মোঙ্গল : চেঙ্গিস খানের উত্থানপর্ব

আকাশে বিদ্যুৎ চমকে বজ্রপাত হতে দেখলে মোঙ্গলরা, নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাই, ভয়ে মুখ লুকায়। নয় বছরের বালক তেমুজিন বাবার কোলে মুখ লুকায় নি, সে ভয়কে জয় করে অবাক চোখে বজ্রপাত দেখছিল। তার এই অকুতোভয়তাই তাকে একদিন মোঙ্গল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বানিয়ে দেয়, শত্রুকে পরাজিত করে তাকে বিজয়ী করে বারংবার আর তেমুজিন হয় যায় চেঙ্গিস খান!

পৃথিবীর ইতিহাসে অবিশ্য চেঙ্গিস খানের পরিচয় নেতিবাচক। চরম নিষ্ঠুরতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাকে। মোঙ্গল সম্রাজ্যকে বিস্তৃত করতে গিয়ে তিনি একের পর এক রাজ্য আক্রমণ করেছেন, ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালিয়েছেন। সামরিক বাহিনী তো বটেই, বেসামরিক মানুষও মেরেছেন নির্বিচারে। চীন এবং মধ্য এশিয়ার বিশাল অঞ্চল তিনি দখল করে নিয়েছিলেন খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে।

ইতিহাসে যে ব্যক্তি এত কুখ্যাত, তাকে মহান করে উপস্থাপন করতে পারে চলচ্চিত্র, মোঙ্গল তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। রাশিয়ান পরিচালক সার্গেই বদরভ পরিচালিত এই সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০০৭ সালে। সারা বিশ্বেই ছবিটি প্রশংসিত হয় এর চমৎকার নির্মানের জন্য। রাশিয়া, জার্মানী এবং কাজাখিস্তানের যৌথপ্রযোজনায় নির্মিত এই ছবিটি কাজাখিস্তানের ছবি হিসেবে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে একাডেমি এ্যাওয়ার্ড এর জন্য মনোনীত হয়েছিল।

View post on imgur.com

ছবির কাহিনী শুরু হয় ১১৯২ সালে। কারাগারে বন্দী তেমুজিনকে একজন বালক এসে একজন বৌদ্ধ সন্যাসীর মৃত্যু সংবাদ জানায়। তারপর ফ্ল্যাশব্যাকে দর্শককে নিয়ে যাওয়া হয় ১১৭২ সালে যখন নয় বছর বয়সী তেমুজিন তার গোত্রপ্রধান বাবার সাথে চলছে স্ত্রী নির্বাচনের উদ্দেশ্যে। বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের পছন্দে স্ত্রী নির্বাচন করে তেমুজিন, অবশ্য পিতা এতে না-রাজি হন না। ফেরার পথে শত্রু কর্তৃক বিষ প্রয়োগে তেমুজিনের বাবা মৃত্যুবরণ করেন এবং তারই একজন সঙ্গী তারগুতাই নিজেকে খান (গোত্রপ্রধান) দাবী করে তেমুজিনদের সকল সম্পত্তি আত্মসাৎ করে তাদেরকে বিতাড়িত করেন। ভুল করেছিল তেমুজিনের মা, সে হুমকি দিয়ে বসে, বড় হয়ে তেমুজিন এর প্রতিশোধ নিবে। এই হুমকিতে তেমুজিন হয়ে যান তারগুতাইয়ের শত্রু, মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান বয়সে ছোট বলে। পরিবারবিচ্ছিন্ন হয়ে ফেরারী জীবনের শুরু হয় তেমুজিনের।

তেমুজিন বা চেঙ্গিস খানের শৈশব-কৈশোরকাল সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। কাহিনীকার-পরিচালক এই সুযোগটি নিয়েছেন এবং নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে কাহিনীর বিস্তার ঘটিয়েছেন। মোঙ্গল একটি ইতিহাস আশ্রয়ী চলচ্চিত্র, তাই ইতিহাসে এর সত্যতা যাচাই করতে যাওয়া বোকামী। সুতরাং সিনেমায় মনযোগ দিয়ে বুদ্ধির পরিচয় দেয়া যাক।

View post on imgur.com

ফেরারী তেমুজিন কিভাবে চেঙ্গিস খান উঠল তা বর্ণিত হয়েছে বাকী অংশে। বালক তেমুজিন মুক্তির আশায় ছুটে গিয়েছিল বিশেষ এক স্থানে, দেবতাকে ডাকার জন্য। দেবতা তার সামনে হাজির হয় নেকড়ের রূপে, মুক্তি দেয়। যৌবনে পুনরায় হাজির হয় তেমুজিন, নেকড়েরূপী দেবতার সামনে সে প্রতীজ্ঞা করে – মোঙ্গল জাতিকে সে ঐক্যবদ্ধ করবে যারা কখনো নারী ও শিশুদের হত্যা করবে না, অবশ্যই প্রতীজ্ঞা এবং ঋণ পরিশোধ করবে এবং কখনোই খানের বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। তার এই প্রতীজ্ঞার প্রমাণ পাওয়া যায় রক্ত শপথে ভাতৃত্বের বন্ধনে বন্দী ভাই থেকে শত্রুতে রূপান্তরিত হওয়া জামুখার বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে তার অপেক্ষাকৃত ছোট কিন্তু সুশৃঙ্খল, কুশলী এবং অনুগত বাহিনীর বিজয়ে।

মোঙ্গল সিনেমায় যুদ্ধের দৃশ্যগুলোর চিত্রায়ন অসাধারণ। জামুখার বাহিনীর বিরুদ্ধের যুদ্ধে তেমুজিনের বাহিনী যে নৈপুণ্য প্রদর্শন করে তা অবিস্মরণীয়। একইরকম না হলেও কারাগারে বন্দী হবার আগের যুদ্ধে তেমুজিনের দক্ষতা আর নেতৃত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। যুদ্ধের দৃশ্যগুলো ছাড়াও সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রে অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি – ক্যামেরা এবং রঙ এর শৈল্পিক ব্যবহার – দর্শককে মোহাবিষ্ট করে রাখবে। সাযুজ্য বজায় রেখেছে আবহসঙ্গীত।

View post on imgur.com

তবে, পুরো ছবি জুড়ে কেবল কাটখোট্টা মারামারি আর হানাহানি চলেছে তা কিন্তু নয়। বরং কাহিনীকে টেনে নিতে সহায়তা করেছে তেমুজিন আর তার শৈশবে নির্বাচিত স্ত্রীর গভীর প্রেম। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত হলেও তেমুজিন বারবার খুঁজে ফিরেছে তার স্ত্রীকে, বিনা সংকোচে গ্রহণ করেছে তার গর্ভে জন্মানো ভিন্ন পুরুষের ঔরসজাত সন্তানকে। তাদের এই প্রেম সিনেমায় যেন শান্তির পরশ বুলিয়েছে, দর্শককে ক্ষণে ক্ষণে মুক্তি দিয়েছে।

পরিচালক সার্গেই বদরভ চেঙ্গিস খানকে নিয়ে একটি ট্রিলজির পরিকল্পনা নিয়েই ছবির কাজ শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়। এ কারণে ছবির ইংরেজি নামে ‘দ্য রাইজ অব দ্য চেঙ্গিস খান’ বেমানান হয় না। নানা কারণে বাকী দুই ছবির নির্মান এখন পর্যন্ত সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। ফলে আমরা মোঙ্গলীয় বীর চেঙ্গিস খানের আদ্যোপান্ত জীবনীর একটি ফিকশন চলচ্চিত্র থেকে বঞ্চিত হলাম। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে নয়, সিনেমার দর্শক হিসেবে এ কারণে কিছু অতৃপ্তি থেকেই যায়।

মোঙ্গল দেখে থাকলে কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না কিন্তু! না দেখে থাকলে ট্রেলার দেখুন, শিহরন জাগবে নিশ্চিত!

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *