ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুমে তখন ক্লাস চলছে। দরজা খুলে ছেলেটি ঢুকে পড়ল, তার হাতে গুলিভর্তি অটোমেটিক রাইফেল। প্রথমে ছেলে এবং মেয়েদের আলাদা করল, তারপর ছেলেদেরকে ক্লাসরুম থেকে বের করে দিল এবং অটোমেটিক রাইফেল তাক করে গুলি চালিয়ে দিল দাড়িয়ে থাকা মেয়েদের উপর। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে করিডোর, ক্যাফেটেরিয়া এবং অন্যান্য ক্লাসরুমে গুলি চালালো সে। সব মিলিয়ে বিশ মিনিট। এর মাঝে গুলিতে মারা গেল চৌদ্দজন, বেশীরভাগই মেয়ে, আহত হল আরও চৌদ্দজন। ঘটনার সমাপ্তি ঘটল যখন ছেলেটি নিজের কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করল। ঘটনাস্থল কানাডার কুইবেকে মন্ট্রিলে অবস্থিত ইকোল পলিটেকনিক, সময় ১৯৮৯ সালের ৬ ডিসেম্বর। মন্ট্রিল ম্যাসাকার নামে পরিচিত এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে ২০০৯ সালে তার নাম ‘পলিটেকনিক’।
‘পলিটেকনিক’ নির্দিষ্টভাবে মন্ট্রিল ম্যাসাকারকে তুলে ধরলেও এই ধরনের ঘটনা কম না, এবং এই ধরনের ম্যাড-কিলিং নিয়ে সিনেমাও অনেকগুলো। প্রতি দুই-তিনবছরে একবার করে প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে এ ধরনের ঘটনা ঘটে, একজন বা দুইজন ব্যক্তি স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বা বাসে আক্রমন চালিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটায় এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আক্রমণকারী আত্মহ
ত্যা করেন বা প্রতিরক্ষাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। আক্রমনকারী ব্যক্তি বেশীরভাগ সময়েই মানসিক বিকারগ্রস্থ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হন, তবে ‘পলিটেকনিক’ সিনেমায় হত্যাকারী তার সুইসাইড নোটে নিজেকে ‘র্যাশনাল ইন্ডিভিজ্যুয়াল’ হিসেবে দাবী করে এই কিলিং এর কারণ সম্পর্কেও বর্ণনা করেছে। ফেমিনিস্ট বা নারীবাদীদের প্রতি বিদ্বেষবশতঃ এই হত্যাযজ্ঞ চালায় ছেলেটি এবং তার নোটে বলে,
I have always been enraged by feminists. They cling to women’s benefits, like cheap insurance, maternity leave, preventative leave, while seizing for themselves those of men. … They are so opportunistic that they never fail to profit from the knowledge accumulated by men through the ages.
সিনেমায় শুধুমাত্র এই ঘটনাকে উপস্থাপন করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তিন ব্যক্তি – একজন হত্যাকারী ‘দি কিলার’, একজন নারী শিক্ষার্থী ভেলেরী এবং একজন পুরুষ শিক্ষার্থী জ্যঁ ফ্রসোঁ-র দৃষ্টিকোণ থেকে। পরিচালক বেশ সচেতনভাবেই তার কোন বক্তব্য প্রকাশ করার চেষ্টা করেন নি, কোন এক বিশেষ চরিত্রের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণও করেন নি। পুরো চলচ্চিত্রটি সাদাকালো, এর কারণ হিসেবে ভায়োলেন্স অংশটুকু কম উপস্থাপন করার পাশাপাশি অতীতের ঘটনাকে তুলে ধরাও গুরুত্বপূর্ণ। সাদাকালোয় চিত্রায়িত বলে চলচ্চিত্রের সৌন্দর্য্য ভিন্নমাত্রায় বিকশিত, চমৎকার কিছু শট এবং ক্যামেরার কাজ চোখে পড়বে। চলচ্চিত্রটির পরিচালক Denis Villeneuve ২০১০ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র Incendies পরিচালনা করে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন। (Incendies – দারাশিকো’র ব্লগ)
১৯৮৯ সালে মন্ট্রিলে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা পরবর্তীতে বেশ আলোচনার জন্ম দেয় – বাস্তবের হত্যাকারীর পকেট থেকে প্রাপ্ত সুইসাইড নোট এবং দুটি চিঠি ফাঁস হয়ে গেলে নারীবাদীদের প্রতি হত্যাকারীর ঘৃণা এবং পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়। পরবর্তী বছর থেকে এই দিনকে National Day of Remembrance and Action on Violence Against Women হিসেবে উদযাপন করা হয়।
ক্যাম্পাস ম্যাসাকারের ঘটনা জানতে চাইলে ‘পলিটেকনিক’ চলচ্চিত্র দর্শনই যথেষ্ট তবে এই ধরনের ঘটনার পেছনের কারণগুলো সম্পর্কে স্টাডি করতে চাইলে ‘ফারেনহাইন ৯/১১’ খ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মাইকেল মুর পরিচালিত ডকিউমেন্টারি ‘বৌলিং ফর কলম্বাইন’ অবশ্যই দেখতে হবে। ‘পলিটেকনিক’ এর প্রায় সাত বছর আগে ২০০২ সালে নির্মিত ডকিউমেন্টারী ‘বৌলিং ফর কলম্বাইন’ চলচ্চিত্রে ১৯৯৯ সালে ঘটে যাওয়া কলম্বাইন হাই স্কুল ম্যাসাকারকে কেন্দ্র করে এই ধরনের ঘটনার ইতিহাস, কারণ এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। এপ্রিল মাসে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনায় দুজন শিক্ষার্থী তাদের স্কুলের বারোজন শিক্ষার্থী এবং একজন শিক্ষককে হত্যা করে, ২৪ জনকে আহত করে এবং সবশেষে দুজনেই আত্মহত্যা করে। আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতা, আক্রমনাত্মক মনোভাবের কারণ, দায়ী ব্যক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়কে তুলে ধরা হয় এই চলচ্চিত্রে। মাইকেল মুরের বাকী সব চলচ্চিত্রের মত এখানেও মাইকেল মুর ক্যামেরার সামনে প্রধান চরিত্র এবং বেশ সাহসী ঘটনাবলী এবং প্রসঙ্গকে তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটার মত পরিস্থিতি এখনো তৈরী হয় নি, হওয়ার সম্ভাবনা খুব প্রবল বলে মনেও হচ্ছে না। তবে ২০০৬-০৭ সালের দিকে নটরডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী কর্তৃক আরও এক শিক্ষার্থীকে ছুড়িকাঘাতে হত্যা করার ঘটনা কিংবা স্বয়ং লেখকের প্রত্যক্ষদর্শীতায় ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত একই ছাত্রীকে কেন্দ্র করে দুজন ছাত্রের কোন্দল যা পরবর্তীতে সূর্যসেন হল, মহসীন হল, জিয়া হল, বঙ্গবন্ধু হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়ার ঘটনাকে একদম উড়িয়ে দেয়াও চলে না। সমাজবিজ্ঞানীরা এই সকল ঘটনা সম্পর্কে চিন্তা করতে যেন আগ্রহী হয়ে উঠে, চলচ্চিত্র নির্মাতারা সে সুযোগ তৈরী করে দিতে পারেন। গবেষনা হোক বা না হোক, এরকম ঘটনা যেন না ঘটে সেই প্রত্যাশা করতে বাধা নেই।
তথ্যসূত্র:
১. পলিটেকনিক – উইকিপিডিয়া
২. ইকোল পলিটেকনিক ম্যাসকার – উইকিপিডিয়া
৩. বৌলিং ফর কলম্বাইন – উইকিপিডিয়া
৪. কলম্বাইন হাইস্কুল ম্যাসাকার – উইকিপিডিয়া