ঘটনাটা মর্মান্তিক!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে অবস্থিত এমবিএ ভবনের নয় তলা থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছেন তানভীর রহমান নামে একজন ইএমবিএ শিক্ষার্থী। আত্মহত্যার বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়, এটি হত্যাকান্ডও হতে পারে, তানভীরের আত্মীয়-স্বজন বলছেন এটি আত্মহত্যাই, কারণ তানভীর বেশ হতাশাগ্রস্থ ছিল এবং বিভিন্ন সময়ে আত্মহত্যার কথা সে বলেছিল। তানভীরের হতাশার কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন সরকারী কোন চাকরী না পাওয়াকে। একটু গভীরে ঢুকলেই জানা যাবে, সেশনজটের কবলে পড়ে সরকারী চাকুরীর উপযুক্ত হতেই বয়সের শেষ সীমায় চলে এসেছিলেন তানভীর, বয়স শেষ হয়ে যাবার পরেই আত্মহননের পথ বেছে নেন তিনি।
সরকারী চাকুরীই জীবনে সফলতার একমাত্র উপায় কিনা, সরকারী চাকুরীতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো উচিত কিনা ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার দাবী রাখে, তাই এখানে কেবল সেশনজট নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলা যায়।
প্রথমেই স্বীকার করে নেয়া উচিত, বাংলাদেশে গত এক দশকে সেশনজট অবস্থার অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। আমার বড় ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছেন দশ বছরে, তখন সেটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া হত। এখন সেটা কমে প্রায় ছয় বছরে দাঁড়িয়েছে। অর্থ্যাৎ, অতিরিক্ত এক বছর, কখনো কখনো সেটা দেড় বা দুই বছর সেশনজটের কারণে নষ্ট হয়। একদশক আগেও সেশনজটের প্রধান কারণগুলোর অন্যতম ছিল ছাত্র রাজনীতি। বর্তমানে প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্ররাজনীতি অনেক সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে, এবং সেশনজটের প্রধান কারণ হিসেবে একে দায়ী করা চলে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট নেই বললেই চলে। এসএসসি, এইচএসসি এবং সমমানের পরীক্ষার সময়সীমা মোটামুটি নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে, ফলে এখানেও সেশনজট তৈরি হবার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তাহলে সেশনজট হচ্ছে কোথায়?
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোতে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা একটি বিশাল অজগরের মত, যে কিনা বিশাল এক হরিণকে আস্ত গিলে খেয়েছে এবং এখন নড়াচড়ার ক্ষমতাটুকুও হারিয়েছে। প্রতিবছর ব্যাঙের ছাতার মত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সংখ্যা বাড়ছে (কলেজের সংখ্যা বাড়ছে আগাছার মত), সে তুলনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধির কোন নজির দেখা যাচ্ছে না। এইচএসসি পাশ করে বের হওয়া বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর কাছে অনার্স ডিগ্রি বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে গজিয়ে উঠা কলেজগুলোতে রয়েছে মানসম্পন্ন শিক্ষক এবং পরিবেশের অভাব। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণের মত যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারছে না জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে এত বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ভর্তি, একাডেমিক, মূল্যায়ন ইত্যাদি কার্যক্রমে স্বাভাবিকের অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে, বাড়ছে সেশনজট।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে যে সেশনজট হয় তার প্রধান কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হওয়ায় তারা এক ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাঠ্যসূচী অনুসারে শিক্ষাদান, মূল্যায়ন ইত্যাদি কার্যক্রমে তারা শিথিলতা প্রদর্শন করেন। এর পাশাপাশি চলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কলেজে পাঠদান, নিজস্ব ক্যারিয়ার তৈরির প্রচেষ্টাসহ অন্যান্য কার্যক্রম। এর পরিণাম ভোগ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, তারা সেশনজটের শিকার হয়ে নানারকম মানসিক অশান্তিতে ভুগেন। চাকরীর বাজারে ঢোকার পর এই অশান্তির মাত্রা কমে না, বরং কয়েকগুণে বৃদ্ধি পায়।
সেশনজটের এই সমস্যার সমাধান দরকার এবং শিক্ষার্থীরা করণীয়ের মধ্যে প্রতিবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। তবে আত্মহত্যা অবশ্যই প্রতিবাদের কোন পন্থা হতে পারে না। আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে শিক্ষার্থীরা সবসময়ই একধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকীর মুখে থাকে। শিক্ষার্থীদের সিজিপিএ, পাশ-ফেল ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষকদের কম বেশি ভূমিকা থাকায় প্রায় সকল শিক্ষার্থীই প্রতিবাদ করতে ভয় পান। এছাড়া আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলো কর্তৃক ব্রান্ডিং এর আশংকা। এসব মাথায় রেখে প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালা এবং ভদ্রতার সীমা না মাড়িয়ে অনুনয় অনুরোধের ছলে মৃদু থেকে মাঝারি কন্ঠে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ চালিয়ে গেলে ধীরে ধীরে, হয়তো এক দেড় দশক সময়ে, অবস্থার উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।
মনে পড়ে, সেশনজ্যাম থেকে বাঁচতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, ক্ষীণ আশা, কোর্স শিক্ষক তা দেখবেন এবং তার মধ্যে দায়িত্ববোধ জেগে উঠবে। লিখেছিলাম,
প্রিয় স্যার বৃন্দ, আমাদের প্রায় গোটা শরীরটাই বেরিয়ে গেছে, এখন আমরা এইট সেমিস্টারে। দয়া করে শরীরের বাকী অংশ, আমাদের লেজটুকু ধরে এভাবে ঘোরাবেন না, লেজটুকুকেও বেরিয়ে যেতে দিন… প্লিজ!
শিক্ষার্থীদের কাজ এটুকুই, বাকীটা নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব এবং তারা যেন দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করে সেজন্য আমরা সকলে প্রার্থনা করতে পারি।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এরকম pathetic একটা নিউজ পড়তে হলো। আর কোনো শিক্ষার্থীকে যেন সেশনজটে পড়তে না হয়।