তিব্বতে সাত বছর : ইতিহাস সংস্কৃতির পরিচায়ক

তিব্বতে সাত বছর ছবির একটি দৃশ্য

উঠতি মুলো নাকি পত্তনেই বোঝা যায়। তিব্বতে সাত বছর বা সেভেন ইয়ারস ইন টিবেটের প্রথম পাচঁ মিনিট যেন এই প্রবাদের সার্থকতাকেই তুলে ধরে।

তিব্বতে সাত বছর

সাতটি বছর তিব্বতে থেকেও তিব্বতী হতে না পারার গল্প ‘তিব্বতে সাত বছর’। মূল চরিত্র হাইনরেখ হারার, এক জেদী এবং একগুঁয়ে অস্ট্রিয়ান মাউন্টেইনার। নিতান্ত ঘটনাচক্রেই তাকে তিব্বতে কাটাতে হয় মূল্যবান সাতটি বছর। আর এই সাত বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী নিয়েই সেভেন ইয়ারস ইন টিবেট তৈরী। মূল কাহিনী একই নামের আত্মজীবনী।

সিনেমার পরিচালক জ্য জ্যাক আনুদ (Jean-Jacques Annaud), জাতিতে ফ্রেঞ্চ। এই গুণী পরিচালক সাধারণত ফ্রেঞ্চ ভাষায় মুভি নির্মান করলেও দুএকটি মুভি ইংরেজি ভাষায় নির্মান করেছেন এবং সুনাম কুড়িয়েছেন। তিব্বতে সাত বছর বা সেভেন ইয়ারস ইন টিবেট নির্মানের পূর্বে শন কররি অভিনিত “দ্য নেম অফ দ্যা রোজ” এবং পরবর্তীতে “এনিমি অ্যাট দ্য গেটস” মুভির মাধ্যমে তার গুণপনার প্রকাশ দেখিয়েছেন।

কাহিনী

তিব্বতে সাত বছর ছবিতে মূল চরিত্রে অভিনেতা ব্রাড পিট। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া এই মুভিতে ভিন্ন ধরনের অভিনয় প্রতিভা দেখিয়েছেন পিট। সময়টা ১৯৩৯। মাউন্টেইনার হেইনরিখ জার্মান সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী ভারতের নাঙ্গা পর্বত জয়ের অভিযানে বের হয়, নেতৃত্বে পিটার। এই নাঙ্গা পর্বত জয়ের চেষ্টা এর আগেও হয়েছে, কিন্তু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে সকল প্রচেষ্টা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী অস্থির সময়ে পৃথিবীর মনযোগ ভিন্ন দিকে সরিয়ে জার্মান শৌর্য-বীর্যের প্রকাশ চেষ্টা এই অভিযান।

গোঁয়ার চরিত্রের হেইনরিখ অভিযানের বিভিন্ন সময় নিজের সিদ্ধান্তে চলতে চেষ্টা করলেও সফল হয়নি, অবশ্য এর ফলে খুব একটা সহায়তাও করতে পারেন নি তার দলকে। পৃথিবী থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন, কিন্তু পর্বত জয়ের দৃঢ় প্রত্যয়। প্রচন্ড হিমঝড়ের ফলে পিছু হটতে হয়। এবং গ্রেপ্তার হয় ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর দ্বারা। কারন ততক্ষনে শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেখানে প্রতিপক্ষ জার্মানী।

বন্দীদশা থেকে পালিয়ে পিটার এবং হেইনরেখ প্রথমে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং পরবর্তীতে উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত দেশ তিব্বতে উপস্থিত হয়। তিব্বতের সংস্কৃতি আর সরলতা বেশ দক্ষতার সাথে তুলে ধরা হয়েছে মুভিতে। তিব্বতিয়ানদের যেন ধর্ম আর সাংসারিক কাজ ছাড়া কোন কাজই নেই। পাপমুক্তির উদ্দেশ্যে তারা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আর কিছু সময় পর পরই দালাইলামা (ধর্মীয় নেতা)র উদ্দেশ্যে মাথা মাটিতে লাগিয়ে সম্মান প্রদর্শন। তিব্বতের লাসা শহরে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয় আগান্তুক দুজন।

কিন্তু বিদেশীদের জন্য লাসা নিষিদ্ধ স্থান। কারণ বিদেশীদের হাতেই লাসার পতন হবে – বহু পুরানত কিন্তু প্রচলিত বিশ্বাস। পিটার তিব্বতী এক মেয়েকেই খুজে নেয় সহধর্মিনী হিসেবে আর ঘটনাক্রমে ভবিষ্যত দালাইলামা যার বয়স মাত্র ৮ বছর তার শিক্ষাগুরুতে পরিনত হয় হেইনরিখ। সেই ছোট্ট দালাইলামাই আজকের তিব্বতের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক গুরু।

শান্তিকামী বৌদ্ধদের প্রতি আগ্রাসন

বৌদ্ধ ধর্মাবলাম্বী তিব্বতের অধিবাসীদের শান্তিকামীতা ফুটে উঠেছে বিভিন্ন রীতি নীতির মাধ্যমে । এর মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, চীনে কম্যুনিস্ট বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে মাও সেতুং এর নেতৃত্বে। মাও সে তুং তিব্বত জয়ের আকাঙ্খা প্রকাশ করলে ভীতিজনক পরিবেশ তৈরী হয় তিব্বতিদের মধ্যে। যে তিব্বতিরা সামান্য কেঁচোর প্রাণ বাচানোর জন্য কাজ বন্ধ রাখতে দ্বিধা করে না সেই তিব্বতিরাই এবার নিজেদেরকে বিদেশী আগ্রাসনের হাত থেকে বাচানোর জন্য অব্যবহারে জরাজীর্ন বন্দুক আর কার্তুজ তুলে নেয়। কিন্তু প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর দ্বারা কচুকাটা হতে হয়। বলা হয় চাইনিজ সেনাবাহিনী এ সময় বহু ধর্ম সন্ন্যাসীকে নির্বিচারে হত্যা করে। এই আগ্রাসনের কিছু দৃশ্য ফুটে উঠেছে সিনেমায়। অবশ্য এর ফল তাই হয়েছে যা হবার কথা – চীনে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়েছে তিব্বতে সাত বছর সিনেমাটি।

সব মিলিয়ে

তিব্বতিদের জীবন যাপন সম্পর্কে ধারনা লাভ করার জন্য সিনেমাটি আদর্শ। একই সাথে কম্যুনিজম বিরোধীদের হাতে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ এই মুভি। বলা হয় এই যুদ্ধ ছিল সর্ম্পূর্ন চাপিয়ে দেয়া। এবং সে সময় প্রায় ৪০০০০ সৈন্য তিব্বতে প্রবেশ করেছিল যারা প্রায় ৮৭ হাজার তিব্বতিদের প্রাণ সংহারের কারণ হয়েছিল।

আবেগ এবং ভালোবাসার বিভিন্ন রূপ দেখা যায় তিব্বতে সাত বছর মুভিতে। সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে আবেগশূন্য বিদায় জানিয়েছিল হেইনরিখ, অথচ পরবর্তীতে না দেখা সন্তানের জন্য স্নেহ এবং স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ – অন্যের সন্তান দালাইলামার সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্কের মধ্যে প্রকাশ পায়। নিজ সন্তানকেই যেন বহির্বিশ্বের যাবতীয় জ্ঞান প্রদান করে চলছিল হেইনরিখ। অসাধারণ সব ল্যান্ডস্কেপ, আর পর্বতে আরোহনের কাঠিন্য, সাথে তিব্বতীদের জীবন যাত্রা – সব মিলিয়ে দর্শকের মনযোগ ধরে রাখার সকল উপাদানের সার্থক সংমিশ্রন পাওয়া যায় মুভিটিতে।

তিব্বতী সংস্কৃতি নিয়ে নির্মিত মার্টিন স্করেসেসের ‘কুন্দুন’ কিংবা ‘লিটল বুদ্ধা’র সাথে এক সারিতে দাঁড়ানোর যোগ্যতা রাখে তিব্বতে সাত বছর।

প্রকাশিত লেখার মূল লিংক

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *