চিড়িয়াখানায় ঘোড়ার খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে রোদ পোহাচ্ছি। ঘোড়াগুলো হাতের নাগালেই ঘুরছে। কেউ কেউ হাত বাড়িয়ে ছুঁয়েও দিচ্ছেন। একটা লোক খাঁচার পেছন দিক থেকে দেয়াল টপকে খাঁচায় ঢুকলো, হাতে একটা বস্তা। চিড়িয়াখানার কর্মচারী, হয়তো খাবার দিবে বা অন্য কিছু – ধারণা করলাম। কিন্তু লোকটা বস্তা হাতে নিয়ে খাঁচার ভেতর দিয়ে দৌড়ে সামনের দিকে চলে এলো। তারপর দেয়ালে চড়ে বসল এবং হাতের বস্তাটি টেনে তুলল। এ পাশে নেমে যখন ভীড়ের মধ্যে মিশে যাচ্ছিল তখন দেখলাম – তার বস্তা থেকে কাপড়ের তৈরী কতগুলো পুতুল উঁকি দিচ্ছে। বুঝলাম – লোকটি চিড়িয়াখানার ভেতরের অন্যান্য পুতুল বিক্রেতাদের মতই একজন।
মিরপুরের বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা আমার পছন্দের জায়গা। এক যুগেরও আগে আমি যখন ঢাকায় এসেছিলাম, তখন পুরান ঢাকার লোহার পুল থেকে একাকী এই চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসেছিলাম। তারও আগে বাচ্চাকালে চিড়িয়াখানায় এসেছি। তখন পরিবারের সাথে আসতাম, এখন পরিবার নিয়ে আসি। চিড়িয়াখানায় বেড়াতে আসা আমার জন্য সুবিধাজনক – এখানে বেড়ানো যায়, বাচ্চাদের দৌড়ানোর আর খেলার ব্যবস্থা আছে এবং আমার বাসা থেকে রিকশায় চড়েই আসা যায়।
বলছিলাম পুতুল বিক্রেতার কথা। চিড়িয়াখানার ভেতরে আট-দশজন পুতুল বিক্রেতা রয়েছে। আরও আছে ফুল বিক্রেতা। বাচ্চাদের জন্য বুদবুদ তৈরির খেলনা বিক্রেতা আছে ডজনখানেক। বাদাম বিক্রেতাকে তো থাকতেই হবে। এরা টাকার বিনিময়ে পণ্য বিক্রয় করে। টাকার বিনিময়ে সেবা বিক্রি করছিলেন দুইজন। তাদের সার্ভিস হলো দোয়া করা। ছোট-বড় বিভিন্ন পরিমাণের দানের বিনিময়ে মহান রাব্বুল আলামীন যেন দানকারীকে মাফ করে দিয়ে বেহেস্ত নসীব করেন সেই দোয়া করে দিচ্ছেন তারা। দুজনের একজন বসেছেন প্রবেশ পথে, অন্যজন বাহির পথে। দুজনেই মসজিদ নির্মানের জন্য সাহায্য চাচ্ছেন, তবে সেটা চিড়িয়াখানার ভেতরের মসজিদ নয়। প্রবেশ পথের হুজুরের ভিডিও করতে গেলেই তিনি ওয়াজ থামিয়ে চুপ করে থাকেন। বাহির পথের হুজুর প্রথমে বুঝতে পারেননি সম্ভবত, তাই ওয়াজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারপর আমাকে দেখেই ওয়াজ থামিয়ে পানি খেতে শুরু করলেন।
চিড়িয়াখানায় একটি বয়োবৃদ্ধ গন্ডার আছে। তার সঙ্গী একটি ভেড়া। গন্ডারটা সম্ভবত নড়াচড়াও করতে পারে না, সাথে থেকে থেকে ভেড়াটারও হয়তো একই অবস্থা। দুজনেই নট নড়ন-চড়ন অবস্থায় বসে থাকে। গন্ডারটির কোন সঙ্গী নেই বলে ভেড়াটিকে সাথে রাখা হয়েছে। দেখে মনে হলো, এত বুড়া একটা গন্ডারের সাথে রাখা হয়েছে বলে ভেড়াটা প্রচন্ড বিষন্নতায় ভুগছে। কে জানে, হয়তো গন্ডারের মৃত্যুতে তার মুক্তি বলে সেও গন্ডারটার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে।
এর আগে যতবার গিয়েছি, সব সময়েই বানরের খাঁচার ভেতরে এবং বাহিরে ভীড় পেয়েছি। ভেতরে বানরের ভীড়, বাহিরে মানুষের। এবার দুটোই কম। এত বানর ছিল, সেগুলো যে কই হারালো, বুঝতে পারলাম না। তবে, সবসময় বানরের দুই একটা ছানা-পোনাকে খাঁচার বাহিরে পেলেও এবার পেলাম বুড়ো বানরকে। ওটা একটা গাছের উপরে বসে মানুষের বাঁদরামি দেখছিল।
সবচেয়ে অবাক হয়েছি হায়েনার খাঁচার সামনে গিয়ে। খাঁচার দেয়ালে টাঙ্গানো বর্ণনায় লেখা রয়েছে, ‘হায়েনা নিশাচর প্রাণি। সাধারণত দিনের বেলায় হায়েনাকে দেখা যায় না।’ এই বর্ণনার কারণে হোক বা নিশাচর হওয়ার কারণে, আগে কখনই হায়েনাকে দেখতে পাইনি। ওগুলো দূরে ঝোপের আড়ালে, শেডের মধ্যে লুকিয়ে থাকতো। এবারই প্রথমবার দেখলাম একটি বিশাল আকৃতির ডোরাকাটা হায়েনা উদোম গায়ে রোদের মধ্যে মাঠে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
কষ্ট লাগলো এশিয়ান হাতিদের দুরাবস্থা দেখে। তিন-চারটে হাতি রয়েছে চিড়িয়াখানায়। তাদের সবগুলোই মোটা শেকলে বাঁধা। ফলে জায়গায় দাঁড়িয়ে মাঝে মধ্যে ডাক দেয়া আর কলাগাছ খাওয়া ছাড়া ওগুলোর আর কিছু করার নেই। হাতির খাঁচার সীমানায় দেয়াল ছাড়াও একটি প্রায় পাঁচফুট চওড়া পরিখা আছে। এই পরিখা আর দেয়াল পার হয়ে হাতি পালিয়ে যাবে এমনটা বিশ্বাস হয় না। তাহলে কেন হাতিগুলোকে শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছে তা বোধগম্য হলো না।
কোন এককালে চিড়িয়াখানায় হাতি এবং ঘোড়ায় চড়ার ব্যবস্থা ছিল। বিশাল এক বট গাছের চতুর্দিকে ঘেরা দেয়া জায়গায় ঘোড়ার ট্র্যাক এখনও রয়েছে, নেই ঘোড়ায় চড়ার ব্যবস্থা।
জিরাফের খাঁচার সামনে ভীড় একটু বেশিই মনে হলো। গেল বছরে একটি জিরাফ বাচ্চা জন্ম দেয়ার পরে খবরের শিরোনাম হয়েছিল। সপ্তাহখানেকের মধ্যে আরও জন্ম নিয়েছিল একটি ঘোড়ার বাচ্চা, একটি জলহস্তীর বাচ্চা এবং একটি জেব্রার বাচ্চা।
বাচ্চাদের খেলাধূলার জন্য চিড়িয়াখানার অভ্যন্তরে একটি শিশুপার্ক রয়েছে। সেখানে গোটা কয়েক স্লাইডস, দুই তিনটি ঝুলন্ত দোলনাসহ কয়েকটি সি-স রয়েছে। শিশু দর্শনার্থীদের তুলনায় এদের সংখ্যা খুবই কম। তার উপর, দুয়েকটি দোলনার গোড়ায় পানি জমে থাকায় সেগুলো অপেক্ষাকৃত বড় শিশুরা ছাড়া অন্যরা ব্যবহার করতে পারছিল না। প্রত্যেকটি খেলনার চারদিকে সবাই যেভাবে অপেক্ষা করে থাকে সেটা খেলনা ব্যবহারকারীর জন্য বেশ অস্বস্তিকর।
চিড়িয়াখানার ভেতরে দুই একটি অনুমোদিত খাবারের দোকান রয়েছে। সেখান থেকেও বিরিয়ানী বা অন্যান্য লাঞ্চ আইটেম কেনার সুযোগ রয়েছে৷ চিড়িয়াখানার মসজিদের পাশে দক্ষিণ-পূর্বে এবং হাতির খাঁচার পশ্চিমে বেশ অনেকটা ফাঁকা জায়গা। যারা খাবার নিয়ে এসেছেন তাদের অনেকেই এখানে চাদর বিছিয়ে লাঞ্চ সেরে নিচ্ছেন। আশেপাশের জায়গাটা বেশ নোংরা। খাবারের উচ্ছিষ্ট, বিরিয়ানির খালি প্যাকেট, ব্যবহৃত প্লাস্টিকের প্লেট ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যারা বসে খাচ্ছেন তাদেরও যে কষ্ট হচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। অথচ চিড়িয়াখানায় পিকনিক স্পট রয়েছে দুইটি কিন্তু সেগুলো প্রায় পরিত্যক্ত, অপরিচ্ছন্ন। ফলে দর্শনার্থীরাও বাধ্য হচ্ছেন খোলা মাঠে লাঞ্চ সেরে নিতে।
পশুর মল-মূত্রের উৎকট গন্ধের মধ্যেও ভালো লাগার অনেক বিষয় আছে। যেমন হরিণের খাঁচার সামনে গিয়ে দেখা গেল খাঁচার সব হরিণ সদ্য সরবরাহকৃত সবুজ ঘাস খাওয়ার জন্য জড়ো হয়েছে। ছানাপোনা সহ সব মিলিয়ে শ খানেক হবে। খাওয়া শেষে আবার ছুটে যাচ্ছে খাঁচার আরেক দিকে। বিশাল আকৃতির শকুনগুলো দেখলে সম্ভ্রম জাগে। এত বিশাল পাখিও আকাশে উড়ে বেড়ায়! উটপাখিগুলো বিশাল কিন্তু বোকা। খাচার তারের বেড়ায় ক্রমাগত ঠোকর দিয়েই যাচ্ছে। দর্শনার্থীদের হাত থেকে বাদাম বা অন্যান্য খাবারও নিচ্ছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা এনিমেল প্ল্যানেট খুললেই যে ওয়াইল্ডে বিস্টকে দেখা যায় সিংহের শিকার হতে সেই ওয়াইল্ডে বিস্ট এখানে বেশ নিরাপদেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাঁচার বাঘকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার।
জাতীয় চিড়িয়াখানার ইতিহাস ঢাকার নবাবদের সাথে জড়িত। ব্যক্তিগত শখের জায়গা থেকে শাহবাগের নবাববাড়িতে নাকি চিড়িয়াখানা গড়েছিলেন নবাবেরা। সেখানে বিভিন্ন ধরনের পাখির পাশাপাশি চিতাবাঘ, কুমিরের মত প্রাণীও ছিল। ষাটের দশকে ঢাকার হাইকোর্টের সামনে ছোট ছোট খাচায় কিছু প্রাণী ও পশু পাখি নিয়ে একটি চিড়িয়াখানা ছিল। সেটিই পরে বর্তমানকালের চিড়িয়াখানায় রূপ নেয়। মিরপুরের এই চিড়িয়াখানা ষাটের দশকে স্থাপিত হলেও ১৯৭৪ সালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। আশির দশকে বিদেশ থেকে বেশ কিছু পশু পাখি আনা হয়। তারপর থেকে বিভিন্ন সময়ে অনেক পশু পাখি এসেছে, মারা গিয়েছে। এভাবেই চলছে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা (সাবেক ঢাকা চিড়িয়াখানা)। ৫০ টাকা টিকিটে চার পাঁচ ঘন্টা কাটানোর মত চমৎকার একটি জায়গা।
আহা! বেশ কতো বছর আগে গেছিলাম।
<3
অসাধারন আপনার পোস্ট এমন সুন্দর পোস্টের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
আপনাকেও ধন্যবাদ!