গত সাত ফেব্রুয়ারী অ্যাকাডেমী অ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠানে অস্কার জিতে নিয়ে ক্যাথরিন বিগেলো ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন প্রথম অস্কারজয়ী নারী চলচ্চিত্রকার হিসেবে। ক্যাথরিন নতুন চলচ্চিত্রনির্মাতা নন, ২০০২ সালে তিনি রাশিয়ান সাবমেরিন কে১৯ নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মান করেছিলেন, নাম – কে১৯: দ্য উইডোমেকার। পরিচালনার যোগ্যতা বোঝা যায় তখনই।
সাত বছর পরে তার দ্য হার্ট লকার অস্কার জিতে নিল। বিশাল অর্জন – অন্যতম একটি কারন হলো এটি গতানুগতিক সিনেমার মতো হলিউড নির্ভর ছবি নয়, এটি একটি ‘ইন্ডি’ বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুভি। ক্যাথরিন নিজেই ছিলেন এর প্রযোজক, পরবর্তীতে সামিট এন্টারটেইনমেন্ট এর পরিবেশনার ভার নেয়। মজার ব্যাপার হলো, দ্য হার্ট লকার হলো এপর্যন্ত সবচে’ কম উপার্জনকারী অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র।
দ্য হার্ট লকার মুভির প্রধান চরিত্র জেমস রেনার, সে একটি মিলিটারী বম্ব স্কোয়াড ইওডি (EOD) টিম এর দলনেতা, মোট সদস্যসংখ্যা তিনজন। বাকীদের মধ্যে রয়েছে সার্জেন্ট জে টি স্যানবর্ন এবং স্পেশালিস্ট ওয়েন এলড্রিজ, তাদের কাজ হলো রেডিওতে যোগাযোগ এবং রাইফেলে জেমসকে কাভার দেয়া। মিশন শেষ হবার ৩৮ দিন বাকী থাকতে জেমস দলে যোগ দেয়, কারণ পূর্ববর্তী দলনেতা থমসন বোমা নিষ্ক্রিয় করার সময় বিস্ফোরনে নিহত হন, তার বোমাপ্রুফ ভারী জ্যাকেট তাকে রক্ষা করতে পারেনি।
দ্য হার্ট লকার মুভির চিত্রনাট্য লিখেছে মার্ক বোল। তার বিশেষত্ত্ব হলো তিনি নিজেও এরকম একটি বম্ব স্কোয়াডের সাথে জড়িত ছিলেন, ২০০৪ সালে এবং মুভির সময়কালও ২০০৪। বলা যায়, সে সময় অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকেই মার্ক এই চিত্রনাট্য লিখেছেন। বোধহয় দ্য হার্ট লকারই একমাত্র ওয়ার মুভি যা বম্ব স্কোয়াডকে ঘিরে তৈরী হয়েছে এবং এখানে আমেরিকান সৈন্যদের নায়কোচিত বীরত্বপনাকে বড় করে না দেখিয়ে তাদের অর্ন্তবেদনা দেখাতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তাই বলে আমেরিকান সৈন্যদের বীরত্বপনা পুরোপুরি বাদ দিতেও পারেনি লেখক কিংবা পরিচালক। আর তাই, প্রতিবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। প্রতিবাদ করেছে ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের প্রাক্তন সৈনিকরা। হাফিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবাদপত্র লিখেছেন রিকফ, যিনি ইরাক অ্যান্ড আফগানিস্তান ভেটেরানস অফ আমেরিকা (IAVA) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক।
তিনি যেসব ভুলের কথা দেখিয়েছেন তার প্রায় সবই মিলিটারী কেন্দ্রিক। ২০০৪ সালে যে উর্দি ব্যবহার হতো, সিনেমায় তা দেখানো হয় নি। তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তিনি এর পাশাপাশি বাস্তব যে বিষয়টি তুলে ধরেছেন এবং পরিচালক কিংবা লেখক যে ব্যপারটা পাশ কাটাতে পারেন নি সেটা হলো পৃথিবীর জনগোষ্ঠির নিকট ইরাকের সত্যিকারের চিত্রটা তুলে ধরতে। মাত্র তিন জন সৈন্য দিয়ে তারা বোমা নিষ্ক্রিয় করেছেন, মরুভূমির মাঝে স্নাইপার বন্দুক নিয়ে ইরাকি যোদ্ধাদের প্রতিহত করেছেন, আক্রমনকারীদের পিছু ধাওয়া করেছেন এবং কোন কোন এলাকা শত্রুমুক্ত করার কাজটিও করেছেন।
একটি বম্ব স্কোয়াড যদি সব কাজ করে তাহলে সেনাবহিনীর বাকী বিভাগগুলোর কাজ কি? এটা কি আমেরিকান সৈন্যদের বীরত্বপনা নয়? আমেরিকার মোট জনসংখ্যার এক পার্সেন্টেরও কম লোক এখন ইরাকে অবস্থান করছে, বাকী নিরানব্বই ভাগের নিকট ইরাকের যে পরিস্থিতি তুলে ধরা হচ্ছে তা যদি আরেকটি হলিউডি উপস্থাপনাই হয়, তাহলে অন্যান্য মুভিগুলোর সাথে এর তফাৎটা কোথায়?
আমি জানি না, ইরাকের যোদ্ধারা তাদের দেশমাতৃকা উদ্ধারের জন্য কিশোরদের হত্যা করে তাদের পেটে বোমা ঢুকিয়ে দেয় কিনা – তবে এটুকু বুঝি একটা কিশোর কিংবা একটি শিশুর পেটে বোমা বাধা আর একজন যোদ্ধার পেটে বোমা বাধার মধ্যে বিশাল পার্থক্য আছে – একটা সারা বিশ্বের দর্শককে নাড়া দিতে পারে, অন্যটি হয়তো কাউকেই নয়। সিনেমার একটি টেকনিক, এর বেশী কিছু নয়। তবে এটা প্রশংসনীয় যে ইরাকের যোদ্ধাদেরকে অন্যান্য সিনেমার মতো করে বিশাল শয়তান হিসেবে চিত্রায়িত করার নির্লজ্জ চেষ্টা এখানে করা হয় নি। ইরাক আমেরিকানদের দেশ নয়, সুতরাং ইরাকীরা তাদের দেশ থেকে আমেরিকানদের বিতাড়িত করার জন্য গুপ্ত হামলা চালাতেই পারে।
৩৮ দিন পরে ছুটি হয়েছিল। ফেরার আগে স্যানবর্ন জানিয়েছিল যুদ্ধ তার জন্য নয়, সে আরও কিছুদিন বাঁচতে চায়, সে চায় তারও একটা পুত্র সন্তান জন্ম নিবে, যাকে নিয়ে সে বেচে থাকবে। জেমসও ফিরেছিল, কিন্তু সে ফেরায় কোন আগ্রহ ছিল না, সুন্দরী স্ত্রী কিংবা পুত্রসন্তানের জন্য ভালোবাসার টান ছিল না। কারণটা সে ব্যখ্যা করেছে তার পুত্র সন্তানের নিকট। তার ভালোবাসার বিষয় একটিই – যুদ্ধ। সুতরাং তাকে তার ভালোবাসার কাছে ফিরতে হবে এবং পরবর্তীতে আরও এক বছরের জন্য সে ইরাকে ফিরে যায়।
দ্য হার্ট লকার সিনেমার শুরুতেই একটা বাক্য ছিল, ২০০২ সালের বেস্ট সেলার বই ‘ওয়ার ইজ আ ফোর্স দ্যাট গিভস আস আ মিনিং’ থেকে নেয়া – The rush of battle is a potent and often lethal addiction, for WAR IS A DRUG. বাক্যটি আমেরিকান সরকারকেই নির্দেশ করে, জেমস রেনারকে নয়। আমেরিকান সরকার এখন একটি যুদ্ধাসক্ত পিশাচে পরিণত হয়েছে। সৈন্যদের যন্ত্রনা তারা বুঝতে পারে না, আর তাই বারবার তাদেরকে পাঠায় যুদ্ধ নামক নরকে।দ্য হার্ট লকার যদি সেসব সিদ্ধান্তপ্রণেতার মনে সামান্য প্রভাব বিস্তার করে তবেই এই সিনেমার সার্থকতা।
এই মুভিটার ব্যাপারে আমি অনেক ঝানু মুভিখোররেও দেখসি একটা বায়াজড ধারণা আছে। সবাই বলে এইটাতে নাকি আমেরিকারে মহান দেখাইছে। আমি বুঝিনা তারা এটা কিভাবে বলে। মুভিটার আসল বক্তব্যটা যে জেমস আর তাঁর ছেলের ঐ দৃশ্যটা এইটা না ধরে সবাই ধরে বোম ডিফিউজ করে মহান কাজ করা বা নিরীহ ভালো সৈনিকের বোমার আঘাতে মারা যাওয়াটা। আপনার এই পোস্টটা পেয়ে তাঁদেরকে বোঝানো বেশ সুবিধাই হবে।
ঠিক এই কারণেই এই পোস্টটা লিখেছিলাম। বিভিন্ন মন্তব্য পড়ার পর সন্দেহ হয়েছিল – আমারই বোধহয় বুঝতে ভুল হচ্ছে। যাক, অন্তত: একজন পাওয়া গেল যিনি আমাকে সাপোর্ট করলেন। ধন্যবাদ বস 🙂