তারে জামিন পার

তারে জামিন পার

হিন্দী মুভির প্রতি আমার কিছুটা বিতৃষ্ণা আছে। কারণটা বেশ স্বাভাবিক। ইন্ডিয়ার মুভিগুলোকে ‘ফরম্যাট ফিল্ম’ বলা চলে । কতগুলো নির্দিষ্ট ফরম্যাট অনুসরন করে সব ধরনের দর্শকের চাহিদা পূরণ করে তাদের কমার্শিয়াল ফিল্ম গুলো ভালোই ব্যবসা করছে। তবে আমির খান একটু ব্যতিক্রম। লগন, দিল চাহতা হ্যায়, ফানা, রঙ দে বাসন্তি’র মত মুভিগুলো এই বিশ্বাস সৃষ্টি করে পাকাপোক্ত করেছে। সুতরাং ‘তারে জামিন পার’ও যে একটি ভালো মুভি হবে, দেখার আগেই সে সম্পর্কে নিশ্চিৎ হয়েছিলাম – কিছূটা ট্রেলার দেখে, কিছূটা নিউজপেপার পড়ে।

‘তারে জামিন পার’ পুরোপুরি শিশুদের ছবি। অন্ততঃ প্রযোজক, পরিচালক শিশুদের কথা মাথায় রেখেই ছবিটি বানিয়েছেন। শিশুদের সেই রঙ্গীন জগৎ, যেখানে মাছ, পাখি আর ফুল ফলে ভরা, আর যেখানে সকল বস্তুই নেচে গেয়ে আনন্দে মত্ত থাকে – ঠিক তাকেই তুলে এনেছেন পরিচালক আমির খান। প্রযোজকের খাতায় নামটি আগেই লিখিয়েছিলেন, এবার সফল পরিচালকের খাতায় নাম লেখালেন ‘তারে জামিন পারে’র মাধ্যমে।

ছবির গল্পটা কিছুটা অন্যরকম। এমন একটি মানসিক সমস্যাকে পরিচালক তার মুভির মাধ্যমে তুলে এনেছেন যা সকল বাবা-মাকেই নতুন করে ভাবতে শেখাবে। মুভির কেন্দ্রীয় চরিত্র ইশান নন্দীকিশোর আওয়াস্তি আট/নয় বছর বয়সী দুরন্ত বালক। আকর্ষনীয় এই বালকটি ডাইস্লেক্সিয়া নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত। বানান ভুল করা আর পড়াশোনায় গোলমাল এ রোগের অন্যতম প্রধাণ লক্ষণ। ইশান ক্লাসে কিছুই পারে না, পরীক্ষাতেও তার নম্বর সবার শেষে। অথচ তার বড় ভাই ইয়োহান সবদিক থেকেই শীর্ষে – পড়াশোনায় তো বটেই, খেলাধূলাতেও সে খুব ভালো। ইশানের দুরন্তপনা আর অ্যাকাডেমিক রিপোর্টে চরম ব্যর্থতাকে ‘ডিসিপ্লিনে’র আওতায় আনতে পাঠিয়ে দেয়া হয় বোর্ডিং স্কুলে।

প্রিয় মা আর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইশান পাল্টে যায়। ক্লাসের সবচেয়ে চুপচাপ ছেলেটি হয়ে যায়। হঠাৎ একদিন রাম শঙ্কর নিকুম্ভ নামে এক নতুন আর্ট শিক্ষক যোগ দেয় বোর্ডিং স্কুলে। মুহুর্তেই পাল্টে যায় সবকিছূ। সম্পূর্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে পাঠদানের মাধ্যমে নিকুম্ভ স্যার সকলের প্রিয় হয়ে উঠেন। কিন্তু ইশানই একমাত্র ব্যতিক্রম। তার এই চুপচাপ ও মনমরা ভাব নিকুম্ভ স্যারের মনযোগ কেড়ে নেয়। আস্তে আস্তে সব কিছু জেনে নেন তিনি। যোগাযোগ করেন ইশানের বাবা-মার সাথে, চেষ্টা করেন ছেলের সমস্যাটি বোঝাতে, কিন্তুু ব্যর্থ হন।

অবশেষে প্রিন্সিপালের অনুমতিক্রমে ইশানকে ব্যক্তিগতভাবে এবং ইশানের ছবি আকাঁর অসাধারণ প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে সারিয়ে তুলেন এই রোগ থেকে। সকলের অংশগ্রহনে একটি ছবি আকার প্রতিযোগিতায় ইশান চ্যাম্পিয়ন হয়, নিকুম্ভ স্যার হন রানার আপ। তারে জামিন পার সিনেমার বাকী গল্প সহজেই অনুমেয়, ইশানই হয় ক্লাসের সেরা ছাত্র।

তারে জামিন পার মুভি শুরু হওয়ার আধাঘন্টা বাদেই আপনি হয়তো আঁচ করতে পারবেন শেষ পর্যন্ত কি ঘটবে। কিন্তু তারপরেও ছবির সামনে থেকে উঠতে মন চাইবে না। শুরুর দৃশ্যে ইশানের ড্রেন থেকে মাছ ধরে বোতলে করে বাড়ি নিয়ে আসা কিংবা রাস্তা থেকে চকচকে বস্তুটি তুলে নিয়ে পকেটে ভরা মার্ক টোয়েনের সৃষ্টি হাকলবেরি ফিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু একটু পরেই বোঝা যায় মুভির গল্প এগোচ্ছে নিজগতিতে।

শিশুদের জন্য বলেই হয়তো জায়গামত এবং অত্যন্ত পরিমিতভাবে অ্যানিমেশন ব্যবহার করেছেন পরিচালক। ছবির আরেক প্রধান চরিত্র নিকুম্ভ স্যাররূপী আমির খান পর্দায় প্রবেশ করেছেন মুভি শুরুর প্রায় একঘন্টা পরে যা ভিন্নতার আমেজ বহন করে। চমৎকার লোকেশন, শ্রুতিমধুর গান, আর প্রত্যেক চরিত্রের বাস্তব অভিনয় ছবিটিকে সাফল্যের দ্বারে পৌছুতে সাহায্য করেছে । ইশানের চরিত্রে রূপদানকারী দারশিল সাফারীর অনবদ্য অভিনয় চরিত্রকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। নতুন এ শিশুটির অভিনয় যে কোন প্রফেশনালের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

সব মিলিয়ে বলতে হয়, ‘তারে জামিন পার’ একটি অসাধারণ ভালো ছবি। পরিচালক আমির খান এ ধরনের ভিন্ন কাহিনীচিত্র নির্মান করে সকলের প্রশংসা কুড়ানোর যোগ্য কাজটিই করেছেন। পুরো ছবিটি যেন তার ট্যাগলাইন – এভারি চাইল্ড ইজ স্পেশাল – কেই প্রতিফলিত করেছে। সুতরাং প্রত্যেকের জন্যই আলাদা ট্রিটমেন্ট, আলাদা যত্ন প্রয়োজন। ছবিটি দেখে না থাকলে আজই মনযোগ দিয়ে দেখুন, আমি বাজী রেখে বলতে পারি, আপনি চোখের পানি কোনভাবেই আটকে রাখতে পারবেন না।

[ এই লেখাটা যখন লিখেছিলাম তখনও ব্লগ লেখা শুরু করিনি, লেখাটা কিছুটা সম্পাদিত হয়ে যায়যায়দিন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, মূল লিংক দিতে পারলে ভালো লাগতো, কিন্তু ওদের ওয়েবসাইটে বেশ সমস্যা, আর্কাইভ হাওয়া হয়ে গেছে… ]

29.03.2008

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

5 Comments on “তারে জামিন পার”

  1. তারে জামিন পার নিয়া হুকপিহু’তে তেমন কিছু পাইলাম না। এটা কি কোন ছবি’র ডিরেক্ট নকল?

    1. হুকপিহু বহু আগেই আপডেট বন্ধ করে দিয়েছে।
      যতটুকু জানি এটা মৌলিক সিনেমা। তবে কনসেপ্ট ধার করা হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *