আমার বাসায় টেলিভিশন নেই, খবরের জন্য ফেসবুক-ব্লগ এবং পত্রিকার ওয়েবই ভরসা। কিন্তু খবরটা এলো মোবাইলে – গাজী টেলিভিশনের এক প্রোডিউসার বড় ভাই ফোন করে খবরটা দিলেন – সুভাষ দত্ত মারা গেছেন। আজ সকালে। ১৬ নভেম্বর ২০১২ তারিখে। সকাল সাতটায়।
সুভাষ দত্ত স্যারকে নিয়ে আমার একটাই স্মৃতি। ২০০৮ সালে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে কোর্সের সূচীতে দুজন পরিচালকের সাথে কথোপকথন ছিল। তাদের একজন সুভাষ দত্ত। দশটা থেকে ক্লাস শুরু হয়। আমরা সাড়ে ন’টার মধ্যে চলে আসি। চা খাই, আড্ডাবাজি করি। যিনি ক্লাস নেন তিনিও চলে আসেন, তার সাথেও কথাবার্তা হয়।
সেদিন আমাদের আসার আগেই চলে এলেন সুভাষ দত্ত স্যার। ক্লাসের বাইরে ওয়েটিং রুমে বসে রইলেন – কারও সাথে কোন কথা বললেন না। শিক্ষার্থীরা আগ্রহ নিয়ে ‘দাদা কেমন আছেন?’ ‘স্যার কখন এসেছেন?’ প্রশ্ন করেছেন কিন্তু তিনি উত্তর দেন নি। মাথা নেড়েছেন, হেসেছেন, হাতের পাচ আঙ্গুল তুলে দেখিয়েছেন – কিন্তু কথা বলেন নি। আমরা ভেবেছি, বোধহয় অফিসের দায়িত্বে কর্মচারীরা ভালো ব্যবহার করেন নি, অথবা অন্য কিছু। ক্লাস শুরু হল দশটায় এবং তিনি ক্লাসে ঢুকেই প্রথমেই তার শশ্রুমন্ডিত শুভ্র মুখে হাসিতে ভরিয়ে তুললেন, বললেন – ‘আমি সকাল দশটা পর্যন্ত মৌনব্রত পালন করি। তাই কথা বলতে পারিনি।’ রহস্যের সমাধান হল!
সেদিন সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত স্যারের সাথে তার সিনেমা, তার দর্শন, তার পরিকল্পনা ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা বার্তা হয়েছে, আড্ডাবাজি হয়েছে। তিনি বলেছেন তার প্রথম সিনেমা ‘সুতরাঙ’ এর নির্মান প্রসঙ্গে, অরুনোদয়ের অগ্নিসাক্ষী সম্পর্কে, বলেছেন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে তার প্রবেশ সম্পর্কে।
১৯৩০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী থেকে তার জীবন-ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, শেষ করলেন আজ। আর, সিনেমায় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ‘মাটির পাহাড়’ নামের সিনেমায় আর্ট ডিরেকশনের মাধ্যমে। তারপর এহতেশাম পরিচালিত ‘এ দেশ তোমার আমার’ সিনেমায় প্রথম অভিনয়। ১৯৬৩ সালে শুরু করলেন নিজের সিনেমা নির্মানের কাজ। সিনেমার নাম – ‘সুতরাঙ’, নায়িকা – চট্টগ্রামের কিশোরী মেয়ে মিনা পাল ওরফে কবরী।
সত্যজিত রায়ের সিনেমা ‘পথের পাঁচালি’ দেখে অনুপ্রাণিত এই পরিচালকের সেরা ছবি ১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘অরুনোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ । ঠিক কটা সিনেমা বানিয়েছেন এই গুনী পরিচালক – আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না। চিনেচিত্তা সাইট থেকে নিচের তালিকটি পাওয়া গেল।
১৯৬৪ | সুতরাঙ |
---|---|
১৯৬৬ | কাগজের নৌকা |
১৯৬৬ | আয়না ও অবশিষ্ট |
১৯৬৮ | আবির্ভাব |
১৯৬৯ | পালাবদল |
১৯৬৯ | আলিঙ্গন |
১৯৭২ | অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী |
১৯৭৭ | বসুন্ধরা |
১৯৭৮ | ডুমুরের ফুল |
১৯৮০ | নূরী |
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি, পেয়েছেন আরো অনেক পুরস্কার। শোনা গিয়েছিল, বেগম রোকেয়া-কে নিয়ে সিনেমা নির্মানের চিন্তা করছিলেন তিনি। তার সে স্বপ্ন অপূর্নই থেকে গেল।
সুভাষ দত্ত চলে গেলেন। বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ভিত্তি স্থাপনে যারা ইট গেঁথেছিলেন সুভাষ দত্ত তাদের একজন। সুভাষ দত্ত যেভাবে চলে গেলেন সেভাবে চলে যাবেন আরও অনেকে। বাংলার সিরাজউদ্দোলা আনোয়ার হোসেন অসুস্থ্য – কথা বলতে পারেন না, অন্যতম সেরা খল অভিনেতা খলিল অসুস্থ্য। আড়ালে বার্ধ্যক্য অসুস্থ্য হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে আরও কতজন – জানি না। এই মানুষগুলো বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে যে অবদান রেখেছেন তার কোন প্রতিদান হয় না, কিন্তু এরকম নিরবে-নিভৃতে তারা চলে যাবেন সেটাও কাম্য নয়। সুভাষ দত্তকে নিয়ে পরিপূর্ন তথ্য ওয়েবে নেই, পাওয়া যাবে না অন্যদের সম্পর্কেও। তবে কি এভাবেই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাবেন সুভাষ দত্ত এবং অন্যান্য কৃতি সন্তানেরা?
শুভ বিদায় স্যার। আপনার ‘অরুনোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ আমাদেরকে হাজার বছর ধরে বারংবার উজ্জীবিত করবে।
সূত্র:
১. গ্লিটজ-বিডিনিউজ২৪.কম
২. রঙঢঙ
৩. চিনেচিত্তা
৪. একুশেনিউজ
৫. উইকিপিডিয়া
ছবি: বিডিনিউজ২৪.কম
“আয়না ও অবশিষ্ট “ একটি সিনেমার নাম। দুটো আলাদা সিনেমা নয়। সুভাষ দত্তর মামা বাড়ি দিনাজপুরে । সেই সুবাদে তিনি বেশ লম্ব সময় দিনাজপুরে থেকেছেন। সেখানে তিনি জীবিকার জন্যে ও ছবি আকাঁ শিখবার জন্যে সিনেমার ব্যানার আঁকতেন। আমার নাট্যগুরু এবং সেই সময়কার অন্যান্য নাট্য অভিনেতারা তার বন্ধু ছিল। তারা তাকে পটলা বলে ডাকত। সুভাষ দত্তের সাথে আমার একবারই দেখা হযেছিল মুখোমুখি। ৯৮/৯৯ সালের দিকে তিনি দিনাজপুরে এসেছিলেন। আমাদের সংঘঠন নবরূপীতে তাকে নিযে আসর হয় একটা, সেখানেই এসব জানতে পারি। তিনি সামান্য অভিনয় করেও দেখান। এক কালে তিনি থিযেটার কর্মীও ছিলেন। তিনি যখন কথা বলেন তখন মুগ্ধ হযে শুনতে হয়। আমার প্রিয় পরিচালকগুলো আর থাকছে না.. এক এক করে সবাই চলে গেল..
দারাশিকো’র ব্লগে স্বাগতম টিংকু ভাই 🙂
দারুন কিছু নতুন বিষয় জানা গেল আপনার কাছ থেকে। এভাবে আরও অনেকের কাছ থেকে জানা যাবে অনেক কিছু, সব কিছু মিলে এই মানুষটা সম্পর্কে একটা পরিপূর্ন চিত্র তৈরী করা গেলে এই মানুষটি আমাদের মাঝে না থেকেও থেকে যেতে পারেন। কে করবে এই কাজ?
ভালো থাকুন। আবার আসবেন 🙂
আমি আপনের পোস্ট দেইখা জানলাম !!!!!!! খুব দুঃখ লাগলো । আজকের দিনের শুরু যে এমন ১ টা ঘটনা দিয়ে শুরু হবে মনেও করিনি । শুভ বিদায় স্যার । আপনি বেচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে চিরকাল ধরে । :'(
🙁
“তবে কি এভাবেই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাবেন সুভাষ দত্ত এবং অন্যান্য কৃতি সন্তানেরা?
হারিয়ে যেন না যান সেই উদ্যোগ নেয়া জরুরী – এখনি 🙂
সুভাষ দত্ত হারিয়ে যাবেন না।
তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। 🙁
দারাশিকো’র ব্লগে স্বাগতম সোহান।
আমাদের মাঝে তিনি অবশ্যই বেচে থাকবেন, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মগুলোর মাঝে তার বেচে থাকা নিশ্চিত করতে অনেকগুলো কাজ করতে হবে- আমাদেরই।
ভালো থাকুন। আবারও আসবেন 🙂
হয়তো তিনি আর কোনদিন ফিরবেন না এই জগতে। কিন্তু তিনি যেখানেই থাকেন না কেন, আমাদের সিনেমা জগত তাঁকে মনে রাখবে চিরদিন।
তাকে বাংলা সিনেমা মনে রাখতেই হবে।