হলিউড-বলিউডের “গরম” মুভিগুলোর মাঝে ইরানী মুভি যেন এক পশলা বৃষ্টির মতো। প্রায় একই সময়ে ইরান জন্ম দিয়েছে কলজয়ী সব পরিচালকদের। জাফর পানাহি, মাখমালবাফ পরিবার। এবং অতি অবশ্যই আব্বাস কিয়েরোস্তামি – যাকে শুধু ইরানী চলচিত্র নয়, সমগ্র বিশ্ব চলচিত্রের অন্যতম সেরা পরিচালক বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পছন্দের শীর্ষে রয়েছেন অন্য এক পরিচালক- মাজিদ মাজিদি।
তার পরিচালিত আরেকটি অসাধারণ মুভি হলো বারান Baran (2001)। প্রথমেই একটি কথা স্বীকার করে নেই, মুভিটা শুরু হবার আগেই আমি এটাকে পছন্দ করেছিলাম। ইরানী শব্দ “বারান (باران )” এর অর্থ বৃষ্টি। যে মুভির নামের সাথেই বৃষ্টি শব্দটি জুড়ে আছে, তাকে ভালো না বেসে উপায় কি!
১৭ বছর বয়সী লতিফ ইরানের এক কন্সট্রাকশন সাইটে কাজ করে। চা বানানো, ফুট-ফরমাস খাটাই তার কাজ। এই লতিফ একদিন বারান নামে এক মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলো ।কিন্তু সবে ১৪ পার হওয়া বারানের জীবনে প্রেমের জন্য সময় ও সুযোগ কোনোটাই নেই। একে তো সে আফগান শরণার্থী, যাদের ইরানে কাজের অনুমতি নেই। তার উপর বারানের পরিবারে সে-ই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাদের সম্পর্ক আরো গভীর হওয়ার আগেই, বারানের সাথে লতিফের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। স্মৃতি হিসেবে লতিফের কাছে রয়ে গেলো বারানের চুলের ক্লিপ। নিজের অসীম ভালোবাসা আর একটি চুলের ক্লিপ নিয়ে বারানের সন্ধানে নামলো লতিফ।
ভাগ্যচক্রে একসময় বারানকে খুঁজেও পেলো। জানতে পারলো, অভাবে কোণঠাসা বারান’র পরিবার আফগান মুলুকে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু দেশে ফেরার মতো পর্যাপ্ত অর্থ তাদের কাছে ছিলো না। ত্রাণকর্তার ভূমিকায় এগিয়ে এলো লতিফ। নিজের চেষ্টায়, নিজের সবচে ভালোবাসার মানুষটিকে দূরে পাঠানোর ব্যবস্হা করলো সে। এক বৃষ্টি ভেজা সকালে ইরান ছেড়ে নিজ দেশের পথে যাত্রা করলো বারান। ফেলে গেলো লতিফ আর তার সমস্ত স্মৃতিকে।
বারান প্রায় নির্বাক এক মুভি। মুভি দেখার সময় (এবং মুভি শেষে) কান আর চোখের চে মনের খাটুনি হবে বেশি। বারানের নির্মাণশৈলীর মাঝে এক ধরণের এপিটমি আছে। বেশ কিছু দৃশ্য দেখেছি, যেগুলো ধারণ করার জন্য মানসম্মত ক্যামেরা ইক্যুইপমেন্ট প্রয়োজন। যা সাধারণত ইরানী মুভিতে অনুপস্হিত। ডাইরেকশন ওয়াইজ মাজিদির কাজ আমার কাছে অনেক পরিণত লেগেছে।
Children of Heaven (Bacheha-Ye aseman) -এ দর্শক অবজার্ভারের ভূমিকায় থাকে। যেন কোনো এক গল্প শুনছি। যেখানে মূল চরিত্রের অনুভূতিগুলো আমাদের স্পর্শ করবে। কিন্তু দর্শক কখনো কল্পনা করবে না চরিত্রগুলোর মনে কি চলছে। The Color of Paradise (Rang-e-Khodā) -তে মূল গল্পের চে ভিজ্যুয়াল অ্যাসথেটিক্স বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এ যেন ঈশ্বরের রঙ উপলব্ধির উৎসব। সেখানে বারানে পয়েন্ট অফ ভিউয়ের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। মাজিদি চেয়েছেন দর্শক যেন চরি্ত্রের সাথে একাত্নতা অনুভব করে, চরিত্রগুলোর স্হানে নিজেকে কল্পনা করে। প্রত্যেকেই যেন লতিফ হয়ে বারানকে আড়াল থেকে লক্ষ্য করে।
আর দশটা ইরানী মুভির চে এই সিনেমাটি আলাদা লেগেছে। কারণ যুদ্ধ-দারিদ্র্যকে ব্যাকগ্রাউন্ড রেখে বারান ভালোবাসার উন্মাদনার গল্প। দারিদ্র্য এখানে উপসর্গ হিসেবে আসেনি, অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে। আরেকটি ব্যাপার হলো, বারান থেকে মাজিদির সেন্স অফ হিউমারের প্রমাণ মিলে। তুলনামূলকভাবে ফানি সিকোয়েন্সের ব্যবহার বেশি। ব্যকগ্রাউন্ড স্কোরের চে চারপাশের শব্দগুলোর (অ্যামবিয়েন্স) উপরে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। এটাও খুব ভালো লেগেছে।
লতিফের সহায়-সম্পত্তি বলতে তেমন কিছু ছিলো না। এক বছরের জমানো বেতন, হাত খরচের টাকা থেকে সামান্য কিছু সঞ্চয় আর একটা আই ডি কার্ড (যে কার্ডটি না থাকলে সে কোথাও কাজ করার অনুমতি পাবে না) -এসবই ছিলো পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার সম্বল। বারানের জন্য এর সবই সে বিসর্জন দিলো। বদলে কি পেলো?
বারানের সাথে স্রেফ নীরব দশটি সেকেন্ড। জীবনের সমস্ত কিছু বিলিয়ে দিয়ে লতিফ পরিণত হলো একদম কপর্দকহীন নিঃস্ব এক মানুষে। কিংবা কে জানে, হয়তো বা পরিণত হলো পৃথিবীর সব চে ধনী ব্যক্তিতে। অর্থের হিসেবে সবচে ধনী ব্যক্তির চেয়েও বিত্তশালী হয়ে গেলো। কারণ এমন দশটি সেকেন্ড কখনো কড়ি দিয়ে কেনা যায়না। লতিফের মুখের হাসি অন্তঃত সে কথারই প্রমাণ। তার রাজকন্যা সিন্ডারেলা যে সারা জীবনের জন্য তার মনে ছাপ রেখে গিয়েছে। এক পাটি জুতোর ছাপ।
প্রথম অতিথি লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার জন্য অভিনন্দন স্নিগ। স্বাগতম দারাশিকো ব্লগে । 😀
চমৎকার রিভিউ হয়েছে স্নিগ। শেষে যেভাবে কম্পারেটিভ অ্যানালাইসিস করলেন – দারুণ। পরামর্শ হলো এই অ্যানালাইসিসটা ডিটেইলে করেন। মাজিদ মাজিদির যে কটা সিনেমা আপনার দেখা হয়েছে তার সবগুলো নিয়ে – স্টোরি, ক্যামেরা, ডায়লগ, অ্যাক্টিং ইত্যাদি। 🙂
ধন্যবাদ ভাইয়া।
চেষ্টা করবো আরো মুভি নিয়ে লেখার।তবে সমস্যা হলো, মুভির টেকনিক্যাল ব্যাপারে আমার জ্ঞান খুব সীমিত।গুটি কয়েক ফ্রি ওয়ার্কশপ আর ফিল্ম কোর্স করা বন্ধুদের নোটস (ফিল্ম কোর্সগুলো খুব এক্সপেন্সিভ, তাই কখনো করা হয়নি) পর্যন্ত আমার দৌড়।
শুভেচ্ছা রইলো।
khub chomotkar hoyeche ei lekha ti, kono shondeho nei. ei lekhoker moddhe moulikotter shondhan pawa jai. amar bishwash je ei lekhok shomalochona lekhar pashapashi moulik rochonai hat dile bhalo korben. bhalo legeche tar porimiti bodh ebong ‘uposhorgo’ ar ‘onushong’er shotontro babohar (distinctive use). lekhok ke onek dhonnobad.
অনেক ধন্যবাদ, ধ্রুব ভাইয়া।
আর আপনি যে কথাগুলো বললেন, সত্যিই লজ্জা পেলাম।
(চুপিচুপি বলছি, খুব ভালো লাগলো আপনার মন্তব্যটি পড়ে)
মাজিদ মাজিদির বেশ কিছু ফিল্ম আমার দেখা হয়েছে। কিন্তু লেখক যেভাবে বারান কে চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মাজিদের আরো দুটি ফিল্ম এর সাথে তুলনা করে – সে এক কথায় দারুন। খুব ভালো লাগলো লিখাটি পরে।
ভালো থাকবেন।
আপনাকেও ধন্যবাদ, শামীম ভাইয়া।
প্রেরণা পেলাম।
লেখা পড়ে মুভিটা দেখার ইচ্ছা জাগতেছে খু-উ-ব । নেটে পাওযা যাবে ? অথবা কষ্ট করে যদি লিংকটা দিতেন , ভালো হইতো । 🙂
যাক নেটে সার্চ দিয়ে ইউটিউবে পেয়ে গেলাম সাবটাইটেল সহ । যারা দেখতে চান তাদের জন্য লিংকটা দিয়ে দিলাম
http://www.youtube.com/watch?v=ANpKb46AcuU&feature=related
সবার পক্ষ থেকে – ধইন্যা 🙂
বস, আপনারা প্রো-পিক কিভাবে সেট করেন??
প্রো পিক সেট করার জন্য http://en.gravatar.com/ তে একটা অ্যাকাউন্ট রেজিস্ট্রার করে নিন … হয়ে যাবে 🙂
থ্যাংক ইউ, বস।হইসে 🙂 !
বস, আপনার লিন্কটা আমারো কাজে লাগবে।কারণ এই মুভিটার আপলোডার দেখি আরও কিছু ভালো মুভি আপলোড দিয়েছে।
আপনাকে ধন্যবাদ!
অসাধারন একটা রিভিউ স্নিগ ভাই !!! আমার কাছে মাজিদি নির্মিত সবচেয়ে প্রিয় ছবিটি হচ্ছে বারান।
কী অদ্ভূত এক ভালোবাসা!! এছবিটার প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে স্পর্শ করেছে। ঠিক পরিচালক যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই।
আপনার অ্যানালাইসিসটাও দুর্দান্ত লেগেছে।
দারাশিকো ভাইয়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করছি। আরো চাই। ডিটেইলে…
রুশো ভাই এইবার আপনার পালা… দারাশিকো ব্লগে লিইখেন যদি ভালো লাগে 🙂
আপনার মন্তব্য পেয়ে খুব ভালো লাগলো, রুশো ভাইয়া।
বারান আমার কাছে যত না মুভি, তার চে এক অনুভূতি, এক অভিজ্ঞতার স্মৃতি বহন করে।
দারাশিকো ভাইকে যা বলেছি, আপনাকেও তাই বলছি,
“চেষ্টা করবো আরো মুভি নিয়ে লেখার।তবে সমস্যা হলো, মুভির টেকনিক্যাল ব্যাপারে আমার জ্ঞান খুব সীমিত।”
শুভেচ্ছা রইলো!
এত সুন্দর ভালবাসার স্টোরি জীবনে কখনো কোনো মুভিতে দেখিনি আর দেখবোও না ,বারান !! শেষ পর্যন্ত আমাকে কাদিয়েছে 😥
আপনার চমৎকার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ইসরাফিল। বারান সত্যিই একটি দারুণ সিনেমা।
আমার ইউটিউব থেকে ছবি নামানো খুবই কষ্টসাধ্য মনে হয়… কেউ যদি অন্য কোন লিঙ্ক দিতেন তাহলে ভালো হতো…. আমি ক্লাসিক মুভির ভক্ত…… এতো সুন্দর রিভিউ পড়ে সেটা না দেখতে পেলে মনটা খারাপ হয়ে যাবে……. তবে এ ব্যাপারে দারাশিকো ভাই তো বস…… তিনি নিশ্চই একটা ব্যবস্থা করে ফেলবেন…….
ধ্যবাদ …..
বস, পারলে ডিভিডি কিনে ফেলেন।কালেকশন কিনলে, একসাথে অনেকগুলো ভালো মুভি পেয়ে যাবেন।
prothomei writer vai k congratulation…janai prothom othithi lekhok howar jonno….tarpor boli sobai ja bollo likhata valo hoyeche,kisudin age btv te majid majidir 2ti cinema”children of heaven “r “baran” niye jahidur rahim onjon er analysis dhormi akta programme dekhlam…tarpor ai lekha…chobita dekhar agroho ar o bere galo….tobe boss cinemar bivinno section jemon editing ,lights,script,acting,cinematography……ai rokom basis a comparative likhle ara besi jante pari jamonta darashiko vai bollen……jak apnar kache aro besi likha chai…thank u….
অনেক ধন্যবাদ সুমন ভাই!
বিটিভি-তে এমন দারুণ অনুষ্ঠান হয় জানতাম না তো।
চেষ্টা করবো আরো ভালো করে লিখতে।
Very nice movie. Majid Majidi is the best
আবার জিগায় 🙂 !
মুভিটা দেখছিলাম সন্ধায়; সেই রাত্রে আর ঘুমাইতে পারি নাই- চমৎকার একটা ভাললাগা লেপ্টে ছিল পুরোরাত।
রিভিউটা অসাধারণ হয়েছে।
jotil hoice…
Welcome to Darashiko Blog Ruhul Amin 🙂
Keep in touch with the site- thanks
প্রিয় মুভি। দারুন রিভিউ। আরও লিখুন 🙂