নিজ বয়ানে বুড়ো নাম্বির গল্প

গল্পকথক বুড়ো নাম্বি গল্প বলত। দারুন সব গল্প। এক একটা গল্প বলতে কয়েকদিন লেগে যেত। সেই গল্প বুনতে লাগত মাসখানেক। গল্প বোনার কাজটা নাম্বি একাই করত। সে থাকত একা। গ্রাম থেকে দূরে। নির্জনে গল্প তৈরী করা সহজ। অনেক যত্ন নিয়ে গল্প তৈরীর কাজ যখন শেষ হত, তখন সে গাছের কুলুঙ্গিতে চেরাগ জ্বালাতো।

সন্ধ্যার সময় জ্বালানো সেই চেরাগের আলো দেখা যেত দূর রাস্তা থেকে। সেই রাস্তা দিয়ে ঘরে ফিরতো কর্মঠ গ্রামবাসী, সারাদিনের কাজ শেষে। বাতি দেখেই তারা বুঝতে পারতো – গল্প বোনা শেষ, এবার পরিবেশনের পালা। সুতরাং বাড়ি ফিরে খেয়ে নিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে তারা চলে আসতো নাম্বির বাড়িতে। সবাই উপস্থিত হয়ে গেলে নাম্বি হাত তুলে তাদের থামিয়ে দিত, তারপর শুরু করতো তার গল্প বলা।

‘এই যে বিশাল পাথরটা দেখছো, ষাট বছর আগে কিন্তু এখানে এই পাথরটা ছিল না। আজ যে গল্পটা বলবো সেটা শোনার পরই জানতে পারবে পাথরটা কিভাবে এই জায়গায় এল। সে অনেকদিন আগের কথা …’ – এভাবে শুরু হত নাম্বির গল্প বলা। গল্প চলত সারা রাত ধরে। পূবের আকাশে আলোর রেখা দেখা গেলে গল্প বলা বন্ধ করতো নাম্বি, নিভিয়ে দিত কুলুঙ্গির বাতি। ঘুম ঘুম চোখে শ্রোতারা ফিরত তাদের বাড়ি, ঘুমন্ত বাচ্চাদের কোলে নিয়ে। গল্পের বাকী অংশ শোনার জন্য ফিরতো রাতের খাবার শেষে।

বুড়ো নাম্বির শেষ গল্প

শেষ গল্পটা বলার মাসখানেক পর একদিন বুড়ো নাম্বির বাড়িতে আবার আগুন জ্বলল। রাস্তা থেকে ঘর-ফিরতি মানুষজন বুঝে গেল – নতুন গল্প তৈরী হয়েছে, আজকে বলা হবে সেই গল্প। ঘরে ফিরে তাড়াহুড়োয় খেয়েদেয়ে পরিবার নিয়ে নাম্বির ঘরে হাজির হল গ্রামবাসী, উত্তেজনায় ভরপুর অবস্থা। গল্প বলার জন্য নাম্বি মুখ খুলল, কিন্তু আওয়াজ বের হল না।

বুড়ো নাম্বি

গ্রামবাসী অবাক!
বুড়ো নাম্বী আবারও মুখ খুলল। কিন্তু এবারও কোন আওয়াজ বের হল না। এক মাস সময় নিয়ে যে গল্প তৈরী হয়েছে, তা কি বলা হবে না?
গ্রামবাসীরা নির্বাক – কি হল নাম্বী বুড়োর?
নাম্বী চেষ্টা করল বেশ কয়েকবার, কিন্তু না, গল্প আর এলো না। কুলুঙ্গির আগুন নিভিয়ে দিল নাম্বী – আজ গল্প বলা হবে না, আগামীকাল।

কিন্তু আগামীকালও কোন গল্প এল না নাম্বীর কন্ঠে। বিরক্ত গ্রামবাসী বিরসবদনে বাড়ি ফিরল।

তৃতীয়দিন নাম্বি আবারও বাতি জ্বালাল। দোনামোনা করে হাজির হল গ্রামের লোকজন – দেখা যাক নাম্বী গল্প বলতে পারে কিনা।

‘তোমরা জানো, সৃষ্টিকর্তা আমাকে গল্প তৈরীর ক্ষমতা দিয়েছেন। সেই ক্ষমতায় আমি এতদিন গল্প বলে এসেছি। যিনি গল্প তৈরীর ক্ষমতা দিতে পারেন, তিনি নিতেও পারেন। গল্প বলার ক্ষমতা নিয়ে গেছেন তিনি, আমি আর কোনদিন তোমাদের গল্প বলবো না। ভালো থেকো তোমরা। শুভরাত্রি।’

এই কথার পরে গল্পকথক বুড়ো নাম্বি হয়ে গেল সাধারণ বুড়ো নাম্বি। সাধারণ বুড়ো – যার আর কোন ক্ষমতা নেই, বাকী দশজন গল্প শ্রোতার মতই একজন সাধারণ মানুষ, সাধারণ বুড়ো নাম্বি।

(আর কে নারায়নের – ‘আন্ডার দ্য ব্যনিয়ন ট্রি‘ গল্পের নিজস্ব বয়ান)

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *