বাংলাদেশে হলিউডের সিনেমা জনপ্রিয় করে তুলতে যে কজন অভিনেতা ভূমিকা রেখেছেন (পরোক্ষভাবে) তার মধ্য ব্রুস লি’র নাম তালিকার প্রথম দিকে থাকবে। মার্শাল আর্ট শব্দটার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যই যেন ব্রুস লি’র মুভিগুলো তৈরী। সিনেমাগুলো দেখতে দেখতে হয়তো ব্রুস লি’র গুরুর কথা মনে হতে পারে – কে মার্শাল আর্ট শিখিয়েছিল ব্রুস লি-কে? ইপ মান।
এই ভদ্রলোকের জীবনী ভিত্তিক এই সিনেমার দুটো পর্ব। প্রথম পর্বের কাহিনীর পটভূমিকা ১৯৩০ এর দশক। অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল ইপ মান বন্ধুত্বমূলক আড্ডা, লড়াই আর সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে জীবন যাপন করতো। পরিবারে তার স্ত্রী ও একটি ছেলে। ইপ মানের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য মাস্টাররা যখন মার্শাল আর্ট ক্লাব খুলে প্রশিক্ষন দিচ্ছে, ইপ তখন তা করে নি, আর্থিক স্বচ্ছলতা তাকে এই প্রয়োজনের দিকে তাড়িত করে নি। কিন্তু এই অবস্থাই পরিবর্তিত হয়ে গেল ১৯৩৭ সালে জাপান যখন চীন আক্রমন করে দখল করে নিল (Second Sino-Japanese War)।
সব হারিয়ে ইপ মানের অবস্থা এতটাই খারাপ হলো যে তাকে কুলির জীবন শুরু করতে হল। জাপানিজ জেনারেল মিউরা ও তার সৈন্যরা মার্শাল আর্টের লড়াইয়ের মাধ্যমে বিনোদনের ব্যবস্থা করতো, চোখ পড়ে গেল ইপ মানের দিকে। লড়াইয়ের আয়োজন হল। একদিকে জেনারেল মিউরা, আরেকদিকে ইপ। একদিকে জাপান, আরেকদিকে চীন।
২০০৯ সালে এই সিরিজের এর প্রথম পর্ব মুক্তি পায়। পরিচালকের নাম উইলসন ইপ, নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ডনি ইয়েন। হংকং এর এই সিনেমা মার্শাল আর্ট সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টে দেবে। মার্শাল আর্ট এখানে আক্রমনের অস্ত্র নয়, নিজেকে শুধু রক্ষা করার অস্ত্রও নয়, মার্শাল আর্ট এখানে বিনয়ের প্রকাশ ভঙ্গী, মার্শাল আর্ট এখানে আঘাতের মাধ্যমে দুর্বিনীত আচরনকে অবদমন করে, মার্শাল আর্ট দক্ষ ব্যক্তির মহত্ব তুলে ধরে।
ইপ মান সিনেমার সাথে খুব মিল পাওয়া যাবে হলিউডের সিনেমা রন হাওয়ার্ড পরিচালিত সিনডারেলা ম্যান। ইপ মানের জায়গায় এখানে আছে জেমস ব্র্যাডক। সময়কাল মোটামুটি একই। আমেরিকায় যখন মহামন্দার দুরাবস্থা, চীনে তখন জাপানের আগ্রাসনে একই দুর্দশাগ্রস্থ সময় চলছে। ইপ মান আর জেমস ব্র্যাডক দুজনেই দারিদ্র্যে কষাঘাতে কুলিগিরির মত কাজে জড়িয়ে পড়ে তারপর আবার তাদের যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে উঠে আসে। দুই সিনেমাতেই, তাদের স্ত্রী তাদের জন্য প্রচন্ড প্রেরণাদায়ক উপাদান।
কিন্তু ইপ মান যেদিক থেকে এগিয়ে তা হল মার্শাল আর্টের সিনেমা থেকে এটি হয়ে উঠে জাতীয়তাবাদের পরিচায়ক সিনেমা। জেনারেল মিউরার পরাজয় যেন জাপানের পরাজয় চীনের কাছে, ঠিক যেমনি বাংলাদেশী সিনেমা ‘জাগো’ তে ত্রিপুরা একাদশের পরাজয় মানে বাংলাদেশের কাছে আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন প্রতিবেশী দেশ ভারতের পরাজয়।
এই একই জাতীয়তাবাদ ফুটে উঠে ইপ মানের দ্বিতীয় পর্বেও। ২০১০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমার প্রেক্ষাপট ১৯৫০ এর দশক। ইপ মান তার শহর ফশান থেকে হংকং এ পরিবার সহ স্থানান্তরিত হয়েছেন, তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। আর্থিক দুর্দশাগ্রস্থ ইপ মান নানা রকম প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে একটি মার্শাল আর্ট স্কুল খুলতে সক্ষম হয় কিন্তু ছাত্র সংগ্রহে ব্যর্থ হয়। যা কিছু পাওয়া যায় তাদের সম্মিলিত অর্থে পরিবার চালানো সম্ভব নয়।
কিন্তু একই সময়ে ব্রিটিশ শাসিত হংকং এর দুর্নীতিগ্রস্থ এক পুলিশ সুপারের কারসাজিতে অন্ধ জাতীয়তাবোধে আক্রান্ত ব্রিটিশ বক্সার দ্য টুইস্টার খ্যাত টাইলর মিলো হংকং এর মার্শাল আর্ট শিক্ষার্থীদের অপমান করে, অন্যান্য মাস্টারদের গুরু হাং-কে লড়াইয়ে হারায়। এই বিজয়ে গর্বে অন্ধ হয়ে যাওয়া দ্য টুইস্টারের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ন হয় ইপ মান। লড়াই হয় ইপ মান আর দ্য টুইস্টারে মধ্যে, লড়াই হয় বক্সিং আর মার্শাল আর্টের মধ্যে, লড়াই হয় চীন আর ব্রিটেনের মধ্যে।
প্রথম পর্বের তুলনায় দ্বিতীয় পর্ব অনেক বেশী ইপ মানের দক্ষতা ভিত্তিক। বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ইপ মানের শ্রেষ্ঠত্ব উঠে এসেছে। দুই সিনেমায়ই ইপ মানের বিনয় চমৎকার ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। মার্শাল আর্ট মানুষকে বিনয়ী করে – সেই শিক্ষারই একটা উদ্ধাহরণ ইপ মান নিজে। কারিগরী দিক থেকে দেখতে গেলে ইপ মান সিনেমার দুটো পর্বই অসাধারণ রকম সফল। ৭০/৮০ বছর আগের চীনকে তুলে ধরতে খুব যত্ন নেয়া হয়েছে। কতটুকু সফল হয়েছে তা বাংলাদেশে বসে বোঝা সম্ভব নয় হয়তো, কিন্তু দর্শকের দৃষ্টিতে তা অবশ্যই নিখুঁত। সিনেমাটোগ্রাফি চোখে লাগবার মত, আর সম্পাদনা এক কথায় অসাধারণ।
হলিউডের সিনেমার মত এখানে স্টান্ট এবং এডিটিং ও ক্যামেরার কারসাজি অনেক কম। প্রতিটি লড়াই প্রচন্ড উত্তেজনাকর, উপভোগ্য। দ্বিতীয় পর্বে একজন বক্সিং গ্লভস পরিহিত বক্সারের বিপরীতে খালি হাতে একজন মার্শাল আর্ট মাস্টারকে কিছুটা বেমানান মনে হতে পারে, কিন্তু লড়াইটাও এই কারণে অনেক বেশী সফল। ইপ ম্যান চরিত্রে ডনি ইয়েন এর অভিনয় নি:সন্দেহে প্রশংসনীয়। তার মুচকি হাসি আর বিনীত ভঙ্গি অবশ্যই সত্যিকারের ইপ ম্যান সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ তৈরী করে। মার্শাল আর্টে তার সত্যিকারের যোগ্যতাও স্পষ্ট হয় অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে অভিনয়ের মাধ্যমে।
ইপ ম্যানের জীবনী ভিত্তিক নির্মিত সিনেমা হলেও একে বায়োগ্রাফি না বলে সেমি বায়োগ্রাফি বলা হচ্ছে। অত্যন্ত ব্যবসা সফল এই দুটো সিনেমার তথ্যগত বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঐতিহাসিকরা। তারা বলছেন, ইপ ম্যান বাস্তবে কয়লার কুলি হিসেবে কাজ করেন নি কখনো, পেশা হিসেবেও কিছু তথ্য ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সে যাই হোক, ইপ ম্যান সিনেমাটি নি:সন্দেহে মার্শাল আর্টের একটি বিশেষ ধারার বিখ্যাত প্রশিক্ষককে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের মার্শাল আর্ট প্রেমিরা সিনেমা থেকে বক্তব্যটুকু নিজেদের মধ্যে ধারন করতে পারলে পৃথিবীটা আরও সুন্দর হয়ে উপস্থাপিত হবে।
ব্রুস লি-র মাস্টার হলেও দুই পর্বের কোথাও ব্রুস লির উপস্থিতি নেই। প্রথম পর্বের শেষে জানানো হয়েছিল ব্রুস লি তার ছাত্র ছিলেন। দ্বিতীয় পর্বের শেষে আমরা দেখতে পাই, ছোট একটি ছেলে ইপ ম্যানের শিক্ষার্থী হবার আশায় তার কাছে উপস্থিত হয়, ইপ ম্যান তাকে আরেকটু বড় হওয়ার পর আসতে বলেন। ছেলেটির নাম ব্রুস লি।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়
🙂 চালিয়ে যান।
চাক্কা কৈ?
১১ নম্বর বাস ই সই তাহলে!
ভালো লেগেছে। আশ্চর্য হলেও সত্যি আজ আবারও সিনেমা দু’টি দেখলাম।
আর বরাবরের মত সিনেমা নিয়ে আপনার লেখা পারফেক্ট শট 🙂
পারফেক্ট শট। হা হা হা । ইদানিং পাঠকরা আমার প্রচুর ভুল ধরিয়ে দিচ্ছে। এই হারে ধরিয়ে দিতে থাকলে বছর খানেক পরেই লেখা বন্ধ করে দিতে হবে। টেনশনে আছি 🙁
ভালো থাকুন আসিফ ইকবাল 🙂
ইপম্যান দেখা হয়ে উঠলোনা 🙁
দেখাটা ফরয হয়ে গেছে। এবার দেখে ফেলবোই
ড্রামা সিনেমার মত খুব বক্তব্য নির্ভর সিনেমার হয়তো নয়, কিন্তু ভালো লাগবে । বিশেষ করে স্পোটর্স মুভিগুলার মতই উপভোগ্য সিনেমা।
রুশো ভাই জীবনে চরম ১টা মুভি মিস করছেন !!!!!!!!!!
দেইখা ফেলেন আমার খুব খুব খুব প্রিয় ১ টা মুভি………………।।
Ip man to Hong kong r film..apni likhechen Korean film..
ওহ তাই তো। আমি কোরিয়ান মনে করে দেখলাম। ঠিক করে দিচ্ছি।
অনেক ধন্যবাদ সাইমন 🙂
ইপ ম্যান মুভিকে আমি এতোদিন আইপি ম্যান বলতাম ,এই গত পরশু জানলাম যে এটাকে ইপ ম্যান বলে।
এইটার দুই নং পার্ট ও আছে নাকি ,দেখতে হবে , এক দেখেছি।
মুভির ইপম্যান আর অরিজিলান দুই জনের ছবি দেখি প্রায় একই 🙂 🙂
আমার কাছে আছে তবে দেখা হয় নাই।
কয়েকদিন আগেও এক বন্ধু এ মুভির কথা বলতেছিল।
ইনশাল্লাহ দেখে ফেলব।
রিভিউয়ের জন্য ধন্যবাদ।
চাইনিজ কুংফুর মুভিগুলো আমার কাছে বরাবরই কোনো রকম কাহিনী ছাড়া অর্থহীন “হাইক হুইক” ছাড়া বিশেষ কিছু মনে হত না। তাই অনেক দিন পিসিতে থাকা সত্ত্বেও ইপম্যান মুভি দুটা না দেখে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু কুংফু কারাতের মুভি যে এত বেশি টাচ করতে পারে তা এই দুটা ছবি না দেখলে কখনোই বোঝা যাবে। সবার প্রতি দেখার অনুরোধ রইল।
http://www.imdb.com/title/tt1220719/
http://www.imdb.com/title/tt1386932/
http://www.imdb.com/title/tt1641638/
ইপ ম্যান নামে এই তিনটি মুভি পেলাম। কিন্তু আপনি বললেন দুটো পার্ট আছে। তাহলে আরেকটি সম্পর্কে একটু বলেন।
http://www.imdb.com/title/tt1220719/
http://www.imdb.com/title/tt1386932/
এই দুটো সিনেমা ডুয়োলজির পার্ট। একই পরিচালক একই অভিনেতার। তৃতীয় যেটা The Legend Is Born: Ip Man এটা ভিন্ন পরিচালকের, যদিও কাহিনী একই ব্যক্তিকে নিয়ে। তবে যতটুকু জানি এই তৃতীয় সিনেমাটা ইপ মানের যৌবন, স্ত্রীর সাথে পরিচয় ইত্যাদি তুলে ধরেছে।
ইপ মানকে বিখ্যাত ফিল্মমেকার ওং কার ওয়াই-ও একটা সিনেমা বানাচ্ছেন শোনা যায়। ডুয়োলজি নির্মানের সময় এই নিয়ে বেশ ঝামেলাও হয়েছিল। ওটার নাম সম্ভবত দ্য গ্রান্ডমাস্টার, তবে মুক্তি পেয়েছে কিনা জানা নেই।
ভালো থাকুন কার্জন 🙂
প্রথমটা দেখেছি গত সপ্তাহে। অসাধারণ একটা মুভি। দ্বিতীয়টাও খুব শীঘ্রই দেখে ফেলব। কিন্তু প্রথমটাতে ইপ ম্যানের একা দশজন জাপানিজের সাথে কুংফু করাটা অবিশ্বাস্য (ড্রামাটিক) লেগেছে। এটার কি কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে? এসব কারণেই সম্ভবত এটাকে সেমি-বায়োগ্রাফিকাল বলা হচ্ছে।
Bruce Lee, My Brother দেখে ফেলুন 🙂
http://www.imdb.com/title/tt1482989/
ধন্যবাদ ভাই , লিখার জন্য । এতদিন পড়ে আমার প্রিয় ১ টা মুভি নিয়ে প্রিয় ১ টা লিখা পেলাম । ভালো থাকবেন ।
ভালো থাকবো 🙂
তুমিও থোকো 🙂
আমার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ মুভিগুলোর একটা। মার্শাল আর্টের প্রতি শ্রদ্ধা অনেকগুন বেড়ে গেছে মুভিটা দেখে। রিভিউ এর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
দারাশিকো’র ব্লগে স্বাগতম স্বপ্নবাজ 🙂
আপনাকেও ধন্যবাদ, ঈদের শুভেচ্ছা এবং আবার আসার আমন্ত্রন 🙂
1st,2nd,3rd-3ta part i khub bhalo lagche…………..Akhon Opekkhay achi 2013 er IP Man #D er jonno……..oita aro chorom hobe 😀
Sorry “#D” er jaygay 3D hobe
3D ভার্সন সাধারণ পর্দায় ভালো লাগবে কি? এখন দেখছি ঘরে ঘরে থ্রিডি টিভি দরকার হবে।
ধন্যবাদ জয় 🙂
ইপ ম্যান-১ দেখলাম। মুভিতে জাতীয়তাবাদ কিভাবে বিনয়ের সাথে তুলে আনতে হয় এটা মনে হয় তার ক্লাসিক উদাহরন। হলিউডের ”আমেরিকা গ্রেট” টাইপের মুভি বানানিয়া ডিরেক্টর ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রকার সবারই এই মুভি থেকে অনেক কিছু শিখতে হবে।
হক কথা। ইপম্যানের মত এরকম জাতীয়তাবাদ পাওয়া যায় বডিগার্ডস অ্যান্ড অ্যাসাসিন্স সিনেমার মধ্যে।
মুভিটা “দেখবো, দেখবো” করে দেখা হয়ে উঠছিল না।
রিভিউ চমৎকার লেগেছে।
এখন আর না দেখে পারা যাবে না!
😀
হা হা ।
কুইক দেখে ফেলুন। ভালো ছবি বেশীদিন ফেলে রাখতে নেই 😉
ভালো থাকুন নিলয় 🙂
ইপ ম্যান 1,2 এর পরে এই সিরিজের 3 নং পর্ব না হয়ে অন্য পর্ব কেন হল ?
অন্য সবার মতন আমিও এই মুভিটা দেখি দেখি করে অবশেষে একদিন অন্যকিছু না পেয়ে দেখে ফেলি।মুভি শেষে আমি সিম্পলি ওয়াও!!
এরপর থেকেই আমি মার্শাল আর্ট মুভির চরম ভক্ত। আর ডনি ইয়েন এর সব মুভি দেখা হয়ে গেছে।