
সিনেমা দেখেন কিন্তু ক্রিস্টোফার নোলানের নাম শুনেন নাই দ্য ডার্ক নাইট আর ইনসেপশনের মতো সিনেমা মুক্তি পাবার পরে এমন একটা মুভি দর্শক খুঁজতে গোরস্থানে যেতে হবে নির্ঘাত। ‘ফলোয়িং’ নোলানের পরিচালিত প্রথম ফিচার ফিল্ম। ৪০ বছর বয়সী এই পরিচালক এখন বিশাল বাজেটের সিনেমা নির্মান করছেন, অথচ এই ফলোয়িং একটি খুবই লো-বাজেট ফিল্ম।
একজন লেখক হতে আগ্রহী যুবক তার প্রথম উপন্যাসেই চমক দেখিয়ে দিতে চায় আর তাই তার গল্পের চরিত্রের খোজে মানুষের পিছু নেয়। একটাই শর্ত মেনে চলে সে, এক ব্যক্তিকে দ্বিতীয়বার পিছু নেন না। কিন্তু এই শর্ত ভাঙ্গে নিজেই, কালো স্যুট পড়া এক ভদ্রলোকের পেছনে ছোটে, একবার, দুইবার, বারবার। একদিন, সেই ভদ্রলোকই তাকে পাকড়াও করে এবং জানা যায়, সে একজন চোর। মানুষের ঘরে অবৈধ উপায়ে প্রবেশ করে, কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যায় যেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ন কিছু নয়। লিখতে সহায়ক হবে এই আশায় দুজনে দল বেধে লেগে গেলো চুরি করতে। কিন্তু দেখতে দেখতে ঝামেলায় জড়িয়ে গেলো লেখক হতে চাওয়া যুবকটি। সে কি অভিজ্ঞতা অর্জন করছে, নাকি কারও খেলার গুটিতে পরিণত হয়েছে?
ফলোয়িং মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৮ সালে, জাতে থ্রিলার। সাদা কালোতে চিত্রায়িত করা এই সিনেমাকে বলা হচ্ছে নিও-নয়ার, ফিল্ম নয়ারের মডার্ন রূপ। ফিল্ম নয়ার বলতে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশকের বেশ কিছু সিনেমাকে বোঝায় যেসব সিনেমায় সত্যিকারে কোন ভিলেন থাকে না, বরং অ্যান্টিহিরো থাকে। জাতে ক্রাইম ড্রামা কিংবা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার হয়, সবচে’ বেশী বৈচিত্র এর সিনেমাটোগ্রাফিতে। সাদা-কালোর মধ্যে লো কি লাইটিং আর আলো ছায়ার খেলা দেখা যায় এই ধরনের সিনেমাগুলোতে।
ফলোয়িং সিনেমাটি যখন নোলানরা নির্মান করছেন তখন ৩৫ মিমি ক্যামেরা অনেক উন্নত, সাদাকালোয় সিনেমা নির্মিত হয় না বললেই চলে। অথচ এই সময়ে ক্রিস নোলান তার ফলোয়িং সিনেমা নির্মান করলেন সাদা-কালোয়, ১৬ মিমি ক্যামেরায়। কেন? বাজেট কম ছিল তাই। সিনেমায় মূল চরিত্র মাত্র ৪ জন। তরুন লেখক, নাম বিল, কালো স্যুট পড়া চোর, নাম কব, স্বর্নকেশী এক সুন্দরী আর একজন পুলিশ অফিসার। পুলিশ অফিসারের ভূমিকাও খুব বেশী সময়ের নয়, তবে গুরুত্বপূর্ন। এছাড়া প্রয়োজনে আরও বেশ কিছু ছোট চরিত্রে অনেক অভিনেতা অভিনয় করেছেন। গল্পটা নোলান এমন ভাবেই সাজিয়েছিলেন যেন অল্প চরিত্রে কাজ হয়ে যায়। উদ্দেশ্য একটাই – স্বল্প বাজেটে ফিচার ফিল্ম নির্মান।
আমাদের উপমহাদেশের কিংবদন্তী সত্যজিত রায়ের সাথে ক্রিস নোলানের কাজ কর্মের বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়। সত্যাজিত তার প্রথম সিনেমা ‘পথের পাচালি’ নির্মানের সময় একই কাজ করেছিলেন। অভিনেতার ব্যয় বহন করতে পারবেন না বলে পুরোনো বন্ধু জেরেমি থিওব্যাল্ডকে দিয়ে প্রধান চরিত্রটি করান, কলেজ জীবনে জেরেমি থিয়েটার করতো। স্বর্নকেশী সুন্দরী লুসি রাসেলকে পাওয়া গেল সেই জেরেমির মাধ্যমেই। জেরেমি শুধু প্রধান চরিত্রই নয়, সিনেমার একজন প্রোডিউসারও বটে।
ফলোয়িং সিনেমাটি ৯৩ মিনিট দীর্ঘ, অথচ শ্যুটিং চলেছে প্রায় একবছর ধরে। কারণ একটাই। সিনেমার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই পুরো সপ্তাহ ব্যস্ত থাকেন নিজ নিজ পেশাগত কাজে, শুধু ছুটির দিনে একত্রিত হন সিনেমা নির্মান কাজে। নোলান খুব সন্তুষ্ট ছিলেন এই কাজে, কারণ তার চাকুরীর অর্থ দিয়েই সিনেমা নির্মান করা সম্ভব হয়েছিল, ধার দেনা করতে হয় নি সামান্য পরিমানও।
শ্যুটিং স্টাইলেও বেশ হিসেব করে এগিয়েছিলেন নোলান। নিও-নয়ার সিনেমা বলে খুব বেশী নাটকীয়তা দেখাতে হয়নি তাকে, অভিনেতাদের কাজ কর্মের মাধ্যমেই সিনেমা এগিয়েছে তরতর করে। কাজ করেছেন প্রাকৃতিক আলোতে, ক্যামেরা চালিয়েছেন নোলান নিজেই, তাও হ্যান্ডহেল্ড শট বেশী। লোকেশন হিসেবে ব্যবহার করেছেন বন্ধু, আত্মীয় স্বজন এবং নিজেদের বাড়িকে। শ্যুটিং এর আগে রিহার্সেল হয়েছে বেশ। রিহার্সেলের প্রতি এতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল যে সপ্তাহে দুটো সন্ধ্যা করে প্রায় ছয় মাস মহড়া চলেছিল। শুধু তাই নয়, ফিল্ম স্টক বাচানোর জন্য শ্যুটিং এর সময়ও রিহার্সেল চলেছে যেন দু’একটা টেক থেকেই সঠিক টেকটি নিয়ে নেয়া সম্ভব হয়। ‘নিউজরীল’ স্টাইলের শ্যুটিং তার এ কাজকে আরও সহজ করে দেয়।
এত কিছু করেও কিন্তু বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন নি ক্রিস নোলান। চোরদের গল্প নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছেন আর এদিকে তার নিজের বাড়িতেই হানা দিলো চোর, অন্যান্য জিনিসের সাথে নিয়ে গেল কিছু এক্সপোজড ফিল্ম স্টক যাতে ছিল বেশ কিছু ইনসার্ট শট। পুনরায় শ্যুটিং করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। সুতরাং চললো এভাবেই।
১২ সেপ্টেম্বর কান চলচ্চিত্র উতসবে প্রথম প্রদর্শিত হয়, পরে ১৯৯৯ সালের ২রা এপ্রিল নিউইউর্কে মুক্তি পায় সিনেমাটি। রোটেন টম্যাটোস এর এই সিনেমার ৭৬ ভাগ ফ্রেশ বলে মন্তব্য করেছে। খুব বেশী ব্যবসা করেছিল এমনটি বলা যাবে না, কারণ ৪৮০০০ ডলার খুব বেশী নয়, কিন্তু এই একটা ‘ফলোয়িং’ সিনেমাই ক্রিস্টোফার নোলানকে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশাধিকার দিয়েছে, ১৬০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ‘ইনসেপশন’ সিনেমা নির্মানের সুযোগ করে দিয়েছে। কত ছিল এই ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকার টিকেট মূল্য?
মাত্র ৬০০০ ডলার।
ফলোয়িং মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৮ সালে, জাতে থ্রিলার। সাদা কালোতে চিত্রায়িত করা এই সিনেমাকে বলা হচ্ছে নিও-নয়ার, ফিল্ম নয়ারের মডার্ন রূপ। ফিল্ম নয়ার বলতে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশকের বেশ কিছু সিনেমাকে বোঝায় যেসব সিনেমায় সত্যিকারে কোন ভিলেন থাকে না, বরং অ্যান্টিহিরো থাকে। জাতে ক্রাইম ড্রামা কিংবা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার হয়, সবচে’ বেশী বৈচিত্র এর সিনেমাটোগ্রাফিতে। সাদা-কালোর মধ্যে লো কি লাইটিং আর আলো ছায়ার খেলা দেখা যায় এই ধরনের সিনেমাগুলোতে।
দারুন জিনিস শিখলাম।
আপনার পোস্টটা পড়ে নোলান সম্পর্কে অনেক আজানা বিষয় জানলাম। খুবই ভালো লাগলো।
নোলানের ফাইট ক্লাব না দেখলে দেখে নিয়েন সময় করে।
vai fight club to nolan er na david fincher er
স্বাগতম রাশেদ।
আগেই রুশো ভাই-কে শুধরে দেয়া হয়েছিল, নিচের দিকে মন্তব্যে দেখতে পাবেন। তারপরও আপনার মন্তব্যকে স্বাগতম, এভাবে ভুলগুলো ধরিয়ে দিলে সামনে আরও সতর্ক হওয়ার সুযোগ থাকে। ধন্যবাদ।
bah!
আসলেই কবুল করতে হয়, এই রিভিউটা আমার পছন্দ হইছে। 🙂 । ধন্যবাদ ভালো একটা রিভিউয়ের জন্য। সীনেমাটা আমার দেখা হয় নাই। তাই, আর কিছু এ্যাড করতে পারলাম না। তবে দেখে ফেলবো। তখন যদি কিছু বলতে মনে চায়, বলবো।
রুশো ভাই, একটু ভুল হৈসে মনে হয়, ফাইট ক্লাব নোলানের না … ডেভিড ফিঞ্চারের
ছবিটা দেখা আছে।
রিভিউ অসাধারণ লাগল।
দারুন এই রিভিউ পড়ে মুভিটা দেখার আগ্রহ জন্মালো।
আমি ক্রিস নোলানের ভক্ত হয়ে গেসি মেমেন্টো দেখার পর থেকেই।
আজই আপনার সাইটে প্রথম আসলাম। এখন থেকে নিয়মিতই আসব হয়তো।
দারাশিকো’র ব্লগে স্বাগতম তৌফিক হাসান। আপনাকে সবসময়ই আমন্ত্রন 🙂
ভালো থাকুন।
পোস্ট টা অসাধারন হয়েছে। in fact আপনার সব পোস্টের নিয়মিত (নীরব) পাঠক। আমাদের দেশে কবে যে এমন director হবে।…………
স্বাগতম আহমেদ আশিক 🙂
হতাশা কেন আপনার কন্ঠে? গত ৩/৪ বছরের সিনেমাগুলো খেয়াল করুন। অনেক পরিবর্তন হয়েছে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে, অনন্ত যাই বানাক না কেন – সামাজিক অ্যাকশন সিনেমা থেকে বেড়িয়ে পুরোদস্তুর অ্যাকশন সিনেমা নির্মান করছে। আমি এই জন্য আশাবাদী।
আপনি, আমি আমরা সবাই যদি এগিয়ে আসি, তবে কেন উন্নতি হবে না বলুন? ভালো থাকুন আশিক। সবসময় আসবেন। 🙂
ভালো লেগেছে ভাই…..
ধন্যবাদ রিপন 🙂
++++
স্বাগতম আকাশের পাখি 🙂
I saw this movie…