বাংলাদেশে নির্বাচনের বছর সবসময়ই গোলযোগপূর্ণ, ২০১৩-ও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে রাজনৈতিক গোলযোগের পাশাপাশি বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে ভারতীয় চলচ্চিত্রের আমদানী উদ্যোগ দুর্যোগের মেঘ হিসেবে সবসময় উপস্থিত থেকেছে। এই দুর্যোগপূর্ণ বছরের শেষ মাসে কোন চলচ্চিত্র মুক্তি পায় নি এবং মুক্তির নির্দিষ্ট তারিখ থেকে পিছিয়ে আগামী বছরে নির্বাচন পরবর্তী শান্ত সময়ে ছবি মুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে নির্মাতাগোষ্ঠী। এ বছরে আর কোন ছবি মুক্তি পাবে না ধরে নিয়ে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রসমূহের দিকে ফিরে তাকালে গোটা বছরের একটা চিত্র ফুটে উঠে, এবং, রাজনৈতিক গোলযোগের মাঝেও এই চিত্রের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকানো উচিত। বলা বাহুল্য, এক দশক আগের অবহেলা আর দূর্ণীতির কারণে সৃষ্ট পতিত অবস্থা থেকে উন্নয়নের দিকে বাংলা চলচ্চিত্রের যাত্রাকে শিখর পর্যন্ত পৌছানো নিশ্চিত করতে হলে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রসমূহের বিচার বিশ্লেষন আবশ্যক; বাংলা চলচ্চিত্রের সালতামামি ২০১৩ এক্ষেত্রে কিছুটা সহায়তা করতে পারে।
Table of Contents
বাংলা চলচ্চিত্র ২০১৩: এক নজরে
২০১৩ সালে মোট ৫৩টি বাংলা চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪৮ টি এবং ২০১২ সালে ছিল ৫১টি। মুক্তির তারিখ নির্দিষ্ট করার পরে পিছিয়ে নেয়া চলচ্চিত্রগুলো মুক্তি পেলে মোট মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা বেড়ে কম-বেশী ৫৬-তে দাঁড়াতো। জানুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহে ভালোবাসার বন্ধন মুক্তির মাধ্যমে এ বছরের চলচ্চিত্র যাত্রার শুরু এবং ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ৭১ এর গেরিলা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে। গত বছরের মত এ বছরও সর্বাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছে মিশা সওদাগর, সর্বাধিক চলচ্চিত্রের নায়ক শাকিব খান কিন্তু সর্বাধিক চলচ্চিত্রের নায়িকা মাহি। শাকিব খান অভিনীত মোট আটটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে, সংখ্যার দিক থেকে তার ঠিক পেছনেই আছে গত বছর ‘ভালোবাসার রং’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা বাপ্পী। এ বছর তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ছয়টি। এ বছরের ৫৩টি চলচ্চিত্রের মধ্যে পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু করেছেন দশজন।
এক নজরে এ বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রগুলো হল – ভালোবাসার বন্ধন, টেলিভিশন, জোর করে ভালোবাসা হয় না, দেবদাস, অন্যরকম ভালোবাসা, অন্তর্ধান, পাগল তোর জন্য রে, সীমানাহীন, জীবন নদীর তীরে, আত্মঘাতক, শিরি ফরহাদ, হৃদয়ে ৭১, কষ্ট আমার দুনিয়া, সেই তুমি অনামিকা, দেহরক্ষী, শিখণ্ডী কথা, মাটির পিঞ্জিরা, জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার, জটিল প্রেম, এই তো ভালোবাসা, নিষ্পাপ মুন্না, রোমিও ২০১৩, পোড়ামন, প্রেম প্রেম পাগলামি, তোমার মাঝে আমি, ভালোবাসা আজকাল, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, মাই নেম ইজ খান, কাজলের দিনরাত্রি, এর বেশি ভালোবাসা যায় না, এক পায়ে নূপুর, ইভটিজিং, মৃত্তিকা মায়া, নতুন সাত ভাই চম্পা, ঢাকা টু বোম্বে, রূপগাওয়াল, কিছু আশা কিছু ভালোবাসা, মন তোর জন্য পাগল, তবুও ভালোবাসি, বাংলার পাগলু , উধাও, কুমারী মা, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী, ফুল এন্ড ফাইন্যাল, প্রেমিক নাম্বার ওয়ান, কি প্রেম দেখাইলা, অনিশ্চিত যাত্রা, একই বৃত্তে, আয়না কাহিনী, ভালোবাসা জিন্দাবাদ, ইঞ্চি ইঞ্চি প্রেম, তোমার আছি তোমারই থাকবো, ৭১ এর গেরিলা।
এ সকল চলচ্চিত্রের মধ্যে কোন চলচ্চিত্রগুলো ব্যবসাসফল হয়েছে বা মোটামুটি ব্যবসা করেছে তা জানার জন্য দৈনিক পত্রিকাগুলোর উপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। প্রদর্শক সমিতি এবং প্রেক্ষাগৃহের বরাত দিয়ে একটি দৈনিক জানিয়েছে এ সকল চলচ্চিত্রের মধ্যে ব্যবসা সফল হয়েছে মাত্র ছয়টি চলচ্চিত্র। এগুলো হল এম এ জলিল অনন্তর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, জাকির হোসেন রাজুর পোড়ামন, বদিউল আলম খোকনের মাই নেম ইজ খান এবং নিষ্পাপ মুন্না, ইফতেখার চৌধুরীর দেহরক্ষী এবং সাফি উদ্দিন সাফির পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী। অন্যদিকে মোটামুটি ব্যবসাসফল ছবির তালিকায় স্থান পেয়েছে শাহিন সুমনের অন্যরকম ভালোবাসা, দেবাশীষ বিশ্বাসের ভালোবাসা জিন্দাবাদ, পি এ কাজলের ভালোবাসা আজকাল এবং কাজী হায়াতের ইভটিজিং। কোন চলচ্চিত্র কি পরিমান আয় করেছে তা নিশ্চিতভাবে জানার কোন উপায় নেই এবং এই উপায়হীনতা চলচ্চিত্র পরিবেশন পদ্ধতির সংস্কার এবং বক্সঅফিসের গুরুত্বকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে।
সাইমন সাদিক-মাহি-আরেফিন শুভ
এ বছর পুরাতন এবং তারকা অভিনেতাদের তুলনায় সাইমন সাদিক, আরেফিন শুভ এবং মাহিয়া মাহি আলোচনায় ছিলেন। এ বছর সাইমন সাদিকের মাত্র দুটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। এদের মধ্যে পোড়ামন ছবির সাফল্য তার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত করে কিন্তু অভিনয় নয় বরং তার গুরু জাকির হোসেন রাজু এবং চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার সাথে কৃত আচরণ এবং ফলশ্রুতিতে চুক্তিবদ্ধ একাধিক চলচ্চিত্র থেকে বাদ পড়ার ঘটনায় আলোচনায় আসেন। অন্যদিকে মাহিয়া মাহি মাত্র গত বছর তার যাত্রা শুরু করলেও বছরের শেষের দিকে সর্ব্বোচ্চ সম্মানীর নায়িকা হিসেবে সংবাদে আসেন। এ বছরের সর্বাধিক চলচ্চিত্রের নায়িকা হিসেবেও তার অবস্থান শীর্ষে। মডেলিং থেকে অভিনয়ে আগত আরেফিন শুভ ছবি মুক্তির বেশ আগে থেকেই আলোচনায় ছিলেন। বছরের শেষের দিকে মুক্তিপ্রাপ্ত দুটি চলচ্চিত্রের একটিতে পার্শ্বচরিত্রে এবং অন্যটিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন শুভ। এ বছরে দ্বিতীয় সর্ব্বোচ্চ সংখ্যক ছবির নায়ক হিসেবে বাপ্পীর নাম থাকলেও শাকিব খানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আরেফিন শুভর নামই ঘুরে ফিরে আসছে। তবে সর্ব্বোচ্চ সংখ্যক ছবির নায়ক হবার লড়াইয়ে আরেফিন শুভ অবতীর্ণ না হয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন ভালো অভিনেতার তালিকায় স্থান পাওয়ার চেষ্টা করলে ভালো করবেন।
ডট কমের উত্থান
চলচ্চিত্র ভিত্তিক একাধিক ওয়েবসাইটের উত্থান ২০১৩ সালের একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক। এ সকল ওয়েবসাইটের বেশীরভাগই সীমিত সামর্থ্যে চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক সংবাদ প্রকাশ করছে। পাশাপাশি, চলচ্চিত্র বিষয়ক ব্লগ, রিভিউ, সাক্ষাতকার ইত্যাদি প্রকাশের মাধ্যমে এ সকল ওয়েবপত্রিকা নিজেদের স্থান মজবুত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছর যাত্রা শুরু করলেও এ বছরের মাঝামাঝি নতুন রূপে যাত্রা শুরু করা ঢালিউডকেন্দ্রিক ওয়েবসাইট ঢালিউড২৪ ডট কম এ বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত ডজনখানেক চলচ্চিত্রের ওয়েবপার্টনার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে পেশাদারী মনোভাব সৃষ্টিতে ঢালিউড২৪ ডট কমের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। চলচ্চিত্র নিয়ে ওয়েবভিত্তিক ম্যাগাজিন মুখ ও মুখোশের যাত্রাও শুরু এ বছরে। সংবাদের তুলনায় দেশী বিদেশী সিনেমা সংক্রান্ত সাক্ষাতকার এবং ফিচারকেন্দ্রিক এই ওয়েবজিন ইতোমধ্যেই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের ডাটাবেজ তৈরীর উদ্যোগ নিয়ে এ বছরে যাত্রা শুরু করেছে বাংলা মুভি ডেটাবেজ (বিএমডিবি) নামের ওয়েবসাইট। বাংলা চলচ্চিত্রের সামগ্রিক উন্নতির জন্য এ ধরনের একটি ওয়েবসাইট প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পালন করতে পারে। সীমিত সামর্থ্য এবং প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত এ সকল ওয়েবসাইট বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়নে তখনই পূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে যখন বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মান প্রক্রিয়ার সাথে ইন্টারনেটের গুরুত্বকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন এবং চলচ্চিত্রের দর্শকশ্রেণি নির্মাতাগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগের জন্য এ ধরনের ওয়েবসাইটগুলোকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে আগ্রহী হবে।
ভারতীয় ছবি আমদানী
২০১৩ সালের পুরোটাই ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানীর ঝুঁকির মধ্যে ছিল বাংলাদেশী চলচ্চিত্র শিল্প। এই ঝুঁকির পেছনে প্রধান নিয়ামক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে সদ্য মেয়াদ শেষ হওয়া সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নতির স্বার্থে দেশীয় নির্মাতাদের চাওয়া-পাওয়াকে উপেক্ষা করে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানীর লক্ষ্যে একাধিক গোপন মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। প্রযোজক-পরিচালক সমিতি এই আমদানীর বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঘোষনা দিলেও শেষ পর্যন্ত কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে নি। ঈদে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের পাশাপাশি যমুনা ফিউচার পার্কে অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় সিনেপ্লেক্স ব্লকবাস্টার্স সিনেমায় হিন্দী চলচ্চিত্র ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ মুক্তির প্রচেষ্টাও চালানো হয়েছিল বলে জানা যায়। শেষ মুহুর্তে সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ হল চালু করার কাজ সম্পন্ন করতে না পারায় ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রবেশ ব্যহত হয়। পরবর্তীতে আদালতের সিদ্ধান্তে চারটি হিন্দী চলচ্চিত্র প্রদর্শনের অনুমতি পায়, অভিসার সিনেমাহলে ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘ওয়ান্টেড’ এর পোস্টারও সাঁটানো হয়। আবারও, শেষ মুহুর্তে হাইকোর্টের রিট জারী হওয়ায় কোন ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় নি। তবে, বর্তমানে মুলতবিকৃত মামলার সমাধানের উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট কিছু ভারতীয় চলচ্চিত্র বাংলাদেশে প্রদর্শনের সম্ভাবনা একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না।
নকলের মহোৎসবে ডিজিটাল চলচ্চিত্র
২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রায় সকল চলচ্চিত্রই ডিজিটাল ফরম্যাটে নির্মিত এবং প্রায় সব চলচ্চিত্রই প্রচারণার উদ্দেশ্যে ‘ডিজিটাল’ শব্দকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রসমূহের বেশীরভাগই নকলের অভিযোগে অভিযুক্ত। যে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানীর বিপক্ষে নির্মাতা গোষ্ঠীর অবস্থান সেই ভারতীয় চলচ্চিত্রেরই গল্প থেকে শুরু করে পোস্টার পর্যন্ত নকল করা হচ্ছে। ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র পোড়ামন তামিল ছবি ময়নার অনুকরণে নির্মিত এবং মোটামুটি ব্যবসাসফল ছবির তালিকায় স্থান পাওয়া ভালোবাসা জিন্দাবাদ কলকাতার চ্যালেঞ্জ ছবির গল্পকে নতুনরূপে বিন্যস্ত করে নির্মিত। এ ধরনের ব্যবসায়িক সাফল্য নির্মাতাদের মৌলিক গল্প নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মানে কতটুকু উৎসাহিত করবে সে প্রশ্ন উত্থাপন অত্যন্ত যৌক্তিক। পাশাপাশি এই নকল প্রবণতা প্রতিরোধের জন্য করণীয় কি তাও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
অনুদানের এবং সিনেমাহল-বিহীন চলচ্চিত্র
ভালো ছবি নির্মানের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে চলচ্চিত্র নির্মানে অনুদান প্রদান করা হয়। কিন্তু এই অনুদানের অর্থের পরিমান চলচ্চিত্র নির্মানের জন্য যথেষ্ট না হওয়ার কারণে চলচ্চিত্র নির্মাতাকে বেসরকারী সহযোগিতা গ্রহণ করতে হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এ উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে এ সকল অনুদান নির্ভর চলচ্চিত্রের একমাত্র গন্তব্যস্থল হিসেবে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকেই পাওয়া যাচ্ছে। এ বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত অনুদানের চলচ্চিত্রের মধ্যে গাজী রাকায়েতের ‘মৃত্তিকা মায়া‘ একটি সিনেমাহলে এক সপ্তাহ প্রদর্শিত হলেও মহম্মদ হান্নানের শিখন্ডী কথা, বেলাল আহমেদের অনিশ্চিত যাত্রা এবং কাজী মোর্শেদ এর একই বৃত্তে প্রিমিয়ার শো ব্যতীত প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিতই হয় নি। অনুদানের ছবির পাশাপাশি রয়েছে শুধুমাত্র টিভি পর্দায় মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র সাদেক সিদ্দিকী পরিচালিত হৃদয়ে একাত্তর। অনুদানপ্রাপ্ত এ সকল চলচ্চিত্রের গল্প মৌলিক এবং বৈচিত্রময়, চলচ্চিত্রে দর্শকের বড় অংশও এ ধরনের চলচ্চিত্রের প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে বিমাতাসুলভ আচরণ করেন। অথচ চলচ্চিত্রের সাথে বড় পর্দার সম্পর্ক। ছোটপর্দায় বিজ্ঞাপনের ভীড়ে যে চলচ্চিত্র মুক্তি দেয়া ছাড়া নির্মাতার অন্য কোন উপায় থাকে না সেই চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোক্তাদেরও এক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া উচিত।
পুরাতনদের খোঁজখবর
গত বছরের সর্বাধিক চলচ্চিত্রের নায়িকা ছিলেন সাহারা। এ বছর তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা তিনটি, কিন্তু মুক্তির প্রতিক্ষায় রয়েছে মাত্র একটি ছবি। সে হিসেবে আগামী বছরই চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিতে পারেন সাহারা। পূর্ণিমা চলচ্চিত্র থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন আগেই। এ বছরে তার অভিনীত মাত্র একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। নতুন কোন ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন না তিনি। শাবনূরের একাধিক চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেও অতি সম্প্রতি বিয়ে এবং সন্তানের খবর প্রকাশ করেছেন তিনি, ফলে শীঘ্রই চলচ্চিত্রে ফিরবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। হারিয়ে যেতে যেতে ব্যাপকভাবে ফিরে এসেছেন অপু বিশ্বাস। প্রায় চারমাস চলচ্চিত্রজগতের আড়ালে ছিলেন তিনি, ফিরেছেন স্লিম হয়ে, আরও সুন্দর হয়ে। ফলে পরপর অনেকগুলো চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন অপু। নায়কদের মাঝে রুবেল, আমিন খান এবং ডিপজল অভিনীত কোন চলচ্চিত্র মুক্তি পায় নি। এছাড়া অমিত হাসান নায়ক থেকে খলনায়ক চরিত্রে বেশী উপস্থিত হচ্ছেন, ওমর সানী আবারও নায়ক চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ওজন কমিয়েছেন। নতুনদের আগমনে পুরাতনরা বিদায় নেবে স্বাভাবিক, তবে বিদায়ের পূর্বে নতুন পুরাতনের সংমিশ্রনে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা বিনিময়ের কোন সুযোগ থাকলে সেটা বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
পিএ কাজল-জাজ মাল্টিমিডিয়া
২০১৩ সালে বাংলা চলচ্চিত্রে মুখরোচক আলোচনার জন্ম দিয়েছেন পরিচালক পি এ কাজল। নায়িকা বানিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, এবং একাধিক নায়িকা-পরিচালকের নাম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে, নবাগত এক অভিনেত্রীকে কুপ্রস্তাব দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হন পি এ কাজল। প্রথমে অস্বীকার করলেও নায়িকা অমৃতা পিএ কাজলের সাথে ফেসবুক চ্যাটিং প্রকাশ করলে পি এ কাজল চিকিৎসার অজুহাতে ভারতে পালিয়ে যান। ভারতে থেকে দোষ স্বীকার করলে পরিচালক সমিতি থেকে তাকে আজীবন নিষিদ্ধ করার কথা শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে কোন অগ্রগতি জানা যায় নি। অন্যদিকে, প্রায় দুই শতাধিক সিনেমাহলকে ডিজিটালাইজ করার উদ্যোগ গ্রহনকারী চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া নানা কারণে আলোচনায় আসেন। অভিনেতা সাইমন সাদিক সংক্রান্ত ঘটনা ছাড়াও চলচ্চিত্র প্রদর্শনে প্রযোজকদের উপর প্রভাব খাটানো এবং ছিনতাইয়ের অভিযোগে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এই প্রতিষ্ঠানটি। চলচ্চিত্রে যখন নতুনদের পদার্পণ ঘটছে তখন এ ধরনের ঘটনাগুলো অবশ্যই চলচ্চিত্রের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্থ করে। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে চলচ্চিত্রাঙ্গনের পরিবেশ বজায় রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে।
সব মিলিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ২০১৩ সাল ভালো না মন্দ – সে প্রশ্নের উত্তরে আশাব্যাঞ্জক খুব বেশী কিছু বলা যায় না। এ বছর পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী, ইভটিজিং বা উধাও এর মত চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে যা নতুন বাংলা চলচ্চিত্র সম্পর্কে আশাবাদী হতে উৎসাহ দেয়। অপরদিকে, নতুন সাত ভাই চম্পা বা এই তো ভালোবাসার মত চলচ্চিত্রও মুক্তি পেয়েছে যা ডিজিটাল চলচ্চিত্রের সুবিধাকে ব্যবহার করে দর্শককে প্রতারিত করেছে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তি অবশ্যই প্রয়োজনীয়, কিন্তু অদক্ষ এবং যথেচ্ছ ব্যবহার এই প্রয়োজনীয়তাকে ছাপিয়ে গেলে উন্নয়ন অসম্ভব হয়ে যায়। নায়িকার শরীরকে পর্দায় উপস্থাপনের চেয়ে গল্প আর অভিনয়গুণ নিশ্চিত করার দিকে মেধা প্রয়োগ করার ব্যাপারে নির্মাতাদের আগ্রহী হওয়া উচিত। অন্যদিকে, চলচ্চিত্রের মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার বা এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। ডিজিটাল চলচ্চিত্রের নামে মানহীন চলচ্চিত্র নির্মান গোটা চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্থ করে। দায়িত্ব আছে দর্শকগোষ্ঠিরও। নিম্নমানের এবং নকল ছবির বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থান, ভালো ছবির প্রসারে প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দর্শন এবং ব্যক্তিগত তৃপ্তির উপরে সামগ্রিক শিল্পের উন্নতি এবং দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশকে গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে দর্শকশ্রেণি তার দায়িত্ব পালন করতে পারে।
চলচ্চিত্রে পতন হঠাৎ করে হয় নি, উন্নতিও হবে ধীরে ধীরে। দর্শকের এই প্রত্যাশা যেন ছুঁয়ে যায় নির্মাতাগোষ্ঠীকেও। ২০১৪ সাল হোক শঙ্কামুক্তির বছর। গুড লাক বাংলাদেশী সিনেমা, গুড লাক বাংলাদেশ।
নোট:
১. তথ্যে কোনরূপ অসঙ্গতি থাকলে সেটা অনিচ্ছাকৃত। সংশোধনের উদ্দেশ্যে দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য আহবান জানাচ্ছি।
২. আন্ডারলাইন্ড অংশে তথ্য বিভ্রাট হতে পারে, নিশ্চিত করা যায় নি।
৩. চলচ্চিত্র সংক্রান্ত সকল তথ্যের কৃতজ্ঞতা বাংলা মুভি ডেটাবেজ এর প্রতি।
৪. বিনা অনুমতিতে এই পোস্ট কোথাও প্রকাশ না করার অনুরোধ।