে যাওয়া মা-সন্তান অথবা বন্ধুর মিলন হত একই গানের মাধ্যমে, অথবা কোন স্মৃতিচিহ্নের উপস্থাপনে। জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার-এ এসে এ ধরনের যৌক্তিক আচরনের বালাই পাওয়া যায় না।
পিতৃ-মাতৃপরিচয়হীন ভিক্টর তার আসল মায়ের সংস্পর্শে এসে কেন আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে তার যথার্থ ব্যাখ্যা দাবী না করা হলেও একজন বিচারকের বেডরুমে গভীর রাতে ভিক্টর কেন এবং কিভাবে প্রবেশ করে – সে প্রশ্নের জবাব খোঁজ করা যেতে পারে এবং সেক্ষেত্রে কাহিনীকার এবং পরিচালক ব্যারিস্টারের জেরা ব্যতীতই যে বিচারকের কাঠগড়া থেকে মুক্তি পাবেন না তা স্পষ্ট। জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার সিনেমার কাহিনীকার ঝন্টু একটি সামাজিক ছবির গল্প বলতে চেয়েছেন, তিনি বলেছেন কিন্তু ভালোভাবে বলতে পারেন নি। চোখ কান খোলা রেখে যে সকল দর্শক সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত – তাদের জন্য ছবির ত্রুটিগুলো হস্তিকায়।
পরিচালক এফ আই মানিক জানিয়েছেন – ২০০৮ সালে সিনেমাটির শ্যুটিং শুরু করেছিলেন, শ্যুটিং শেষ হওয়ার পরে নানা জটিলতায় মুক্তি দিতে এত দেরী হল। প্রায় পাঁচ বছর আগে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি কি পরিমান অবহেলা নিয়ে নির্মিত তা ছবির বিভিন্ন সিকোয়েন্সে সুস্পষ্ট। বোধহয় এক সাভার গলফ ক্লাবেই সিনেমার অর্ধেকের বেশী শ্যুটিং করেছেন পরিচালক। সাভার গলফ ক্লাবকে তিনি নাইক্ষ্যংছড়ি বানিয়েছেন, ঢাকা শহরও বানিয়েছেন।
গলফ ক্লাবকে তিনি ঢাকা বানান আর টেকনাফ, তাতে আপত্তি নেই বরং বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরতে পারার মধ্যেই পরিচালকের মুন্সিয়ানা – কিন্তু গলফ ক্লাবের গেটকে স্কুলের গেট হিসেবে উপস্থাপন করার সময় তিনি কেন পেছনের ‘সাভার গল্ফ ক্লাব গেট’ ফলকটি খেয়াল করেন নি, কেন পুলিশের এএসপি নীলিমা রাহাত চৌধুরীকে একটি বারের জন্যও পুলিশ ড্রেসে উপস্থাপন করেন নি, কেন একজন এএসপি ফোর্স ছাড়াই একাকী সকল অভিযান পরিচালনা করেন, বিশ বছরেও জাফর খান এবং তার ভাই গাফ্ফার খানের মধ্যে কেন কোন যোগাযোগ হল না ইত্যাদি প্রশ্নগুলোর উত্তর কি পরিচালক এফ আই মানিক দেবেন?
পরিচালনার এ সকল ত্রুটি অমার্জনীয়, তবে উপস্থিত দর্শক সেগুলোকে আগ্রাহ্য করতে পেরেছে খুব সহজেই। এক্ষেত্রে দর্শককে সহায়তা করেছে বর্ষীয়ান এবং এ যুগের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। পুলিশ কমিশনার চরিত্রে সোহেল রানার ব্যক্তিত্বপূর্ণ, জজ চরিত্রে রাজ্জাকের গাম্ভীর্যপূর্ণ এবং ব্যারিস্টার চরিত্রে আলমগীরের আকর্ষনীয় অভিনয় দর্শককে পর্দার দিকে মনযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করেছে। সাদেক বাচ্চু এই বয়সেও কুটিল অভিনয়ে যোগ্যতার পরিচয় রেখেছেন। অবশ্য, বিশ বছর আগের দৃশ্যে এদের প্রত্যেকেরই মেকাপ খুবই অবাস্তব ও হাস্যকর, দর্শকের আগ্রহ হারানোর জন্য যথেষ্ট।
চলচ্চিত্রে এ যুগের নায়ক শাকিব খানের অভিনয় অন্যতম আকর্ষন। অ্যাকশন-রোমান্স-ট্রাজিক প্রায় সব দৃশ্যেই শাকিব খান ভালো অভিনয় করেছেন, তবে তার কানের অপ্রয়োজনীয় দুলগুলো তার চরিত্রকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে বাধাগ্রস্থ করেছে বেশ কিছু দৃশ্যে। শাকিব খানের পাশাপাশি তৃপ্তিদায়ক অভিনয় করেছেন পূর্নিমা। পর্দায় দীর্ঘ বিরতি শেষে মিশা সওদাগরের উপস্থিতিকে দর্শক যে উল্লাসধ্বনি মধ্য দিয়ে গ্রহণ করেছে তা তার অভিনয় গুণপনাকে স্বীকৃতি দেয়।
জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন আলাউদ্দিন আলী। তার পরিচালনায় কে তুমি এবং ওরে চোখ – দুটো গানই শ্রুতিমধুর। ‘কে তুমি’ গানের সাথে শাকিব খান ও পূর্ণিমার নাচ চলচ্চিত্রের মনযোগ কেড়ে নেয়া কিছু অংশের অন্যতম।
সব মিলিয়ে জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার অন্য দশটা বাংলাদেশী চলচ্চিত্র থেকে আলাদা কিছু হয় নি। কাহিনীর গলদ, পরিচালকের অমনোযোগিতা ইত্যাদি সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে এদেশের চলচ্চিত্র রাজ্জাক-সোহেল রানা-আলমগীরের যুগে ফিরে যেতে অসমর্থ। বর্ষীয়ান অভিনেতারা এই চলচ্চিত্রে তাদের যোগ্যতার পরিচয় রেখেছেন, বর্তমান সময়ের কাহিনীকার-নির্মাতারা তাদের যোগ্যতার ছাপ রাখতে পারলেই দুই প্রজন্মের মিলনে নতুন এবং উন্নততর কোন যুগের সৃষ্টি সম্ভব, অন্যথায় স্বপ্ন দেখার ক্ষমতাই নষ্ট হবে। আশা করি এই সত্যটা সকলের উপলব্ধি করা সম্ভব হবে।
এক নজরে জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার
পরিচালক: এফ আই মানিক
অভিনয়: রাজ্জাক, সোহেল রানা, আলমগীর, শাকিব খান, পূর্ণিমা, সূচরিতা, মিশা সওদাগর, সাদেক বাচ্চু প্রমুখ।
রেটিঙ: ৩.৫/৫
×রেটিঙ বাংলাদেশী সিনেমার সাথে সঙ্গতি রেখে করা হয়েছে।
একটানে পড়লাম।
ছবি আর না দেখলেও চলবে। সব কিছু চোখের সামনে চলে এসেছে।
ধন্যবাদ।
আপনার মন্তব্যটা দরকারী, সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করল। এই রিভিউ পড়ে একটা দর্শক কমলে সেইটা ঠিক ভালো লাগে না, তাই আগামী শুক্রবার পর্যন্ত এই রিভিউর কোন শেয়ার দেবো না বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।
যারা দেখার দেখে নিক এই সময়ে।
ভালো থাকুন ভাইয়া 🙂
ভাই ভাল রিভিউ… তবে রেটিং কয়?
রেটিং দিতে ভুলে গেছিলাম। যোগ করে দিলাম।
আমার সিনেমা নিয়ে আপনার লেখাটি বেশ ভালো লেগেছে। আপনি মনদিয়ে এই কাজে সময় লাগান। আসা করছি ভবিষ্যতে দেশের জন্য বিশেষ করে চিটাগাংয়ের জন্য কিছু করতে পারবেন।
ধন্যবাদ পরিচালক ভাই, শেষ লাইনটা বুঝতে পারলাম না। যদি আরো কিছু ব্যাখ্যা পেতাম। শুভেচ্ছা।
দারাশিকো’র ব্লগে স্বাগতম এফ আই মানিক। আপনি অরিজিনাল বলে মনে হচ্ছে না, তারপরও আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। কোলকাতার সিনেমা আমাদের সিনেমাকে গিলে ফেলবার আগেই যদি আপনারা কিছু করতেন তাহলে বড় ভালো লাগত – একটু ভেবে দেখবেন স্যার।
আবার আসবেন। ধন্যবাদ।
ভাই মূলত এই ছবির কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৮-এ । আর তখন শাকিব সিডিউল নিয়ে ঝামেলা করছিল । তার জন্য হয়ত জায়গা নিয়া ভুল গুলা হয়ছে । পরিচালক তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে গিয়ে এত কিছু খেয়াল করেনি হয়ত । তবে একটা জিনিস আপনি এড়িয়ে গেছেন সেটা হল মিশাকে যখন আদালত থেকে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাকে পালিয়ে যাবার জন্য যে বোমা ফাটানোর যে দৃশ্য দেখানো হয় তা অন্য ছবি থেকে জুড়ে দেওয়া । এইরকম আরও ২টা জুড়ে দেওয়া দৃশ্য ছিল ছবিতে যা চোখে পড়ার মিত ছিল । তবে গানগুলা ভাল হয়ছে । কাহিনীও মোটামুটি ভাল ছিল ।
ভালো পয়েন্ট বলেছেন শিমুল। শাকিব খানের জন্য ঝামেলা হয়েছে সেটা সাম্প্রতিক সময়ে শুনি নি, বরং পরিচালক মুক্তি নিয়ে ঝামেলার কথা বলেছিলেন। আর অন্য সিনেমা থেকে চুরির বিষয়টা ধরতে পারি নি, কারণ সম্ভবত কোন সিনেমা থেকে চুরি সেটা দেখা হয় নি বলে। আপনি ধরিয়ে দিলেন, এই সুযোগে চুরি করা দৃশ্যের জন্য নিন্দা জানাই।
কাহিনী ভালো, গানগুলো ভালো।
Vai Video Link ta Dite parben na aktu Demo Dekhtam.
স্যরি ব্রাদার। ভিডিওর কোন লিংক আমার কাছে নাই। ওয়েবে পাওয়া যাবে কিনা জানি না।
ধন্যবাদ।
আপনার দয়ার শরীর।
মুভির রেটিং দেখে বুঝলাম।
চালাইয়া যান দয়া-মায়া।।
vai cinema ta ki babosha shofol hoyece.doya kore please janaben.
ব্যবসা সফল হয়েছে কিনা সে তো জানি না ভাই। নির্মাতা গোষ্ঠীর কারও সাথে পরিচয় নাই 🙁