শেরশাহের জীবনী ‘তারিখ-ই-শেরশাহী’

শেরশাহকে আমরা চিনি সুর বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলার কিছুকালের সম্রাট হিসেবে। তিনি মুঘল সম্রাট হুমায়ূনকে পরাজিত করে দিল্লীর মসনদে আসীন হয়েছিলেন। তাঁর রাজত্ব স্বল্পকাল স্থায়ী হয়েছিল কিন্তু তিনি বেশ প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। সম্ভবত এ কারণেই ভারতবর্ষের ইতিহাসে শেরশাহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত। তাঁর সম্পর্কে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে ধরা হয় ‘তারিখ-ই-শেরশাহী’কে যা তার তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৪০ বছর পর মুঘল সম্রাট আকবরের নির্দেশে আব্বাস খান শেরওয়ানি নামের একজন ইতিহাসবেত্তা কর্তৃক লেখা হয়েছিল। শেরশাহ এর উত্থান-পতন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় এই গ্রন্থে।

শেরশাহর প্রকৃত নাম ফরিদ খান, শেরশাহ তার উপাধি যা তিনি সম্রাট হুমায়ূনকে পরাজিত করার পর ধারণ করেছিলেন। এর আগে তিনি শের খান নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি জাতিতে আফগান ছিলেন এবং তার জীবদ্দশায় তিনি বিচ্ছিন্ন আফগানদের একত্রিত করে বাংলা বিহারে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ১৫৪০ খ্রীস্টাব্দে তিনি সুর বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। মুঘল সম্রাট হুমায়ূনকে পরাজিত করে তিনি এই বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজ্য ছিল বিশাল – বাংলা, বিহার, নেপাল, পাকিস্তানের কিছু অংশ ঘিরে তার রাজ্য বিস্তৃত ছিল। তার রাজধানী ছিল সাসারাম-এ যা বর্তমানে ভারতের বিহারে অবস্থিত।

আব্বাস খান শেরওয়ানির বর্ণনানুসারে ফরিদ খান নিজেই প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন। তার দাদা এবং বাবার ছোট্ট জায়গীর ছিল। ফরিদ খানের বাবার চার স্ত্রীর দুটি করে আটটি পুত্রসন্তান ছিল এবং ফরিদ খান ছিল জ্যেষ্ঠ্য এবং যোগ্যতম। অথচ চতুর্থ স্ত্রীর প্রভাবে ফরিদ খানের পিতা চতুর্থ স্ত্রীর সন্তানদের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন যা শেষ পর্যন্ত পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্বে গড়ায়।পিতার মৃত্যুর পূর্বেই ফরিদ খান প্রশাসক হিসেবে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। পিতার মৃত্যুর পরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত ফরিদ খানের হাতেই ক্ষমতা স্থায়ী হয়।

শের খানের উত্থানের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, তিনি যাদের অধীনে চাকুরী করেছেন, যাদের অনুগত ছিলেন একসময় তাদের রাজ্যই কেড়ে নিয়ে ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। আব্বাস শিরওয়ানির বর্ণনা অনুযায়ী সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তিনি তার শাসকদের খুব অনুগত ছিলেন এবং প্রশাসনিক দক্ষতা, যোগ্যতা, তোষামোদ ইত্যাদির মাধ্যমে শাসকদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতেন। কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধি করে চলতেন যা তার শাসকদেরকে ভীত করা এবং অন্যান্যদের প্ররোচনায় শের খানের বিরোধিতায় উৎসাহিত করতো। ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, অনেকগুলো চরিত্র পরস্পরের সাথে এত ভালোভাবে মিশে রয়েছে, তাদের মধ্যে কত সুসম্পর্ক, অথচ ভেতরে ভেতরে একজন আরেকজনের শত্রুতায় লিপ্ত। ফরিদ খানের উত্থান-পতনে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বারবার।

বইয়ে শেরশাহের দুটো প্রতারণার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। একটি ঘটনায় তিনি সুলতান মাহমুদের সহযোগী হিসেবে সম্রাট হুমায়ূনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য লক্ষ্ণৌতে পৌঁছালেও গোপনে হিন্দু বেগের মাধ্যমে সম্রাটের নিকট খবর পাঠান এবং যুদ্ধের চরম সংকটের সময়ে সৈন্য নিয়ে পিছিয়ে আসেন, ফলে সুলতান মাহমুদ পরাজিত হন। অন্য ঘটনায়, তিনি চুনার দুর্গ হারানোর পর রোহতাস দুর্গের অধ্যক্ষকে কৌশলে বশ করেন এবং তার মাধ্যমে রোহতাস দুর্গে শেরশাহকে পরিবারসহ আশ্রয় দানের জন্য রাজাকে রাজী করান। কিন্তু, দুর্গে আশ্রয় গ্রহণের পর চুনার দুর্গের চেয়েও রোহতাস দুর্গকে বেশী পছন্দ করায় দুর্গটি দখল করে নেন এবং রাজাকে বিতাড়িত করেন।

শেরশাহ তার পুর্বের সুলতানদের রাজ্যশাসনপদ্ধতির ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ কারণে তিনি সবেতনে বিশাল এক নিয়মিত সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর বাহিনীতে কয়েক সহস্র রণহস্তী ছিল, অশ্বারোহী সৈন্য ছিল কয়েক লক্ষ। আব্বাস খান শিরওয়ানি তাঁর সৈন্যসংখ্যা গুণে শেষ করা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন।

তিনি অত্যন্ত কঠোর শাসক ছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। তার রাজ্যে যে কোন রকম গোলযোগ, বিদ্রোহ তিনি দৃঢ়ভাবে দমন করেছিলেন। ফলে, তিনি তার রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ বাধার মুখোমুখি হননি। শেরশাহের মৃত্যু আকস্মিক এবং দুর্ঘটনায় হয়েছিল। কালিঞ্জরের রাজ কিরাত সিংহ-এর দুর্গ দখলের জন্য তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এমনসময় তার বাহিনী থেকে নিক্ষিপ্ত একটি গোলা দুর্গের ফটককে ধ্বংস করলেও ফিরে এসে মজুদ গোলাবারুদের মধ্যে পড়ে এবং তিনি অগ্নিদগ্ধ হয়ে কিছুদিন পর মৃত্যুবরণ করেন।

বইটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম ভাগে শেরশাহের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ এবং দ্বিতীয় ভাগে শেরশাহের অবদান। প্রথম ভাগ পাঠ করলে বোঝা যায় শেরশাহ অত্যন্ত পরিশ্রমী ব্যক্তি ছিলেন। বিশেষ করে, তিনি যখন থেকে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছেন তখন থেকে একটানা ছুটে বেড়িয়েছেন। তার এই পরিশ্রমের ফলেই তিনি সুর বংশ প্রতিষ্ঠা করতে এবং হিন্দুস্তানকে নিজের করায়ত্তে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রথম ভাগের তুলনায় দ্বিতীয় ভাগ বেশ সংক্ষিপ্ত। রাজ্যপ্রতিষ্ঠার পর তা সুশাসনের জন্য শেরশাহ কি ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সাধারণ জনগণের কল্যাণার্থে তিনি কি কি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, বিশাল সৈন্যবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের পদ্ধতি, কৃষকদের কল্যাণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় দ্বিতীয় ভাগে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি কিছু নগর, দুর্গ ইত্যাদিকে ধ্বংস করে পুনরায় নির্মাণ করেন। যেমন পুরাতন দিল্লী নগরী যমুনা নদী হতে দূরে ছিল। তিনি সেই নগরী ধ্বংস করে যমুনার নিকটে নতুন করে দিল্লী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ইতিহাস রচিত হয় বিজয়ীদের হাতে। সুতরাং, সেই ইতিহাস একপাক্ষিক হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আব্বাস খান শেরওয়ানি তারিখ-ই-শেরশাহী লিখেছিলেন মোঘল সম্রাট আকবরের নির্দেশে। সে হিসেবে এই গ্রন্থে শেরশাহের বদনাম বেশী থাকবে – এমন আশংকা ছিল। অথচ, তারিখ-ই-শেরশাহী গ্রন্থে লেখক কোন পক্ষ অবলম্বন না করে নিরপেক্ষভাবে সব কিছু উপস্থাপন করেছেন।

ইতিহাস গ্রন্থখানি প্রাচীন পদ্ধতিতে লেখা। লেখক আব্বাস খান শেরওয়ানী একটানা ফরিদ খানের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়কে বর্ণনা করে গেছেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো – এখানে দিন তারিখের কোন সূত্র উল্লেখ নেই। এছাড়া মানচিত্রের অভাব এই বই পাঠকে কঠিন করে তুলেছে। মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর অনুবাদে বইটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ১৯৮৬ সালে প্রকাশ করেছিল। ইতিহাসের অত্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি সমসাময়িক কোন ইতিহাসবেত্তার সম্পাদনায় টিকা-টিপ্পনী এবং প্রয়োজনীয় মানচিত্র সহকারে প্রকাশিত হলে পাঠকের খুবই উপকার হতো। এই ঘাটতি পূরণে বাংলার ইতিহাস বিষয়ক সমৃদ্ধ কোন গ্রন্থ এবং তৎকালীন মানচিত্র সহকারে পাঠ করা উচিত।

দৈনিক দেশ রূপান্তর-এ প্রকাশিত

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *