দশ বছর আগেও লেখা প্রকাশ করা বেশ কঠিন কাজ ছিল। লেখা প্রকাশ বলতে তখন দৈনিক-সাপ্তাহিক-মাসিক পত্রিকা, বিভিন্ন সাময়িকী, লিটল ম্যাগ-দেয়াল পত্রিকা ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ ছিল। লেখকের চেয়ে প্রকাশকের সংখ্যা কম হওয়ায় লেখা প্রকাশ হওয়া এবং করা -দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। লেখা প্রকাশ করার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা লেখার গুনগত মান বজায় রাখার ব্যাপারে মনযোগী হতেন, আবার লিখিয়েরাও লেখার সময় প্রকাশের শর্তাবলী মাথায় রেখেই ভালো লেখার চেষ্টা করতেন। যারা এই দুটোর কোনটাই করতে পারতেন না, তারা যা লিখতেন সেটা তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতেন। অবশ্য গাঁটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশের চেষ্টা এখনকার মত তখনকার সময়েও ছিল।
এই পদ্ধতিতে লেখা তৈরী ও প্রকাশের বাইরে কারও কথা থাকতো না তা হতে পারে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সব মানুষ যাদের পেটভর্তি কথা বুদবুদ ফোটায় তারা তাদের কথা প্রকাশের জন্য বেছে নিতেন ‘টি-স্টল’ বা ‘চা-স্টল’। সাহিত্য বাদে বাকী বিষয়াদি বিশেষত সমকালীন রাজনৈতিক-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিজ্ঞ মতামত প্রদর্শনের একটা চেষ্টা সকল চা-স্টলের সকল আড্ডার কারও না কারও মধ্যে থাকত। এই আড্ডার প্রধাণ আলোচক হয়তো সেই আড্ডার প্রধাণ শ্রোতা অথবা অমুক পত্রিকার তমুক কলামের নিয়মিত পাঠক – দুজনের মিশ্রিত মতামতের প্রকাশ আড্ডার অন্যান্য আলোচক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করতো, আলোচকের জ্ঞান-গরিমার প্রতি শ্রদ্ধায় নত হতে উৎসাহিত করত। এ ধরনের আলোচনায় ফলাফল কতটুকু হত সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, কিন্তু এই সকল মতামতের বেশীরভাগই যে প্রাসঙ্গিক তথ্য-প্রমাণবিহীন সেটা বলা যায়। স্বল্পজ্ঞানোৎসারিত এ সকল বক্তব্য একদিক থেকে ভয়ংকর, কারণ তা শ্রোতাকে বিভ্রান্ত করে।
দশ বছর পরে লেখা প্রকাশের সুযোগ সীমাহীন। ওয়েবজগতে ব্লগ আর অনলাইন পত্রিকা লেখা প্রকাশের বিশাল সুযোগ করে দিয়েছে। আমার লেখা কেউ ছাপায় না দেখে আমিই আমার ব্লগে ছাইপাশ ছাপাই – দশ বছর আগে এ জন্য আমাকে গাঁটের টাকা খরচ করে বই ছাপাতে হত – সেদিক থেকে রক্ষা। আবার, কেউ ভালো লিখতে পারলেও খ্যাত ব্যক্তিত্ব না হওয়ার কারণে যথোপযুক্ত জায়গায় লেখা প্রকাশ করতে পারছেন না – এরকম লেখকের সংখ্যাও কম নয়। এ ধরনের লেখকদের জন্য ফেসবুক-ব্লগ বেশ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে। তা সত্ত্বেও, সে যুগের চা-স্টল এখনও চালু আছে, কিন্তু টেকনলজির কল্যাণে তা ঢুকে গেছে হাতের মোবাইল বা টেবিলের কম্পিউটারে। ফলে ‘ওপিনিয়ন প্রোভাইডার’এর সংখ্যা এখন বেড়ে গেছে অনেক বেশী পরিমানে। পর্যাপ্ত জ্ঞান ও চিন্তা-ভাবনার অভাবে সৃষ্ট বিভিন্ন মন্তব্য স্ট্যাটাস হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে শত শত মানুষের মাঝে। এটা ভয়ংকর, দশ বছর আগেরকার চা-স্টলের মন্তব্যের তুলনায়ও বেশী ভয়ংকর।
পড়াশোনা আর চিন্তা-ভাবনার কোন বিকল্প নাই।