মনিকা বেলুচির ধর্ষন অথবা একটি অদৃশ্য ছোরা বা বন্দুকের গল্প

মনিকা বেলুচির কথা শুনলেই যে কারও চোখে একটি অনিন্দ্য সুন্দরী অভিনয়ে পারঙ্গম ইতালিয়ান এক অভিনেত্রীর মুখ ভেসে উঠবে এটা স্বাভাবিক। ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মেলেনা সিনেমার দু একটা দৃশ্যও ভেসে উঠতে পারে চোখের সামনে বিশেষ করে কোমড় দুলিয়ে স্কার্ফ পরা মেয়েটি যখন একাকী হেটে যাচ্ছিল আর পুরো এলাকার নানা বয়সী যতসব পুরুষ তাদের চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিল, মহিলারা ঈর্ষা বোধ করছিল এবং সদ্য কৈশোর পেরোনো ছেলেটি বুঝতে পারছিল অন্য অনেকের মতোই এই তরুনীর প্রতি তার একটা অন্যরকম ভালোলাগা তৈরী হচ্ছে।

দুবছর বাদে ২০০২ সালে এই অভিনেত্রী ‘ইরিভার্সিবল’ নামের একটি সিনেমায় অভিনয় করে ব্যাপক আলোচিত এবং অবশ্যই সমালোচিত হন। আলোচনার বিষয়বস্তু সিনেমার প্রায় দশ মিনিট স্থায়িত্বের একটি দৃশ্য – একটি ধর্ষন দৃশ্য। প্রায় অন্ধকার আন্ডারপাস দিয়ে যাওয়ার সময় ছোরা হাতে এক দুবৃত্ত তার পথরোধ করে এবং এই ছোট কিন্তু ধারালো ছোরা গলায় চেপে অ্যালেক্স চরিত্রে রূপদানকারী মনিকা বেলুচিকে ধর্ষন করে। জনমানুষহীন অন্ধকার আন্ডারপাসে গলায় ঠেকানো ছোরাটির কারণে তার ধর্ষিত হওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা ছিল না সেই সময়। একটি নিষ্পাপমুখো ধারালো ছোরার কাছে হারাতে হয়েছিল তার সম্ভ্রম, হারাতে হয়েছিল তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ন সময়।

এদেশে ফেসবুকের প্রচলন ঘটার আগে মোবাইলে হাস্যরসে ভরপুর নানা এসএমএস এর প্রচলন ছিল। সেই সময়ে পাওয়া একটি এসএমএস মনে পড়ে যায়, যেখানে বলা হয়েছিল : “Nobody dies a virgin, cause in the End, life fucks us all”। রম্য হলেও এই কথাটার মানে কিন্তু গভীর, যমদূতের হাতে আছে একটি অদৃশ্য বন্দুক কিংবা ছোরা।

লেখকদের কাছে বারবণিতারা বেশ গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। রূপক অর্থে ব্যবহার করার জন্য বারবণিতাদের ভূমিকা মোটেও কম নয়। এই জনসংখ্যাবহুল, যানজটে ভরপুর, বিষাক্ত-কালিমাপূর্ণ দু:সহ ঢাকা নগরীকে বিন্দুমাত্র ভালো না বেসেও সারা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। মনপ্রাণ খুলে আলাপ করুন তাদের সাথে, শেষ পর্যন্ত আপনাকে সিদ্ধান্তে আসতেই হবে – এই মানুষটির কাছে এই ঢাকা শহর একটি বারবণিতা ভিন্ন কিছু নয়। যতদিন দেয়ার সুযোগ আছে ততদিনই এর গুরুত্ব – এই মানুষটির কাছেও আছে একটি অদৃশ্য বন্দুক।

অফিস ছুটির সময় দৈনিক বাংলার মোড় থেকে খিলগাও ফ্লাইওভার পর্যন্ত একটি রিকশা ভাড়া করার চেষ্টা করুন। দু একজন যদি রাজী হয়েই যায়, দ্বিগুনের বেশী ভাড়া হাকবে সে আপনার কাছে, কারণ ঠিক সেই মুহূর্তে তার কাছে রয়েছে একটি অদৃশ্য বন্দুক। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে মিনারেল ওয়াটার কিনে দেখুন। বোতলের গায়ে ছাপার অক্ষরে ১৭ টাকা দাম লেখা থাকা সত্বেও ২০ টাকা দিতে আপনি বাধ্য, কারণ তার হাতে রয়েছে একটি অদৃশ্য বন্দুক।

বাংলাদেশের সীমান্তে নির্মমভাবে একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরে ‘এসব হত্যা নয়, মৃত্যু’ বক্তব্য প্রদান, অত:পর এদেশে এসে তিস্তা চুক্তির প্রাসঙ্গিক দাবীকে উপেক্ষা করে প্রায় বিনা শুল্কেই এদেশের শারীরীক ও মানসিকভাবে অপরিপক্ক কিশোরীর ন্যায় দুর্বল খোড়া শরীরের উপর দিয়ে বিশাল বিশাল মালবাহী ট্রাকের ততোধিক ভারী চাকা গড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটতেই পারে, কারণ ঠিক সেই মুহূর্তে ভারতের হাতে রয়েছে একটি বন্দুক এবং বাংলাদেশ পরিনত হয়েছে প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি আন্ডারপাসে একাকী অসহায় একটি তরুনী।

এই অদৃশ্য বন্দুক আর ধর্ষনের ঘটনা আমাদের গা সওয়া, কারণ জন্মমুহূর্ত থেকেই ক্রমাগত ধর্ষনের মধ্য দিয়েই আমরা বড় হয়েছি, আরও বড় হব এবং ক্রমাগত ধর্ষন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই একসময় জীবনের কাছে শেষবার ধর্ষিত হয়ে বিদায় নেবো।

হতাশ হবেন না, কারণ আমার আপনার হাতেও রয়েছে একটি অদৃশ্য বন্দুক। মনে করে দেখুন, নিজ নিজ জায়গায় দাড়িয়ে কখন কোথায় আপনি আপনার অদৃশ্য বন্দুকটি ব্যবহার করেন স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য? বন্দুক আমার আপনার সবার হাতেই আছে, যা নেই সেটা হলো জনমানবশূন্য প্রায় অন্ধকার একটি আন্ডারপাসে একাকী অসহায় একটি তরুনী যার গলায় আপনার অদৃশ্য ছোরাটি ঠেকিয়ে অথবা বন্দুকের ঘোড়ায় আঙ্গুল চেপে রেখে আমি আপনি একে একে খুলে নেবো তার সব কটি বস্ত্র, তারপর তার ইজ্জত সম্ভ্রম নিয়ে খেলব চমৎকার একটি লোফালুফি খেলা।

অফ টপিক: (কেন এই গল্প)
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমাদের মা-বাবা-বড় ভাই-বোনরূপী শিক্ষকদের অদৃশ্য বন্দুকের নল থেকে শেষবারের মতো নিজেদেরকে বাচিয়ে রাখার জন্য আমরা মেনে নিয়েছি বিনা কারণে পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত। আমরা বোকা নই, আমরা ভীরু নই, বন্দুকের নলের মুখে দাড়িয়ে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছি কারণ আমরা জানি সতীত্ব-সম্ভ্রম যায় যাক, যৌনাঙ্গ বেচে থাকলেই হয়।

লেখকের নামসহ এই লেখাটি নির্দ্ধিধায় শেয়ারযোগ্য
© Nazmul Hasan Darashiko (www.darashiko.com)

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *