আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব
শালি ধানের চিঁড়ে।
সেই কবে দাওয়াত দিয়ে রেখেছেন কবি, এখনো তার বাড়ী যাওয়া হয়ে উঠল না। দাওয়াত কবুল করার আগেই কবিসাহেব চিরপ্রস্থান করেছেন, তাঁর বাড়িটি রয়ে গেছে। শালি ধানের চিড়ে আর জলপান কেউ করাবে কিনা তা জানার জন্য হলেও একবার কবি বাড়ীতে যেতে হবে, আর সে বাড়ীতে গেলে চিরশায়িত কবির সাথে সাক্ষাতও হয়ে যাবে।
ফরিদপুরে আগমনের উদ্দেশ্য রথ দেখা নয়, কলা বেচা। অফিসের অফিসের কাজে গতকাল সকালে হাজির হয়েছি এখানে। প্রথম দিন সবসময়ই প্রচন্ড ব্যস্ততায় কাটে, সারাদিন রোজা রাখার ফলে কষ্টও হয়েছে বেশ, ক্লান্তিতে রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শেষরাতে সেহেরী খেয়ে হোটেলের পাশের মসজিদে ফজর নামাজ আদায় করে আবার ঘুমিয়েছি। সকালে ঘুম ভাঙল আটটায়। সাড়ে নটায় অফিস শুরু, তাই আলসেমীভরে গড়িয়ে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ সিদ্ধান্ত – অফিস শুরুর আগেই পল্লী কবির বাড়ী ঘুরে আসবো।
ফরিদপুর শহরে পুরাতন বাস স্ট্যান্ডের একটি হোটেলে আমার অস্থায়ী নিবাস। এখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে কুমার নদের তীরে পল্লী কবি জসীম উদদীনের বাড়ি। জায়গার নাম গোবিন্দপুর যা অম্বিকাপুর উপজেলার অন্তর্গত। রিকশাযোগে কবির বাড়ী পৌছে গেলাম। রাস্তার এক ধারে কুমার নদ, অন্যদিকে কবির বাড়ী। কুমার নদের তীরে বাঁধানো ঘাট। সেই ঘাট নেমে গেছে মাঠে। ফি বছর জানুয়ারী মাসে সেই মাঠে প্রায় মাসব্যাপী জসীম পল্লী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর অবশ্য হতে পারেনি। মেলার আয়োজক কে হবে – এই দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত মেলা বাতিল করতে হয়েছিল। জানা গেল, প্রতিবছর জসীম ফাউন্ডেশন মেলার আয়োজন করে। ২০১৭ সালে জেলা প্রশাসন এবং জসীম ফাউন্ডেশন যৌথভাবে মেলা আয়োজন করেছিল। এ বছর জেলা প্রশাসন এককভাবে আয়োজন করতে চেয়েছিল, শেষ পর্যন্ত মেলার আয়োজনই বন্ধ হলো। স্থানীয়দের মুখের কথা – লিখিত কোন দলিলাদি পাওয়া গেল না।
মাঠের পরেই অবশ্য কুমার নদ। আকারে একটি খালের চেয়ে বড় নয়। পানি সামান্য। মাঠে দুটো এক্সক্যাভেটার রাখা আছে। আর আছে একটি নাম ফলক। ফরিদপুর সদরের এমপি এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন কুমার নদ পুনঃখনন কাজের উদ্বোধন করেছেন, তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে সেই ফলকে। বেকার এক্সক্যাভেটার দেখে বোঝা গেল না – এটা কি পুনঃখননের প্রস্তুতি, নাকি খননসমাপ্তি।
বাড়ির সদর দরজার ডানদিকে উঁচু ভূমিতে কবি আর তার পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের কবর। ডানদিকে একটি দোকান রয়েছে – স্যুভিনির শপ। শুনেছিলাম – টিকেট কেটে বাড়িতে প্রবেশ করতে হয়, কিন্তু সেরকম কোন ব্যবস্থা দেখলাম না, আমার প্রবেশেও কেউ বাধা দিল না। ভেতরে একটি সেমিপাকা ঘরসহ টিনের চৌচালা বাড়ি আছে গোটা চারেক। প্রত্যেক ঘরের সাথেই লেখা আছে – সেই ঘরে কে থাকতেন। বোঝা গেল – এটা কবির পৈতৃক বাড়ি, কবির দাদার ঘরও পাওয়া গেল। প্রায় সবগুলো ঘরেই প্রবেশের ব্যবস্থা আছে। ভেতরে কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র, মাটির তৈরি খেলনা ইত্যাদি। আর রয়েছে প্রচুর ছবি। কবি কোথায় কি করেছেন তার ধারনা পাওয়া যায় ছবি দেখে। নকশী কাঁথা বোধহয় কবির বেশ প্রিয় ছিল – কিছু নকশী কাঁথাও রয়েছে। একটি ঘর রয়েছে যা শুধুমাত্র প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে তৈরী করা হয়েছে। একটি ঘরে পাওয়া গেল ঝগড়ার সময়ে কবিপত্নী মমতাজ বেগমের ছিড়ে ফেলা কবিতার খাতা।
সময় খুবই অল্প, তাই একবারের বেশি নজর কোন দিকেই দেয়া গেল না। একটি ঘরের একাংশ থেকে একটি বাচ্চার পড়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল, বোঝা গেল ওই অংশে কেউ থাকেন। কবির বাড়িকে যাদুঘর হিসেবেই সাজানো হয়েছে। যাদুঘর হিসেবে যথেষ্ট উপাদান রয়েছে এখানে। কিন্তু সম্পূর্ন ব্যবস্থাপনা দেখে সহজেই বোঝা যায় – ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই যাদুঘর তৈরি হয়েছে। যিনি উদ্যোগ নিয়েছেন তার নাম কবির নামের মতই সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, তিনি ড. জামাল আনোয়ার।
কবির পুত্র চারজন – কামাল আনোয়ার, জামাল আনোয়ার, ফিরোজ আনোয়ার এবং খুরশীদ আনোয়ার। জামাল আনোয়ার জার্মানীতে বসবাস করেছেন দীর্ঘদিন। সেখানেই বিয়ে করেছিলেন। সম্ভবত সেই বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। তার বর্তমান স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন বারো/তেরো বছর আগে। পল্লী কবির স্মৃতিকে সংরক্ষণের জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। কবির দুজন কন্যা – একজন হাসনা, অন্যজন আসমা। হাসনার স্বামী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যরিস্টার মওদুদ আহমেদ, আসমার স্বামী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
ঘড়িতে ন’টা বিশ বেজে গেছে বলে বেড়িয়ে আসতে হলো। কবির বাড়ীর পাশেই বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরের উদ্যোগে পল্লী কবি জসীম উদদীন সংগ্রহশালা নির্মান করা হয়েছে। সময়ের অভাবে সেখানে যাওয়া গেল না। রিকশায় উঠে একবার ভেতরের দিকে তাকালাম। কবির লেখা কবিতার দুটি চরণ চোখে পড়ল –
খুব ভোর করে উঠিতে হইবে, সুয্যি উঠারও আগে,
কারেও কবি না দেখিস পায়ের শব্দে কেহ না জাগে।
আবারও আসবো এই বাড়ীতে, তখন আর এই ভুল হবে না!
ফুটনোটঃ পল্লীকবির বাড়িতে আমি নিজেই কিছু ছবি তুলেছিলাম। অজ্ঞাত কারণে কম্পিউটার থেকে সবগুলো ছবিই হারিয়ে গেছে, কোথাও কোন ব্যাকআপও নেই। উপায়ান্তর না দেখে ইন্টারনেট ঘেঁটে ছবি বের করে ব্যবহার করতে হলো। দুঃখিত।