সেপ্টেম্বর ডন (September Dawn): গণহত্যার ইতিহাস

সেপ্টেম্বর ডন সিনেমার দৃশ্য
সেপ্টেম্বর ডন সিনেমার একটি দৃশ্য

১৮৫৭।

ছবির শুরুতে উপরোক্ত সালই বলে দেয় ঐতিহাসিক কাহিনী নির্ভর মুভি। সিপাহি বিদ্রোহের কথা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ১৮৫৭ সালে আরও কিছু ঘটেছিল, অন্য কোথাও, পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে। সেপ্টেম্বর ডন সেই কাহিনীর দৃশ্যপট।

ইতিহাস নির্ভর মুভি অনেক হয়েছে। ইতিহাসকে তুলে ধরার দায়িত্ব থেকে মুভি নির্মাণ করা হলেও সেখানে নিজস্ব দর্শনই জোরালো হয়ে ফুটে উঠে। কিংবা, ইতিহাসের তুলনায় অন্য কোন কাহিনী – বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই প্রেম – গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ইতিহাসকে তুলে ধরার এটি একটি চালাকিও বটে। ক্রিস্টোফার কেইন এই জালিয়াতির আশ্রয় নেননি। আর তাই প্রেম থাকলেও তা মূল সত্যকে – ১৮৫৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ভোরের ইতিহাস – ছাপিয়ে উঠতে পারেনি।

মুভির কাহিনী বিবৃত হয় বিশ বছর বয়সী এক তরুণীর কন্ঠে, ১৮৭৭ সালে, যে ঘটনার সময় ছিল ছয়মাস বয়সী এক শিশু। তারপরেও অবাস্তব মনে হয়নি কিছুই। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, বিশাল ল্যান্ডস্কেপ আর ইতহাসের নির্মমতা এ ধরনের অসঙ্গতিকে ক্ষমা করে দেয়।

সেপ্টেম্বর ডন একটি ফিকশনাল রোমান্টিক মুভি হতে পারত, অন্তত সে ধরনের প্রয়োজনীয় সকল উপাদানই উপস্থিত ছিল। ১৮৫৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়াগামী একটি ওয়াগন ট্রেন মাউন্টেন মিডোতে বিশ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা বিরতি করে। ওয়াগনের নেতৃত্বে জন বেকার এবং আলেক্সান্ডার ফ্যানচার। নারী পুরুষ ও শিশু – সব মিলিয়ে প্রায় ১২০ জনের দল। এলাকাটি মর্মন ধর্মাবলাম্বীদের দ্বারা শাসিত। মর্মন চার্চের বিশপ, স্যামুয়েলসন তার দুই ছেলেকে নিয়ে তাদের অবস্থানের অনুমতি এবং নিরাপত্তার আশ্বাস প্রদান করে। বিশপের ছেলে জোনাথন স্যামুয়েলসনের সাথে ওয়াগন ধর্মীয় নেতার সুন্দরী কন্যা এমিলি হাডসনের দীর্ঘ সময় চোখাচোখি মুভির রোমান্টিকতাকে নির্দেশ করে।

কিন্তু পরের সিকোয়েন্সেই মর্মন এবং ক্রিশ্চিয়ানদের সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রার্থনা মুভির দন্দ্বকে প্রতিষ্ঠিত করে। ওয়াগন বাসিন্দারা যেখানে মর্মনদের সহানুভূতির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সেখানে মর্মনরা ধন্যবাদ জানায় তাদের অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের সুযোগ করে দেয়ায়। ফেডারেল গভমেন্টের সাথে মর্মন লিডার বৃংহাম ইয়ং দের বিরোধ তখন তুঙ্গে, সরকার সৈন্য পাঠিয়েছে, বৃংহাম ইয়ং মর্মন এলাকায় মার্শাল ল জারি করেছে। সুতরাং, এ অবস্থায় ওয়াগন সুদ্ধ এত মানুষকে খোদার আশির্বাদ (!) গন্য করা যেতে পারে।

প্রায় দেড়শ বছর পূর্বের সময়কে তুলে ধরতে সেপ্টেম্বর ডন সিনেমার পরিচালক-প্রযোজক ক্রিস্টোফার কেইনের খুব একটা বেগ পেতে হয় নি। বিশাল ল্যান্ডস্কেপ আর বাহন হিসেবে ঘোড়ার ব্যবহার খুব সহজেই সময়কে রিপ্রেজেন্ট করেছে। জোনাথনের ঘোড়া পোষ মানানোর অসাধারন ক্ষমতা এমিলির সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। মৃদু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর অ্যামবিয়েন্ট সাউন্ড মুভির সাথে মিশে যেতে সহায়তা করেছে।

বিশপ জ্যাকব স্যামুয়েলসনের প্ল্যান অনুযায়ী মর্মনরা নেটিভ আমেরিকানদের উৎসাহিত করে ওয়াগন ট্রেনের উপর হামলা করতে। হামলা ফিরিয়ে দেয় ওয়াগন বাসিন্দারা । এবার সাদা পতাকা নিয়ে হাজির হয় বৃংহাম ইয়ঙ এর পালিত পুত্র জন ডি লি। মর্মন লিডারের নির্দেশানুযায়ী সকল ক্রিশ্চিয়ানদেরকে নারী, পুরুষ এবং শিশু – এই তিন ভাগে বিভক্ত করে হত্যা করা হয় সকল নিরস্ত্র নারী ও পুরুষকে। বিধর্মী তরুনীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার অপরাধে বন্দী বিশপের ছেলে জোনাথন নিজেকে মুক্ত করে ছুটে আসে প্রেমিকা এমিলিকে বাচাঁতে, কিন্তু তারই বাবার গুলিতে মারা যায় এমিলি। মর্মনদের ধর্মীয় উন্মদনা হত্যা করে ১২০ নিরীহ নারী ও পুরুষকে।

এই হত্যাকান্ডের বিচার হয়। বৃংহাম ইয়ঙ সব কিছু অস্বীকার করে আর এ হত্যাকান্ডের অপরাধে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয় জন ডি লিকে। যুদ্ধ ও হিংসা বিরোধী মুভি সেপ্টেম্বর ডন। ধর্মীয় ফ্যানাটিজমকে তুলে ধরা হয়েছে। তবে ফ্যানাটিজমের চেয়েও ক্ষমতার অপব্যবহার ভালো ফুটে উঠেছে।

মুভি শেষে বিশ্লেষণ করা দরকার – সেপ্টেম্বর ডন কি আসলেই ইতিহাসকে রিপ্রেজেন্ট করেছে না মর্মনদের বিরূদ্ধে নতুন করে বিদ্বেষ রচনার চেষ্টা চালিয়েছে। পুরো মুভি জুড়ে যেভাবে মর্মন এবং ক্রিশ্চিয়ানদের তুলনা করা হয়েছে, তাতে শেষোক্ত ধারনাই জোড়ালো মনে হয়। বৃংহাম ইয়ঙ সত্যিই সব কিছুর সাথে জড়িত ছিলেন নাকি এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা সেটা বিচার করা ঐতিহাসিকদের কাজ। সেপ্টেম্বর ডন সিনেমায় হুয়ান রুইজ আনচিয়ার সিনেমাটোগ্রাফি ও ক্যামেরার অবস্থান, বিশেষ করে ফায়ারিং স্কোয়াডে ডায়াগোনাল ক্যামেরা অবশ্যই নির্দিষ্ট ইঙ্গিতবহ, এবং ক্রিস্টোফার কেইনের পরিচালনা তাদের উদ্দেশ্য অর্জনে মোটেও ব্যর্থ হয়নি।

[ এই লেখাটা যখন লিখেছিলাম তখনও ব্লগ লেখা শুরু করিনি, লেখাটা কিছুটা সম্পাদিত হয়ে যায়যায়দিন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, মূল লিংক দিতে পারলে ভালো লাগতো, কিন্তু ওদের ওয়েবসাইটে বেশ সমস্যা, আর্কাইভ হাওয়া হয়ে গেছে… ]

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

One Comment on “সেপ্টেম্বর ডন (September Dawn): গণহত্যার ইতিহাস”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *