নাটোর ভ্রমণ

ইচ্ছে ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাবো। সেখানে আছে ছোট সোনা মসজিদ এবং আরও কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। একটি স্থলবন্দর। বছর কয়েক আগে আমি আর মাহদী ঢাকা থেকে পালিয়ে চাঁপাই-রাজশাহী-নাটোর বেড়িয়ে গিয়েছিলাম। পরিবারকেও এই সকল স্থাপনা দেখিয়ে আনার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পরিকল্পনার ভুলে তা সম্ভব হলো না। রাজশাহী থেকে চাঁপাইয়ের সরাসরি বাস সার্ভিস বলতে কিছু নেই। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা নাইটকোচগুলো ভোরবেলায় রাজশাহী থেকে যাত্রী নেয় বটে, অত সকালে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে উপস্থিত হওয়া ঝামেলা। লোকাল সার্ভিসে দুই ঘন্টার রাস্তা চার ঘন্টা লাগতে পারে। তাছাড়া চাঁপাইতে হোটেল রুম না নিলে প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করা, বাচ্চার খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি বেশ কষ্টকর হয়ে যাবে। সুতরাং উত্তম বিকল্প হিসেবে নাটোর-কেই বেছে নিয়ে শুরু হলো আমাদের নাটোর ভ্রমণ।

রাজশাহীতে সকালের নাস্তা খেয়ে অটোতে করে ভদ্রা এবং সেখান থেকে বাসে চড়ে যখন নাটোরের হরিশপুরে নামলাম, তখন ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁইছুঁই। বাচ্চাকে  সিরিয়াল টাইপের কিছু খাওয়ানো দরকার, কিন্তু বসার কোন উপায় দেখা গেলো না। পরে, হরিশপুর মোড়েই এক হার্ডওয়্যার দোকানের মালিক ভদ্রলোক তার দোকানে বসার ব্যবস্থা করে নিজে আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালেন। নাটোর রাজবাড়িতে যাবার পথও বাতলে দিলেন তিনি।

ebook pdf download Rajshahi-Natore

রাজশাহী-নাটোর ভ্রমণ কাহিনীটি তিনটি ভাগে প্রকাশ করা হয়েছে – রাজশাহী ভ্রমণ, নাটোর ভ্রমণ এবং রাজশাহীর খাবার। পাঠকের পড়ার সুবিধার্থে সম্পূর্ণ ভ্রমণ কাহিনীকে ছবিসহ একটি ই-বুকে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ফাইল সাইজ: ১১ মেগাবাইট।

ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন – ছবিতে অথবা এখানে

রানী ভবানীর রাজবাড়ি

নাটোর ভ্রমণের প্রথম গন্তব্য রানী ভবানীর রাজবাড়ি। নাটোরের রাজবাড়িতে ঢুকতে টিকেট কিনতে হয়। বড় ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে বামদিকে বাগান ও মন্দির, ডানদিকে বিশাল দিঘী। বাঁধাই করা ঘাটের সিঁড়ি নেমে গেছে বহুদূর। দুই পাশে বসার ব্যবস্থা আছে। আমরা সেই সিঁড়িতে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে রইলাম অনেকক্ষণ।

এই রাজবাড়ির আরেক নাম রানী ভবানীর রাজবাড়ি। আজ থেকে প্রায় তিনশ বছর আগে তিনি ছিলেন তার জমিদারীর একচ্ছত্র অধিপতি। জমিদারীর পত্তন হয়েছিল তার শ্বশুর রাম জীবনের হাতে। রানী ভবানী হলেন রাম জীবনের দত্তকপুত্রের স্ত্রী। বিয়ের অল্প কিছুদিন পরেই তিনি বিধবা হয়ে জমিদারীর হাল ধরেন এবং প্রায় পঞ্চাশ বছর সাফল্যের সাথে জমিদারী পরিচালনা করেন। বর্তমানের রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, বগুড়া, মুর্শিদাবাদ সহ বিশাল এলাকা তার জমিদারীর অন্তর্ভূক্ত ছিল। এ জন্য তাকে অর্ধবঙ্গেশ্বরী নামেও ডাকা হতো। এই বিশাল জমিদারী থেকে তৎকালীন বার্ষিক প্রায় পনেরো লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায় হতো বলে ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। তার এই বিশাল অংকের আয় থেকে প্রজাদের কল্যাণে প্রচুর ব্যয় করার কারণেই তিনি ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী হয়ে আছেন। এছাড়া, নারী জমিদার হিসেবে তার বিশেষ পরিচিতি তো আছেই। নাটোর ভ্রমণ।

নাটোর ভ্রমণে রানী ভবানীর রাজবাড়ি
নাটোর ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য – রানী ভবানীর রাজবাড়িতে একটি সম্প্রতি রং করা প্রাসাদ

দিঘী পেরিয়ে আরেকটু সামনে এগোতেই দেখা গেল একটি ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সকলের আবদারে সেই গাড়িতে চড়তে হলো এবং গাড়িটি প্রায় একশ একরের বিশাল জমিদারী ঘুড়িয়ে আনলো মাত্র দশ মিনিটে।

রাজবাড়ির ভেতরে কয়েকটা বাসভবন আর মন্দির রয়েছে। বড় তরফ ও ছোট তরফের বাসভবন নামে পরিচিত ওগুলো। রানী ভবানীর দুই দত্তক সন্তান এই নামেই পরিচিত ছিলেন। রাজস্ব আদায়ের জন্য নির্ধারিত ঘর রয়েছে একটি, পাশেই কারাগার। সম্ভবত খাজনা আদায়ে ব্যর্থ কৃষককে বন্দী করে রাখা হতো এখানে, নিশ্চিত হবার কোন উপায় নেই।

নাটোর ভ্রমণের অংশ হিসেবে রাজবাড়ি ভ্রমণে গেলে হতাশ হবেন না এমন কাউকে পাওয়া যাবে না নিশ্চিত। পুরো এলাকাজুড়ে পরিকল্পনাহীনতা, অযত্ন আর অবহেলার ছাপ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কোন ভবনেই পর্যটকের প্রবেশাধিকার নেই। ভেতরে এক জায়গায় চার-পাঁচটি পাবলিক টয়লেট রয়েছে যেগুলো প্রচন্ড নোংরা ও দুর্গন্ধময়। পর্যটকদেরকে টিকেট কেটে ঢুকতে হলেও ভেতরে বহিরাগতের অভাব নেই। উপরে ছাউনি দিয়ে অনেকগুলো দোকান বসেছে, সেগুলো প্লাস্টিকের খেলনাদ্রব্যে ভর্তি। সীমানার দিকে বসবাসের জন্য কিছু ঘর দেখা গেল। ওইসব ঘরের বাসিন্দারাই রাজবাড়ির ভেতর-বাহিরে রিকশা-ঘোড়ার গাড়ি চালায়, নানা রকম খুচরা ব্যবসা করে। কর্তৃপক্ষের অবহেলার সুযোগে নাটোর-রাজশাহীর যুবক-যুবতীরা প্রেমের নামে অবৈধভাবে তাদের আদিম কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার উপযুক্ত স্থান বানিয়ে নিয়েছে রাজবাড়িকে। কারাগার ভবনের সামনে সেরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হলো। তিনশ বছরের এই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের কোন প্রচেষ্টাই যেন নেই।

অথচ, যথাযথ উদ্যোগ নিলে এ ধরণের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদকে কতটা উপভোগ্য ও সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলা যেতে পারে তার উদাহরণ এই নাটোরেই রয়েছে। উত্তরা গণভবন। সে বিষয়ে বিস্তারিত পরে উল্লেখ করা হবে। আপাতত পচুর হোটেলে দুপুরের ভোজন সেরে পেট ঠান্ডা করে নেই।

পচুর হোটেল

পোষাকি নাম ইসলামিয়া পচুর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। তবে নাটোরে আপামরজনতা তাকে এক নামে ‘পচুর হোটেল’ নামেই চিনে। নাটোরের মাদরাসার মোড়ের কাছাকাছি মূল সড়কের পাশেই অনেকটা জায়গা জুড়ে এই হোটেল অবস্থিত। ভেতরে ছোট-বড় কয়েকটা রুম আছে। একদম ভিতরের দু-তিনটা রুম এয়ার কন্ডিশনড। ছাদ টিনের। পচুর হোটেল সম্ভবত দিন-রাত ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। নাটোর ভ্রমণে পচুর হোটেল অবশ্য গন্তব্য।

পচুর হোটেলের বৈশিষ্ট্য কি? সবাই বলে এই হোটেলের গরুর ভুনা মাংস বেশ সুস্বাদু। ব্যাপারটা অস্বীকার করার বিষয় না। আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো এর মেনু। ভর্তা-ভাজি-ভাত-বিরিয়ানী-তেহারী-মাছ-মুরগি ইত্যাদি মিলিয়ে প্রচুর আইটেম। ঝরঝরে গরম ভাত। মনের মাধুরী মিশিয়ে খাওয়া সম্ভব। আমরা ঠিক সে কাজটিই করলাম – অনেক আইটেম অল্প অল্প করে নিয়ে চেখে দেখলাম। গরুর মাংস যেমন ভালো, তেমনি মাছ-মুরগীর রান্নাও চমৎকার। নাটোরের লোকজন ঝাল একটু বেশি খায় কিনা জানি না, আমি ঝাল খাওয়ায় অভ্যস্ত নই বলে নাকে-চোখে পানি চলে এলো। আর প্রচুর ভীড়। খদ্দের এসে দাঁড়িয়ে থাকে টেবিল ফাঁকা হওয়ার জন্য। ফলে শান্তিতে খাওয়া একটু কঠিন হতে পারে।

মিষ্টির দোকান এ ধরনের বড় হোটেলেরই অংশ। এখানেও নানা পদের মিষ্টি, দই ইত্যাদি রয়েছে। কিন্তু আমাদের আগ্রহ নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা খাওয়ার, তাই এখানে আর কিছু খাওয়া হলো না।

উত্তরা গণভবন

নাটোর শহরের কাছেই উত্তরা গণভবন অবস্থিত। এই নামকরণ অবশ্য বেশিদিনের নয়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে একে উত্তরা গণভবন নামকরণ করা হয়। এর আগে থেকে এটি দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ি নামে পরিচিত ছিল। নাটোর ভ্রমণে উত্তরা গণভবনও পরিদর্শন করা হলো।

একই জেলায় কাছাকাছি দুটি রাজবাড়ি – একটি দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ি, অন্যটি নাটোরের রাজবাড়ি – এই নিয়ে আমি একটু দ্বিধান্বিত ছিলাম। পরে ইতিহাস পাঠে বিভ্রান্তি দূর হলো। রানী ভবানীর শ্বশুর রাম জীবন জমিদারী লাভের অনেক আগে থেকেই দিঘাপতিয়ার রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা দয়ারাম তার অধীনের সামান্য বেতনের কর্মচারী ছিলেন। রাম জীবন ধীরে ধীরে জমিদারী লাভ করলে দয়ারামেরও উন্নতি ঘটতে থাকে। সাধারণ এক কর্মচারী থেকে তিনি নাটোরের রাজার দেওয়ান হয়েছিলেন।

দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ি হলো নাটরের রাজা রাম জীবনের পক্ষ থেকে দয়ারামের প্রতি প্রদত্ত পুরস্কার। রাম জীবন দয়ারামকে বেশ পছন্দ করতেন, বিশ্বাস করতেন। শোনা যায়, দয়ারামের নিকট মূল্যবান সামগ্রীও গচ্ছিত রাখতেন তিনি। যশোরের রাজা সীতারামের বিদ্রোহ দমন করার জন্য নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ দেওয়ান দয়ারামের সাহায্য নেন। দয়ারাম সীতারামকে পরাজিত করেন ও মূল্যবাদ সম্পদ লুট করলেও সীতারামের গৃহমূর্তী কৃষ্ণজির ছাড়া সব কিছু রাম জীবনের নিকট হস্তান্তর করেন। তার এ ব্যবহারে খুশি হয়ে রাম জীবন তাকে দিঘাপতিয়াসহ আরও কিছু অঞ্চলের জমিদারী দান করেন। এই রাজবাড়ি দয়ারামই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

উত্তরা গণভবনের একটি প্রাসাদের প্যানারমিক ভিউ। নাটোর ভ্রমণের সময় তোলা।

একই এলাকায় দুটি রাজবাড়ি থাকলেও গুরুত্বের দিক থেকে দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ির মর্যাদা বেশী হবার কারণ কি? একটি কারণ হতে পারে স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ি রানী ভবানীর রাজবাড়ির তুলনায় অনেক এগিয়ে। দয়ারাম নাকি এই বাড়ি সাজানোর জন্য সুদূর ইতালী থেকে নানারকম উপকরণ আনিয়েছিলেন। তবে দয়ারামের প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদ এখন আর বর্তমান নেই। ১৮৯৭ সালে প্রলয়ঙ্কর এক ভূমিকম্পে প্রাসাদটি বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হলে তৎকালীন রাজা পুরো প্রাসাদ কমপ্লেক্সটি পুনঃনির্মাণ করেন। সে সময় এর সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। অন্য কারণটি সম্ভবত দিঘাপতিয়ার রাজবাড়িকে উত্তরা গণভবনে রূপান্তরকরণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই নামকরণ করেছিলেন। এর আগে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান একে গভর্নরের বাসভবন নামকরণ করেছিলেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু এই স্থানে মন্ত্রীপরিষদ সভা আয়োজন করেছিলেন।

বছর ছয়েক আগে যখন এসেছিলাম, তখন সীমিত পরিসরে উত্তরা গণভবন পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এবার গিয়ে দেখি আরও বিশাল জায়গা খুলে দেয়া হয়েছে। সেখানে রয়েছে অসাধারণ সুন্দর বিশাল এক পুকুর আর বাগান। আছে বসার ব্যবস্থা। মার্বেল পাথরের মূর্তি। পুকুরের এক প্রান্তে ছোট একটি চিড়িয়াখানা স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে রয়েছে বেশ কিছু হরিণ, বানর, পাখি। একটি কথা বলা ময়না রয়েছে যে কিনা একটু পরপর ‘ময়না’, ‘ময়না’ বলে ডাকাডাকি করে। খাঁচার দরজায় দাঁড়ালে হরিণগুলো এসে হাতে চুমু খেয়ে যায়। নাটোর ভ্রমণে ছোট বাচ্চাকাচ্চা থাকলে উত্তরা গণভবন আদর্শ।

পুরো রাজবাড়ি জুড়েই গাছপালার সমাহার। সবুজ আর সবুজ। এর মাঝে একটি গাছকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। গাছটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাগিয়েছিলেন।

একটি ভবনকে সংগ্রহশালা বানানো হয়েছে। টিকেট কেটে এই সংগ্রহশালায় প্রবেশ করলে রাজার ব্যবহৃত খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, বিভিন্ন আসবাবপত্র দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে। রয়েছে বেশ কিছু পেইন্টিং, ভাস্কর্য। এই সংগ্রহশালাটি ২০১৮ সালে সকলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। একমাত্র এই সংগ্রহশালা ব্যতীত আর কোন ভবনেই সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই।

যত্ন-আত্তি আর সুব্যবস্থাপনা এ ধরণের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলোকে কোন মর্যাদায় নিয়ে যেতে পারে তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ হলো এই দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ি। নাটোর ভ্রমণে দিঘাপতিয়ার রাজবাড়িতে আপনি শতবার আসতে চাইবেন কিন্তু রানী ভবানীর রাজবাড়িতে একবারের বেশী নয়।

নাটোরের বিখ্যাত – কাঁচাগোল্লা নাকি রসমালাই?

নাটোর ভ্রমণের সর্বশেষ ধাপ – বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা গলধঃকরণ যার স্বাদ না নিলে নাটোর ভ্রমণ অবশ্যই অসম্পূর্ণ। দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে অটোয় বসে হাজির হলাম নাটোর শহরের মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডারে।

আসলেই মিষ্টির ভান্ডার। দোকানের অর্ধেকটা জুড়েই মিষ্টি – সাদা-কালো-লাল-হলুদ, শুকনো-ভেজা-ডুবুডুবু, পাতলা রস থেকে ঘন দুধের ক্ষীর। মাছি তো আছেই, কয়েক ডজন মৌমাছিও দেখা যাচ্ছে। আর, আমাদের মতো দুধের মাছি মানে কাস্টমারও আসছে-যাচ্ছে বেশ। তবে টেবিলের যে অ্যারেঞ্জমেন্ট তাতে আলাদা বসার কোন ব্যবস্থা নেই। লোকজনও সেভাবেই মিলে মিশে খাচ্ছে। পরিবেশনটা ঠিক পরিচ্ছন্ন নয়। মেলামাইনের হাফ প্লেটে টিনের চামচ দিয়ে মিষ্টি খেতে দেয়। মনে হচ্ছিল – দিনে কয়েকশ কেজি মিষ্টি বিক্রি হয় এখানে।

অর্ডার দিয়েছি নাটোরের সেই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লার। ওয়েটার ভদ্রলোক প্লেটে করে যা দিয়ে গেলেন তা দেখে চোখ গোল্লা হয়ে গেল, কারণ গোল্লা প্লেটের কাঁচাগোল্লা মোটেও গোল্লা নয়। দেখে মনে হতে পারে এক চামচ সাদা ভাত দিয়েছে যেনো। কাঁচাগোল্লার এই আকৃতি নিঃসন্দেহে অদ্বিতীয়।

মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি, নীচে বামদিকে কাঁচাগোল্লা, ডানে রসমালাই। নাটোর ভ্রমণে চেখে দেখা হলো।

মুখে দিলাম এক চামচ। মিষ্টিতে মুখ ভরে গেল। এই কাঁচাগোল্লা কেন এত বিখ্যাত বোঝার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। দ্বিতীয় চামচ মুখে দিলাম, মিষ্টির তীব্রতা বাড়লোই কেবল। তারপর আরও কয়েক চামচ মুখে দিয়েছি বটে, মাত্রাতিরিক্ত চিনি ছাড়া আর কিছুই অনুভব করতে পারলাম না। এত বিখ্যাত মিষ্টি, অথচ প্লেট খালি করতে পারলাম না কেউই। নষ্ট হলো।

পানি খেয়ে মুখের স্বাদ দূর করে একে একে আরও কয়েক পদ চেখে দেখলাম। সন্দেশ, রসগোল্লা আরও কি যেন। তারপর মুখে দিলাম রসমালাই। আহ! প্রাণটা সত্যিই জুড়িয়ে গেলো। মিষ্টিটা নরম। মুখের ভেতরে জিহবার আলতো চাপে যেন গলে যাচ্ছিল। সবচেয়ে অসাধারণ মালাই-টা। ঘন ও সুস্বাদু। কাঁচা সবুজ ঘাস খেয়ে পুষ্ট গাভীদের তরল দুধ থেকে এই মালাই তৈরী হয়েছে নির্ঘাৎ। ঘন বানানোর জন্য সময় নিয়ে জ্বাল দেয়া হয়েছে, টিস্যু পেপার গুলে ঢেলে দেয়া হয়নি। পরিমাপমতো মিষ্টি, কাঁচাগোল্লার মতো উপচে পড়া মিষ্টি নয়। দীর্ঘ সময় নিয়ে এই মিষ্টি খাওয়া যায়। আমরাও সময় নিলাম প্রতিটি মিষ্টির পূর্ণ স্বাদ আস্বাদন করার।

কুমিল্লার বিখ্যাত, টাউনহলের কাছে, সত্যিকারের মাতৃভান্ডারের রসমালাই খেয়েছি আমি। নাটোরের মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডারের রসমালাইয়ের সাথে তুলনায় কোনটি সেরা সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেল না। এজন্য অবশ্যই দুই প্লেটে দুই দোকানের মিষ্টি নিয়ে একসাথে বসতে হবে।

রাতে রাজশাহীতে গ্লোরিয়াদের বাসায় তার মায়ের সাথে দেখা করতে যাবো। সে উপলক্ষে নাটোরের মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে আমরা কাঁচাগোল্লা নয়, রসমালাই কিনে নিলাম।

নাটোরে আরও দুই পদের মিষ্টি বিখ্যাত বলে জেনেছিলাম। অবাক সন্দেশ ও রাঘবশাহী। নাটোরের সব দোকানেই নাকি পাওয়া যায়, মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডারে পাওয়া গেলো না বলে খাওয়াও হলো না। এজন্য নাটোর ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে গেলো কি?

নাটোর ভ্রমণের দ্রষ্টব্য তালিকায় আরও ছিল দয়ারামপুরের রাজবাড়ি আর হালতী বিল। হালতীবিলে নাকি সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়। কিন্তু সেটা অনেক দূরে এবং আমাদের হাতে সময় না থাকায় যাওয়া সম্ভব হলো না।

হরিশপুর মোড় থেকে রাজশাহী ফেরার বাসে চড়ে বসলাম। পেছনে রইল দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ি আর মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডারের রসমালাই।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *