আকবর আলি খানের ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’

পরার্থপরতার অর্থনীতি পিডিএফ আকবর আলী খান

পরার্থপরতার অর্থনীতি বই নিয়ে কিছু বলার আগে বলি – অর্থনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও সহজবোধ্য নয়৷ দেশের একজন গড়পড়তা মানুষের অর্থনীতি বিষয়ে সাধারণ জ্ঞানটুকুও না থাকার ফলাফল যে ভয়াবহ তা বর্তমান সময়ে খুব প্রকট। বিশেষ করে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকারি প্রপাগান্ডায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে আমজনতাকে যে ধারণা দেয়া হয়, তা কতটুকু যথার্থ আর কতটুকু ভুল বোঝানো – তা বেশিরভাগ মানুষই ধরতে অক্ষম।

অর্থনৈতিক বিবিধ বিষয়ের সহজ ও রসাত্মক উপস্থাপনার মাধ্যমে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিষয়াদির সাথে অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের রূপ সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা দেয়ার সৎ প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় ডঃ আকবর আলি খানের ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ে।

পরার্থপরতার অর্থনীতি বইটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো অর্থনীতির মত জটিল বিষয়কে অত্যন্ত সহজবোধ্য উপায়ে সাধারণ মানুষের জন্য উপযোগী করে উপস্থাপনা। কঠিন তত্ত্বকথা বিশ্লেষণের কোন প্রচেষ্টাই লেখক করেননি, বরং ইতিহাসে অর্থনীতিবিদদের পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থানের যুক্তি উদাহরণসমেত তুলে ধরে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন শ্রদ্ধেয় আকবর আলি খান।

পরার্থপরতার অর্থনীতির প্রবন্ধ

পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে মোট ১৫টি ‘অর্থনৈতিক’ প্রবন্ধ রয়েছে। প্রবন্ধগুলোর সিংহভাগের শিরোনাম থেকেই বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় যায়। যেমন: ‘সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি’, ‘বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অসাম্য’ ইত্যাদি। আবার কিছু শিরোনাম থেকে বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা না পাওয়া গেলেও পাঠকের মনযোগ আকর্ষণের জন্য খুবই উপযোগী। উদাহরণ হিসেবে “শুয়রের বাচ্চাদের” অর্থনীতি, ‘মোল্লা নসরুদ্দিনের অর্থনীতি’, ‘বাঁচা-মরার অর্থনীতি’ ইত্যাদির নাম বলা যায়।

বইটির মূল নিবন্ধ ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’-তে লেখক দান খয়রাত বিষয়ে অর্থনৈতিক ভূমিকা বর্ণনা করেছেন, এর সুবিধা অসুবিধা তুলে ধরে বাংলাদেশের মতো দেশে সঠিক পদ্ধতি কী হওয়া উচিত সেই মত প্রকাশ করেছেন। “শুয়রের বাচ্চাদের” অর্থনীতি প্রবন্ধে “শুয়রের বাচ্চা” বলতে সেইসব সরকারী কর্মকর্তাদেরকে বুঝিয়েছেন যারা ঘুষ নিলেও যে উদ্দেশ্যে নিয়েছেন তা অর্জনে সহায়তা করেন না। ঘুষের অর্থনৈতিক প্রভাব ও এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এই প্রবন্ধে।

‘বাঁচা-মরার অর্থনীতি’ নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে। মূলত উন্নত-উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়েই এই আলোচনা। মোল্লা নসরুদ্দিনের অর্থনীতি একটি সরস নিবন্ধ যেখানে মোল্লা নসরুদ্দিনের বিভিন্ন গালগল্পের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক ও অর্থনীতিবিদদের কর্মকৌশল ও আচরণ উপস্থাপন করা হয়েছে।

অত্যন্ত সুপাঠ্য প্রবন্ধের নাম ‘সোনার বাংলাঃ অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত’। বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকের এই প্রবন্ধ পাঠ করা উচিত বলে আমি মনে করি। আমাদের এই বাংলাদেশকে সোনার বাংলা বলে অভিহিত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে কতটুকু সোনার বাংলা ছিল তার ঐতিহাসিক আলোচনা করা হয়েছে এই প্রবন্ধে।

পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ের ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ প্রবন্ধে ম্যালথুসের তত্ত্ব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পাশাপাশি বর্তমান দুনিয়ার বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া, ‘ভারতীয় অর্থনীতি’ শব্দগুচ্ছের বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে ‘ভারতীয় অর্থনীতির উত্থান পতন’ প্রবন্ধে। ব্রিটিশ শাসনামলে এ অঞ্চলের সম্পদ পাচার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য ও মতামত পাওয়া যাবে এ প্রবন্ধে।

মূলত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এমন প্রবন্ধের মধ্যে ‘খোলা ম্যানহোলের অর্থনীতি’, ‘বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের অর্থনৈতিক রাজনীতি’, ‘সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ ইত্যাদি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের এবং প্রশাসনিক গলদের সুযোগ ব্যবহার করে অন্যান্যদের অপকর্মের নানা উদাহরণ এই লেখাগুলোতে পাওয়া যায়।

ডঃ আকবর আলি খান সম্পর্কে

ডঃ আকবর আলি খান পড়াশোনা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে৷ কিন্তু ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করার পরে ১৯৭৭ সালে আমেরিকার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স এবং পরবর্তীতে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে প্রেষণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে এবং বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিচালকমন্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের অর্থনৈতিক মিনিস্টার, বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বিভাগের চেয়ারম্যান, অর্থ বিভাগের সচিব ও কেবিনেট সচিব, বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অর্থনীতি বিষয়ে বই লেখার জন্য তিনি যে অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি – তা অত্যন্ত স্পষ্ট। অর্থনৈতিক জ্ঞানের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাকে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিষয়ে দক্ষ করে তুলেছে। প্রকৃতপক্ষে তার জ্ঞান ও যোগ্যতার পরিচয় একটিমাত্র অনুচ্ছেদে সংক্ষেপে দেয়া সম্ভব নয়।

পরামর্শ

পরার্থপরতার অর্থনীতি বইটি ২০০০ সালে প্রকাশ করেছে দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। আমার হাতে যে বইটি রয়েছে সেটি ২০১৫ সালে প্রকাশিত একাদশতম সংস্করণ। অত্যন্ত সুপাঠ্য ও তথ্যবহুল এই বইটি পাঠ করতে গিয়ে একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে বারবার৷ কোন নিবন্ধটি কখন রচিত হয়েছে তার কোন উল্লেখ বইয়ের কোথাও নেই। অথচ রচনাকাল উল্লেখ থাকলে নিবন্ধগুলোর প্রেক্ষাপট উপলব্ধি করা নিঃসন্দেহে আরও সহজতর হতো।

অর্থনীতি বিষয়ে আগ্রহী পাঠকের জন্য অবশ্যপাঠ্য ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’, অন্যান্য পাঠকেরাও হতাশ হবেন না বলে বিশ্বাস করি।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *