হাসান জামি হাতঘড়ির দিকে তাকালেন, বারোটা বেজে গেছে।
সময় হয়ে গেছে। একটু পরেই আকাশের কোনায় বিমানটা দেখা যাবে। ল্যান্ড করার পর মিনিট পনেরো লাগবে প্রস্তুত হতে। তারপরই আসবে সেই মহেন্দ্রক্ষণ, সুন্দরবন জঙ্গলের জলজ্যান্ত বাঘ দেখবেন তিনি। সেই বাঘ নিয়ে যাবেন চিড়িয়াখানায়। ঐতিহাসিক মুহুর্ত। এই সৌভাগ্য সবার হয় না। উঠে দাড়ালেন তিনি, কোটের বোতাম লাগালেন। যেতে হবে।
এমন নয় যে হাসান জামি কখনো সুন্দরবনের বাঘ দেখেননি বা চিড়িয়াখানায় কোন বাঘ নেই। চিড়িয়াখানায় ডোরাকাটা চামড়ার বাঘ আছে দুই ধরনের। বেশী সংখ্যায় আছে সুন্দরবনের বাঘ, কিন্তু সেগুলো সবই সেকেন্ড জেনারেশনের, চিড়িয়াখানায়ই জন্ম। আরও এক জোড়া ডোরাকাটা বাঘ আছে, সেগুলো প্রথম প্রজন্মের হলেও সুন্দরবনের বাঘ নয়, ওগুলো ভারতের উত্তর প্রদেশের বাঘ, ষোল বছর আগে নিয়ে আসা হয়েছিল।
টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠলেন জামি। গাড়ি সামনের দিকে চলতে থাকলেও জামির মন ছুটলো পেছনের দিকে। এক ঝটকায় সে পৌছুলো পঞ্চাশ বছর পূর্বে। জামি তখন হাই স্কুলের ছাত্র। প্রেজেন্টেশনের একেকটা স্লাইডের মত কতগুলো ঘটনা চোখের সামনে ভেসে গেলো যেন – বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সুন্দরবনের পাশের জমি নির্বাচনের প্রতিবাদে তার চাচ্চুর করা প্রতিবাদ-আন্দোলন। কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরী করা হলে সুন্দরবন থাকবে না, বলেছিলো চাচ্চু। এত বড় একটা বন কিভাবে নেই হয়ে যাবে সেটা অবশ্য জামির মাথায় ঢোকেনি, কিন্তু চাচ্চুর কথা অবিশ্বাসও করেনি। তার বছর দেড়েক পরেই তেল ভর্তি একটা শিপ ডুবে গেল সুন্দরবনের ভেতরেই একটা নদীতে। সেই তেল ছড়িয়ে গেলো ভেতরের খালগুলোতে। বাঘ সরে গেল আরো ভেতরের দিকে, ভারতের ভেতরে। এমন একটা সময় যখন বন ছাড়া বাকী সব জায়গায় বাঘের ছড়াছড়ি – টাকায় বাঘ, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাঘের ভাস্কর্য, খেলোয়ারদেরকে বাঘের সাথে তুলনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও আগের কথা মনে পড়লো জামির যখন সে পচাব্দী গাজীর শিহরণ জাগানো গল্পগুলো শুনেছিলো, সেই সময় সুন্দরবন কত যৌবনবতী ছিল!
বিমানটা যেখানে থেমেছে জামির গাড়ি সেখানেই থামলো। বিশাল একটা লরি এসে দাড়িয়েছে কার্গো বিমানটার সামনে। বাইশ চাকার লরি – গুনে দেখলো জামি। উপরে বিশাল আকারের খাঁচা – বিমানের খাঁচা থেকে এই খাঁচায় আসবে এক জোড়া বাঘ, একটি বাঘ দম্পতি। পঁয়তাল্লিশ কোটি টাকায় আনা বাঘের বেঁচে থাকার সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, যদি টিকে থাকে তাহলে প্রজনন হবে, সেই বাঘকে পরিবারসহ ছেড়ে দেয়া হবে সংরক্ষিত বনে, চোখে চোখে রাখা হবে নিরাপত্তার জন্য। সব সফল হলে তবেই আবার সুন্দরবনের বাঘ পাওয়া যাবে, হয়তো সেই বাঘ পচাব্দী গাজীর দেখা সেই বাঘের মতই হবে।
খাঁচার দরোজা খুলে দুই খাঁচার মধ্যে সংযোগ তৈরী করে দেয়া হল। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলো জামি – কখন আসবে চকচকে ডোরাকাটার রাজকীয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার?