বিশ্ব পর্যটন দিবসে ‘গ্রাম’ ভাবনা

আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো, ‘গ্রামীণ উন্নয়নে পর্যটন’। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি এ উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন।

করোনা মহামারির এই ক্রান্তিকালেও বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে দিবসটি বিভিন্ন উপায়ে পালন করা হচ্ছে। এ কথা কে না জানে, করোনার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বিপর্যস্ত শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পর্যটন শিল্প। করোনাত্তোরকালে এই শিল্পকে কীভাবে দ্রুততম উপায়ে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব সে বিষয়ে নানা রকম গবেষণা-চিন্তাভাবনা চলছে।

বিপর্যস্ত শিল্পকে পুনরুদ্ধার করার জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ অপরিহার্য এবং এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত কোন মতামত নেই। তবে, বিশ্ব পর্যটন দিবসে আমার কিছু ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা তুলে ধরা যেতে পারে।

২০২০ সালের বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অদম্য বাংলাদেশের অন্যতম এজেন্ডা ‘গ্রাম হবে শহর’ এর সঙ্গে জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা কর্তৃক ঘোষিত প্রতিপাদ্যের সঙ্গে অত্যন্ত সংগতিপূর্ণ। আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘গ্রাম হবে শহর’ মর্মে অঙ্গীকার করা হয়েছিল। এই অঙ্গীকারের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও ধারণা করা যায়, গ্রামগুলোকে শহরের ন্যায় সুযোগ-সুবিধা পরিপূর্ণ করা হবে। গ্রামকে শহরে রূপান্তর করতে গিয়ে গ্রামের যে চিরাচরিত অপরূপ সৌন্দর্য, তা কি বজায় থাকবে? সারা দেশে বর্তমানে যে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চলছে তা কিন্তু আমাদের আশান্বিত করে না।

বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো জেলা ঘুরতে গিয়ে গ্রামের নানা রূপ প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু এই রূপের সঙ্গে আমার শৈশবের দেখা গ্রামের কোন মিল আমি আর খুঁজে পাই না। আমার নানাবাড়ি থেকে ২০০ মিটার দূরত্বে একটি খাল ছিল। আমরা নানাবাড়িতে যেতাম নৌকায় চড়ে। ঘণ্টা দুই-তিনেক লাগতো। মাঝি বৈঠা হাতে নৌকা বাইতো, আমরা নৌকার ছাউনির নিচে বসে খালের আশপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে যেতাম। আম্মা তার ব্যাগ থেকে ঘরে বানানো খাবার বের করে আমাদের খেতে দিতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নৌকার মাঝি হতো আম্মার পরিচিত কেউ। তখন আম্মা ছাউনির ভেতর থেকে মাঝির কাছে গ্রামের লোকদের খোঁজ-খবর নিতেন। বিকেল বেলা আমরা হাঁটতে হাঁটতে খালের পাড়ে এসে একটা তালগাছের গোড়ায় বসতাম। কিছুক্ষণ পরপর বৈঠায় চালিত নৌকা যেতো আমাদের সামনে দিয়ে।

দিনে দু-তিনবার নানাবাড়িতে বসেই আমরা শুনতে পেতাম গ্রামের নিস্তব্ধতা ছিন্নভিন্ন করে ভটভট শব্দে কোন ট্রলার যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে শোনা যেতো সেই শব্দ, একসময় মিলিয়ে যেতো দূর-দুরান্তে।

নানাবাড়িসহ বেশির ভাগ বাড়িতেই ছিল মাটির ঘর। মানে, দেয়ালগুলো মাটিতে তৈরি, ছাঁট টিনের। অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের ঘরগুলোর ছাদ অবশ্য গোলপাতা, ছন ইত্যাদির তৈরি। মাটির তৈরি ঘর হওয়ার কারণে ঘরের মধ্যে একটা অপরিচিত অদ্ভুত সোঁদা গন্ধ পাওয়া যেতো। নানিসহ বাড়ির অন্যান্য মহিলাদের গোবর দিয়ে মাটির ঘরের দেয়াল, মেঝে লেপতে দেখেছি। আশপাশে প্রচুর গাছ। আর ছিল পুকুর। বৃষ্টির দিনে সেই ঘরের মাদকতাপূর্ণ অভিজ্ঞতা কখনই ভোলা সম্ভব নয়।

রাতের বেলা পুরো গ্রামটা তলিয়ে যেতো নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে। আকাশে চাঁদ থাকলে তার আলোতেই পথ চলা যেতো, তবে সবার হাতে থাকতো টর্চ লাইট, অনেকের হাতে কেরোসিনের বাতি বা হারিকেন। ঘরে জ্বলতো হারিকেন, কুপি। সেই আলোতেই খাওয়া-দাওয়াসহ নৈমিত্তিক সকল কাজ সারতে হতো। ঝিঁঝি পোকার চিৎকারে কান ঝালাপালা হয়ে যায়।

গ্রামের বাড়ির অভিজ্ঞতা বলতে গেলে শেষ করা সম্ভব হবে না। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে যারা বাংলাদেশের গ্রামে গিয়েছেন, থেকেছেন— তাদের সবার অভিজ্ঞতা এ রকমই হবে। এখন নানাবাড়ির সেই রূপ আর নেই। গাছপালা কমে গেছে অনেক, খালটি শুকিয়ে ড্রেনে পরিণত হয়েছে, সেখানে কোন নৌকাই চলে না। গ্রামে বিদ্যুৎ আছে, সবার হাতে মোবাইল। কেরোসিনের বাতি হারিয়ে গেছে, এখনকার বাচ্চারা হারিকেনই চিনে না।

আমি একটা অদ্ভুত ইচ্ছা আছে। একটা গ্রামের পরিবর্তনকে ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে দেওয়া। সেখানে মাটির-টিনের-ছনের ঘরগুলোকে কোন ইট-পাথরের দালানকোঠায় বদলে দেওয়া হবে না। সেখানে নারীরা সকালবেলা পুকুর ঘাটে হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন নিয়ে ঘষামাজা করে ধুবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের শক্ত-সমর্থ পুরুষেরা গরু-লাঙল নিয়ে মাঠে যাবে, গরুকে উদ্দেশ্য করে তাদের ‘হট-হট, হেই-হট’ চিৎকার নির্দেশনা বাড়ি থেকেই শোনা যাবে। রাত্রি সেখানে আসবে গাঢ়-কালো অন্ধকার নিয়ে, জোনাকি উড়ে বেড়াবে মিটিমিটি আলো নিয়ে, আর শোনা যাবে ঝিঁঝি পোকার চিৎকার। ভরা জোছনায় নদী বা খালের তীরে বানানো বাঁশের বেঞ্চিতে বসে শোনা যাবে নদীর কুলকুল শব্দ। শহরের মানুষেরা গ্রামের এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসবে পরিবার নিয়ে, বাচ্চাদের ধরে ধরে চিনিয়ে দেবে গাছ, পাখি, নৌকা, হারিকেন ইত্যাদি।

আমার দৃষ্টিতে সেটাই হবে গ্রামীণ পর্যটন।

ছবি কৃতজ্ঞতা: ওয়াহিদ সুজন

দেশ রূপান্তর অনলাইনে প্রকাশিত

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *