বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ‘বাংলা নবজাগরণ’

গত ৫ই অক্টোবর শাহিন-সুমন পরিচালিত বাংলাদেশের সিনেমা ‘ভালোবাসার রং’ দেশের প্রায় ৫৩টি হলে একত্রে মুক্তি পেয়েছে। পরের দিনই পত্রিকায় জানা গেল, মুক্তির প্রথম দিনেই ভালোবাসার রং প্রায় পঁচিশ লক্ষ টাকা আয় করেছে যা এখন পর্যন্ত সর্ব্বোচ্চ এবং এর মাধ্যমে সিনেমাটি বিশ বছর আগের ‘বেদের মেয়ে জোছনা’র তৈরীকৃত রেকর্ড ভাঙতে পেরেছে। বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সাম্প্রতিক অবস্থা একে অস্তিত্বের হুমকী হিসেবে প্রতীয়মান করেছিল। সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছি – এ ধরনের সংবাদ আমাদেরকে সেই আশা দেখায়।

অবশ্য, এর প্রায় এক সপ্তাহ পরেই কালেরকন্ঠে প্রকাশিত দাউদ রনি-র সিনেমা সমালোচনা থেকে প্রায় কপি পেস্ট করে একই গ্রুপের ওয়েব পত্রিকা বাংলানিউজে এ একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যেখানে প্রশ্ন করা হয় – দৈনিক যদি প্রতিটি সিনেমা হলে ২০০ থেকে ২৫০ জন দর্শক ছবিটি দেখেন তাহলে কিভাবে এত টাকা আয় হয়। এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিতি নতুন দৈনিক মানবকন্ঠে

তাদের রিপোর্ট থেকে জানা যায় – প্রথম সপ্তাহে ভালো আয় করলেও পরের সপ্তাহে দর্শক আর হলে ঢুকছে না। ‘ভালোবাসার রং’ সিনেমার প্রযোজক প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার অন্যতম কর্ণধার শীষ মনোয়ার জানিয়েছেন, প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা খরচ করে ছবিটি তৈরী করা হলেও এক সপ্তাহে ৭৮ লক্ষ টাকা উঠে এসেছে, হল মালিকদের কাছ থেকে আরও সাড়ে সাত লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে। এই বক্তব্য সত্যি হলে বলতে হবে – ভালোবাসার রং বেশ দ্রুতই নিস্প্রভ হয়ে গেছে, রং বেশীদূর ছড়াতে পারে নি।

‘ভালোবাসার রং’ কেন ব্যর্থ হয়ে গেল তা বিশ্লেষনের প্রয়োজন আছে, তবে তা এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। এই পোস্টের বিষয় দুটো। এক, আয়ের ভিত্তিতে সাফল্য মাপার প্রবণতার পরিমাপ এবং দুই, বাংলা নবজাগরণ।

শুধু বাংলাদেশের সিনেমা বা এই উপমহাদেশেরই নয়, বিশ্বের প্রায় সব সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতেই সিনেমা মুক্তির পর আয় কত হল তা পরিমাপ করা হয় এবং এর ভিত্তিতে কোন সিনেমা কি রেকর্ড গড়ল এবং ভাংল তা নিয়ে আলোচনা তৈরী হয়। প্রশ্ন হল, আয়ের ভিত্তিতে তুলনা করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত। টাকার মান প্রতিবছর কমছে। বেদের মেয়ে জোছনা যে সময় মুক্তি পেয়েছিল তখন হয়তো টিকিটের সর্ব্বোচ্চ  দাম ছিল ত্রিশ টাকা। প্রায় বিশ বছর বাদে কোন সিনেমার মিনিমাম টিকিটের দামই ত্রিশ টাকা।

আবার, বিশ বছর আগে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। বর্তমানের সাড়ে ছয়শো সিনেমা হলের সাথে তুলনা করলে বর্তমানে ব্যবসা হওয়ার সুযোগও কম। আবার, একটা সিনেমা প্রথম সপ্তাহে কতগুলো সিনেমাহলে মুক্তি পাচ্ছে সেটাও বিবেচ্য বিষয়। ভালোবাসার রং যদি একত্রে ৫৩টা সিনেমা হলে মুক্তি দেয়া হয় তবে দিনে ৪টা শো হিসেবে দিনে ২১২টা শো-তে দর্শককে দেখানো এবং তাদের থেকে আয়ের সুযোগ ঘটে। অন্যদিকে মাত্র দুইটা সিনেমাহলে মুক্তি দেয়া সিনেমা ‘ঘেটুপুত্র কমলা‘ দিনে সর্ব্বোচ্চ শো হবে ৮ টা। সুতরাং, চাইলেও একদিনে সবচে বেশী আয়ের রেকর্ড করা ঘেটুপুত্র কমলার পক্ষে সম্ভব হবে না।

একটা সিনেমা কত সফল তা পরিমাপ করার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ভাল উপায় হল কতদিন হলে সিনেমাটি চলেছে। বর্তমানে কোন সিনেমা কোন হলে একের বেশী দুই সপ্তাহ চললেই তাকে সফল হিসেবে গন্য করা হয়। তবে সবচে বেশী ভরসাযোগ্য পরিমাপ হতে পারে কি পরিমান দর্শক হলে গিয়ে সিনেমাটি দেখেছে। এ জন্য নির্দিষ্ট কোন সময় নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে – যেমন, এক মাসে কতজন দর্শক সিনেমাটি দেখেছে ইত্যাদি।

এ ধরনের পরিমাপেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, যেমন – বেদের মেয়ে জোছনা-র সময়ে অনেক বেশী দর্শক হলে গিয়ে সিনেমা দেখত, বর্তমানে এর পরিমান অনেক কম। সুতরাং, এই প্রবণতাও প্রভাব ফেলবে। একটি গ্রহনযোগ্য পরিমাপপদ্ধতি উদ্ভাবন খুবই জরুরী – বাংলাদেশের সিনেমা কোন পথে চলছে তা নিরূপন করা যে কোন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির জন্যই উপকারী।

সর্ব্বোচ্চ আয় করে রেকর্ড তৈরী করার পর কোন কোন সিনেমা এই ফলক ছুঁয়েছে তা জানার চেষ্টা করেছিলাম – কিছুই পাওয়া যায়নি ওয়েব দুনিয়ায়। যে ‘বেদের মেয়ে জোছনা’র সাথে তুলনা করা হয়েছে তার সম্পর্কে কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য নেই। অন্যান্য সিনেমার আয় সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায়, তার কোন বিশ্বাসযোগ্য সূত্র নেই।

উইকিপিডিয়ায় বেশ কিছু সিনেমা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ‘নাম্বার ওয়ান শাকিব খান‘- সিনেমাটিকে ২০১০ সালের সবচে বেশী ব্যবসাসফল সিনেমা হিবেসে চিহ্নিত করা হচ্ছে। একই অভিনেতার সিনেমা ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’ সিনেমাকে আয়ের দিক থেকে সে বছরের দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বলে দাবী করা হচ্ছে। আবার প্রিয়া আমার প্রিয়া-কে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচে বেশী ব্যবসাসফল সিনেমা হিসেবে দাবী করা হচ্ছে। বলাবাহুল্য, এ দুটো তথ্যেরই কোন রেফারেন্স নেই।

এফডিসি-র সাইটে এ ধরনের কোন তথ্য সম্ভবত কখনোই সংরক্ষন করা হয় নি। প্রয়োজনীয় অনেক তথ্যও সাইটে নেই – অপূর্নাঙ্গ ও অকার্যকর একটা সাইট এফডিসি-র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনে কতটুকু সহায়তা করছে প্রশ্ন জাগে।

হলিউড, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সহ সিনেমা শিল্পে উন্নত প্রায় সব দেশেই  মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার প্রায় সব ধরনের তথ্য উপাত্ত ওয়েবে দুনিয়াতে পাওয়া যায়। বক্সঅফিসমোজো নামে আইএমডিবি ডট কমের একটা আলাদা ডাটাবেজই আছে ছবির বাজেট-ব্যাবসা ইত্যাদি তথ্য সরবরাহ করার জন্য।

বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বর্তমানে একটি ট্রানজিশন পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত দুই বছরে নির্মিত সিনেমার পরিমান আশংকাজনকভাবে কমে যাওয়ার পরে এ বছর বেশ কিছু পদক্ষেপ লক্ষ্য করা গেছে। সরকার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে শিল্প ঘোষনাসহ আরও কিছু প্রনোদনার ঘোষনা দিযেছে, গত বছরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এদেশের হল মালিকদের ভাগ্য ফেরাতে ভারতীয় সিনেমা প্রায় তিন দশক পরে হলে প্রদর্শিত হয়েছে। বেসরকারী উদ্যোক্তারা এগিয়ে এসেছেন, বিপুল পরিমান অর্থ বিনিয়োগ করেছে।

শুধু সিনেমা নির্মান নয়, সিনেমা হলের উন্নয়ন, আধুনিকায়নেও বেষরকারী উদ্যোগ লক্ষ্যনীয়। ঢাকা সহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সিনেপ্লেক্স নির্মানে আগ্রহী ব্যবসায়ীরা সরকারের গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় আছে। তরুন চলচ্চিত্র নির্মাতারা সিনেমা নির্মানে শুধু এগিয়েই আসেন নি, নির্মানের ক্ষেত্রে নান্দনিকতা ও ব্যবসা – দু’য়ের সংমিশ্রন ঘটানোর চেষ্টা করছেন।

প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কথা বাদ দিলে বাংলাদেশের সিনেমার দর্শকদের আচরণও পাল্টেছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় দর্শকরা অনেক বেশী হলমুখী – তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকেট ব্ল্যাকাররা আবার ফিরে এসেছেন। প্রায় সবগুলো দৈনিক তাদের সাপ্তাহিক বিনোদন পাতায় সিনেমা রিভিউ ছাপাচ্ছেন, দেশীয় সিনেমাকে বলিউডের তুলনায় কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।

এমনকি, ওয়েব দুনিয়ায় সিনেমা নিয়ে ব্লগিং বেড়েছে – পুরোপুরি সিনেমাকেন্দ্রিক বাংলায় ওয়েবসাইট তৈরী হয়েছে, লেখালিখি-র মাধ্যমে বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে অবদান রাখার জন্যও তরুন প্রজন্মের অনেকে এগিয়ে এসেছে। এই সব কিছু কি ইঙ্গিত করে? বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে একটি বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে নীরবে। আমি এই বিপ্লবকে বলছি – ‘বাংলা নবজাগরন’। দশ বছর পরে চলচ্চিত্র গবেষক-সমালোচকরা এই সময়কে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন – এটা আমার বিশ্বাস।

এই বাংলা নবজাগরনের কিছু ফাঁক-ফোকর রয়ে যাচ্ছে এবং সিনেমা সংক্রান্ত তথ্যের অপ্রতুলতা এর অন্যতম। বাংলাদেশের সিনেমার বাজেট এবং ব্যবসা সংক্রান্ত তথ্যই নয় – সিনেমা নির্মানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা রকমের ঘটনার সুনির্দিষ্ট সংরক্ষন প্রয়োজন। বাংলাদেশের সিনেমা কোনদিকে যাচ্ছে, কি ধরনের পদক্ষেপ একে আরও উন্নত করতে পারে সে সকল সিদ্ধান্তের জন্য অবশ্যই এসকল তথ্যের প্রয়োজন হবে। সুতরাং এ গুরুত্ব উপলব্ধি করে পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হওয়ার সময় হয়েছে। আগ্রহী লোকজন এ ব্যাপারে ভেবে দেখতে পারেন।

বাংলাদেশের সিনেমার এই অগ্রগতি আরও গতিশীল হোক, বিভিন্নমুখী হোক – এই শুভকামনা থাকলো। গুড লাক বাংলাদেশের সিনেমা।

Thebangal.com এ প্রকাশিত

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

13 Comments on “বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ‘বাংলা নবজাগরণ’”

  1. আপনি বরাবরই ভালো লেখেন। সিনেমা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ ধন্যবাদ পাওয়ার দাবীদার।

  2. বাংলা সিনেমার এই অগ্রগতি আরও গতিশীল হোক, বিভিন্নমুখী হোক – এই শুভকামনা থাকলো। গুড লাক বাংলাদেশী সিনেমা।

    পর্যবেক্ষন ভালো লাগলো

  3. বাংলা সিনেমার জন্য imdb’র মত একটা ওয়েবসাইট আসলেই প্রয়োজনীয়। আশা করছি ভবিষ্যতে যোগ্য কেউ এ কাজটার জন্য এগিয়ে আসবেন।

  4. “ভালবাসার রং” সিনেমা হলে গিয়েই দেখেছি।রেড ক্যামেরা ছাড়া এই মুভিতে আসলে বলার মত কিছুই নাই।

  5. নতুন নায়ক নতুন নায়িকা দিয়ে ডিজিটাল ফর্মেটের এ ছবিতে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা কোখায় লাগতে পারে আমি বুঝছি না। জাজ অবশ্যি যদি ৫০ হলের কনভার্সন খরচ এবং তাদের এ ছবির ঠিক আগে কেনা রেড ওয়ান ক্যামটাকেও খরচের মধ্যে ধরে তাহলে সম্ভব।

    1. একই প্রশ্ন আমারও রন্টিদা। ফিল্ম ফর্ম্যাটে ট্রেডিশনাল সিনেমা বানাতেও তো এই পরিমান খরচ হয় না। অবশ্য বলা হচ্ছে, ওরা প্রমোশনের জন্য প্রচুর ব্যয় করেছে। পোস্টারের পেছনের খরচ বোঝা যায়, রাস্তাঘাটে প্রচুর পোস্টার, ব্যানার। শুনেছি, অন্যান্য জেলায় রোড শো টাইপ কিছু করেছে।

      তারপরও এত হওয়ার কথা না। ব্যাখ্যা জাজে’র কাছে 🙂

  6. এগিয়ে যাক বাংলা সিনেমা, এগিয়ে যাক দারাশিকো
    সঙ্গে আছি…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *