মার্টিন স্করসেইজির সাক্ষাৎকার : “ট্যাক্সি ড্রাইভার নারীবাদী চলচ্চিত্র”

মার্টিন স্করসেইজি


মার্টিন স্করসেইজি, আমেরিকান চলচিত্রের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম উল্লেখযোগ্য মুভি “ট্যা
ক্সি ড্রাইভার” মুক্তির আগে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন পুলিৎজার বিজয়ী একমাত্র চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্টকে। আমার খুব পছন্দের সেই সাক্ষাৎকারের কিছু চুম্বক অংশ আজ অনুবাদ করলাম।

সাক্ষাৎকারের সময়কাল: মার্চ ৭, ১৯৭৬।

১৯৬৯ সালে যখন মার্টিন স্করসেইজির সাথে আমার প্রথম দেখা হয়, তখন সে Woodstock চলচিত্রে সম্পাদনার কাজ করছিলো। মার্টিন ছিলো আমার দেখা অন্যতম নিবেদিতপ্রাণ এক ব্যক্তি। এক গোছানো কিন্তু নার্ভাস যুবক, যে কিনা একটিমাত্র চলচ্চিত্র আর বড় পরিচালক হবার স্বপ্ন নিয়ে হলিউডে বিচরণ করছে। আর এই স্বপ্নটিকে সত্যি করতে তার পাঁচ বছর লেগেছিলো।

আগামী শুক্রবার মুক্তি পাবে তার পরবর্তী চলচ্চিত্র Taxi Driver। সেটা নিয়ে কথা বলতেই গত সপ্তাহে শিকোগোতে এক দুপুরে আমরা আড্ডা দিলাম।

এবার্ট: Taxi Driver সম্পর্কে বলুন।

মার্টিন স্করসেইজি: অতিরিক্ত হিংস্রতার জন্য অনেকেই একে সুবিধাকামী চলচ্চিত্র বলছেন। হায় ঈশ্বর! এটি বানাতে গিয়ে আমি প্রায় নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার চলচ্চিত্রগুলো কখনোই খুব বেশি পয়সা কামায়নি। বর্তমানে আমি আমার পরবর্তী চলচ্চিত্রের অর্থের উপর নির্ভর করে চলছি।

আমি আর শ্রেডার (Taxi Driver-এর চিত্রনাট্যকার) চিত্রনাট্যটি নিউ ইয়র্কের কিছু মিডিয়া ব্যক্তিত্বকে দেখাই।তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছিলো, তারা বুঝি আমাদের ফাঁসিতে ঝোলাবেন। এক আতেঁল তো বলে বসলেন, “এতোটা সাফল্যের পর, আমি নিজেই নিজের বারোটা বাজাতে চাইছি কেন!”। আরে, আমি তো Taxi Driver এর কাজ তখন শুরুও করিনি।

এবার্ট: ট্রাভিস সম্পর্কে আপনি আমাদের তেমন কিছুই জানাননি। সে যেন শূণ্য থেকে এসেছে, নিউ ইয়র্কের এক সাধারণ ট্যাক্সি চালক। পরিশেষে হঠাৎ করেই আমরা আবিষ্কার করি, গোড়া থেকেই তার মনে ক্ষোভ আর হিংস্রতা দানা বেঁধে উঠছিলো…

মার্টিন স্করসেইজি: এবং সে কিন্তু বরাবর যেখানে ভায়োলেন্সের সূত্রপাত, সেখানেই ফিরে যচ্ছিলো। এক সমালোচক আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, ফোর্টি সেকেন্ড স্ট্রীটকে নরকের রূপক হিসেবে এতবার ব্যবহার করা যৌক্তিক কিনা? কিন্তু আদতে এটাই নরকের ধর্ম – নরক থেমে থাকে না, ফিরে আসে। এবং সে (ট্রাভিস) এই নরক থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। তবে আপনি এটা ঠিকই বলেছেন, আমরা তার অতীত সম্পর্কে তেমন কিছুই জানাইনি। স্পষ্টতই, সে অজানা কোথাও থেকে এসেছে আর সমস্যাগুলোকে পথিমধ্যে থেকে নিজের সঙ্গী করে নিয়েছে।

এবার্ট: আপনার অনেকগুলো চলচিত্রের চরিত্রগুলো নারীর ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্থ থাকে। তারা নারীদের কল্পনা করে, কামনা করে কিন্তু তাদের কাছে যেতে পারেনা।

মার্টিন স্করসেইজি: এটা মূলত দেবী-নিশিকন্যা অনিশ্চয়তার জন্য হয়ে থাকে। আপনি তাদের পূজা করতে করতে বেড়ে ওঠেন, অথচ জানেন না কিভাবে তাদের অ্যাপ্রোচ করবেন- সেটা মানবিক পরিস্থিতি হতে পারে অথবা শারীরিক পরিস্থিতিও হতে পারে। আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার ট্রাভিসও একই সমস্যার ভুক্তভোগী।

হোক সেটা যুবতী দেবী অথবা সাড়ে ১২ বছরের ছোট্ট দেবী। সে মেয়েটিকে (জোডি ফস্টার) স্বর্গের অপ্সরী-ফেরেশতা হিসেবে ভাবে। সেজন্য বাস্তবে দালালরা তার সাথে যেভাবে আচরণ করে, সেটা ট্রাভিস মানতে পারে না।

এজন্য যখন সে প্রতিশোধ নিতে যায়, তার আগে সে যেন নিজেকেই পূত-পবিত্র করে নেয়। নিজের মেয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার আগে Max von Sydow যেমনটা করেছিলেন বার্গম্যান’র The Virgin Spring চলচিত্রে।

এছাড়াও ট্যাক্সি ড্রাইভারে প্রচুর ক্যাথলিক রীতির উল্লেখ আছে, এমনকি সেটা আমার ব্যক্তিগত পর্যায়েরও হতে পারে। যেমন: খুন করতে যাবার আগে ট্রাভিস ফুল পুড়িয়ে যায়। অথবা বেদীতে যেভাবে ফুল সাজানো থাকে; ট্রাভিস যখন অস্ত্র কিনতে যায়, তার সামনে ভেলেভেটের উপর সেভাবে অস্ত্র সাজানো থাকে।

এবার্ট: আপনার পরবর্তী চলচিত্র (New York, New York)-ও কি নারীবাদী হবে? Alice Doesn’t Live Here Anymore চলচিত্রটিকে প্রচুর দর্শক নারীবাদী চলচিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে।

মার্টিন স্করসেইজি: আমি জানিনা এটাকে (New York, New York) কোনোভাবে নারীবাদী বলা চলে কিনা। সত্যি বলতে কি “Alice” না, ট্যাক্সি ড্রাইভার হলো আমার নারীবাদী চলচ্চিত্র। নারী-পুরুষ সমঅধিকারের চলচ্চিত্র নারীকেন্দ্রীকই হতে হবে, এমন কোনো আইন আছে কি? “Alice”-এ নারীবাদী কোনো বিস্তার নেই। অ্যালিস একই ভুল বারবার করে।

এবার্ট: আর ট্যাক্সি ড্রাইভার, যেখানে নায়ক কিনা নারীদের সাথে ঠিকভাবে কথাই বলতে পারে না। সে কি…

মার্টিন স্করসেইজি: নারীবাদি, শতভাগ নারীবাদী। তার পৌরুষই তাকে এই যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয়। যে আপনাকে হত্যা করতে পারবে সেই তো যোগ্যতর। ট্যাক্সি ড্রাইভার কিন্তু এমন ধারণারই বহি:প্রকাশ ঘটায়। সে সব মানুষের সমস্যাগুলোকে তুলে ধরে, যারা কিনা নারীকে দেবী অথবা নিশিকন্যা (যৌনকর্মী) কোন রূপে মেনে নেবে সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।

প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ চলচিত্রটার ভিত্তি একটিমাত্র দৃশ্য, যেখানে এক ছেলেকে এক মেয়ে ফোনে প্রত্যাখ্যান করছে।প্রত্যাখ্যানটি এতোটাই যন্ত্রণাদায়ক ছিলো যে ক্যামেরা সেটা সহ্য করতে পারে না, প্যান করে সরে আসে।

এবার্ট: আমি ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্যগুলি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম, যেখানে ট্রাভিস পাগলা ঘোড়ার মতো গুলি করতে শুরু করে।

মার্টিন স্করসেইজি: এই দৃশ্যগুলিকে আমি ৪৮ ফ্রেমস পার সেকেন্ডে শ্যুট করেছি, সাধারণের চে দ্বিগুণ গতিতে।…আর ছিলো স্লো মোশন। ডি নিরোকে, তার বাহুকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছি যেন তাকে দানব বলে ভ্রম হয়। অথবা এক রোবোট কিংবা কিং কং। ডি নিরোর সংলাপবিহীন ক্লোজ-আপগুলোও আমি ৪৮ ফ্রেমস পার সেকেন্ডে শ্যুট করেছি। যেন তার প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা ঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি। এমন এক ধরণের কৌশলের সাথে সে ঠিক ঠিক মানিয়ে নিয়েছে, এমনই অসাধারণ এক শিল্পী ডি নিরো। ঐ দৃশ্যগুলি আমি নিজেই ধারণ করেছি, যাতে তার অভিব্যক্তিগুলো আমি নিজে দেখতে পারি।

এবার্ট: পুরো মুভিটাই অনেক অভিব্যক্তিপূর্ণ, অনেক স্টাইলিশ…দৃশ্যগুলির অবাক করা পুঙ্খানুপুঙ্খতা ও রঙ-এর নিয়ন্ত্রণ অন্যরকম এক বোধের জন্ম দেয়, সেই সাথে আছে জমকালো লাইটিং…

মার্টিন স্করসেইজি: এরপরেও আমাকে শুনতে হয় আমি নাকি রিয়ালিস্ট, ন্যাচারালিস্ট। অনেকে তো ট্যাক্সি ড্রাইভারকে “Shoeshine!” এর সাথে তুলনা করেছেন। কিভাবে!আমি বাস্তব আবহে আগ্রহী না-একদমই না। আমার চলচিত্রগুলো সেভাবেই ফুটে ওঠা উচিৎ, যেভাবে আমি তাদের অনুভব করি।

Mean Streets মুক্তির পর একটি রিভিউতে আমি লিখেছিলাম, আগামী দশ বছরের মধ্যে স্করসেইজির মাঝে একজন অ্যামেরিকান ফেলিনি হয়ে উঠবার সম্ভাবনা আছে। পরবর্তীতে যখন আমাদের দেখা হলো, মার্টিন খুব গম্ভীর আর চিন্তিত মুখে আমার কাছে জানতে চাইলো, “তোমার কি সত্যিই মনে হয় আমি এতোটা সময় নেবো?”

—————————————

একজন ভালো ব্লগার ‘স্নিগ‘ শুধু সিনেমার দর্শকই নন, পাঠকও। পরিচালকদের মুন্সিয়ানা ধরতে পারার ক্ষেত্রে তিনি বেশ অভিজ্ঞ, পড়তে ভালোবাসেন বলে সিনেমা দেখার পাশাপাশি চিত্রনাট্যও পড়েন, রিভিউ এবং সাক্ষাতকারও। দারাশিকো’র ব্লগে এটা স্নিগের দ্বিতীয় পোস্ট। ধন্যবাদ স্নিগ – দারাশিকো

About স্নিগ্ধ রহমান

আমি একদিন মারা যাব, এই সত্যটা নিয়ে আমার খুব বেশি আক্ষেপ নেই। তবে, আমার মৃত্যুর পর আরও অসংখ্য অসাধারণ সব বই লেখা হবে, গান সৃষ্ট হবে, চলচিত্র নির্মিত হবে।কিন্তু আমি সে সব পড়তে, শুনতে কিংবা দেখতে পারবো না।এই সত্যটা আমাকে খুব যন্ত্রণা দেয়।

View all posts by স্নিগ্ধ রহমান →

3 Comments on “মার্টিন স্করসেইজির সাক্ষাৎকার : “ট্যাক্সি ড্রাইভার নারীবাদী চলচ্চিত্র””

  1. দারুন।
    ধন্যবাদ লেখাটার জন্য।

    এই লোকের মুভি একটা কারনেই ভালো লাগে, চিন্তা করার অনেক সুযোগ থাকে। ৩-৪বার ১টা মুভি দেখার পর ও মনে হয়, কিছু মিস করলাম না তো!!

  2. Mean Streets মুক্তির পর একটি রিভিউতে আমি লিখেছিলাম, আগামী দশ বছরের মধ্যে স্করসেইজির মাঝে একজন অ্যামেরিকান ফেলিনি হয়ে উঠবার সম্ভাবনা আছে। পরবর্তীতে যখন আমাদের দেখা হলো, মার্টিন খুব গম্ভীর আর চিন্তিত মুখে আমার কাছে জানতে চাইলো, “তোমার কি সত্যিই মনে হয় আমি এতোটা সময় নেবো?”

    হাহাহা। গুড শট

    দারুন ঝরঝরে অনুবাদ।

  3. ক্ল্যাপ্স!!

    ধন্যবাদ স্নিগ কে ঝরঝরে অনুবাদ এর জন্য। এক ধাক্কায় পড়া শেষ 😀

    দারাশিকো ব্লগ তো আস্তে আস্তে তার ডালাপালা বিস্তার করছে – খুব ভালো লক্ষন।

    নরক থেমে থাকেনা, ফিরে আসে – এটাই নরকের ধর্ম 🙁

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *