মাননীয় কর্তাব্যক্তিগণ, আগস্টের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ ঋণগ্রস্তদের কোন সুবিধা দেবেন কি?

মাননীয় কর্তাব্যক্তিগণ, আগস্টের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ ঋণগ্রস্তদের কোন সুবিধা দেবেন কি?

‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে ভাই, আমি একদম পথে বসে গেছি!’

এক বড় ভাই গত আগস্টের বন্যায় তার মাছের খামারের ক্ষতি সম্পর্কে বলেছেন এই কথা। উনি আরও বললেন, ‘বর্ষাকালে আমি পুকুরের চারদিকে চার ফুট উঁচু করে নেটের বেড়া দেই। বন্যার খবরে আট ফুট উঁচু বেড়া দিছি, কিন্তু মাত্র চার ঘন্টায় পানি বাড়ছে দশ-বারোফুট, বাজারে এত নেটও তো ছিল না। সব মাছ বের হয়ে গেছে।’

আগস্টের বন্যা ভয়াবহ ছিল। অতিবৃষ্টিতে বন্যা হয় কিন্তু আগস্টের বন্যায় এর সাথে যোগ হয়েছিল বিনা নোটিশে ভারতের বাঁধ খুলে দেয়া। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে দশ-বারোফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে ফেনী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী। সদ্য বিদায়ী স্বৈরাচারী সরকারের পতনের জন্য সারা দেশের লোকজন যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, ঠিক একইভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বন্যাদুর্গতদের সাহায্য করেছে সারা দেশের মানুষ।বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন কিনা জানতে চেয়েছিলাম, তার উত্তরেই বলেছেন এ কথা।

কিন্তু বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠার পরিবর্তে আরও বিপদে পড়ে গেছেন তিনি। খামারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। আশা করেছিলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো আর্থিক প্রণোদনা/সুবিধা দিবেন। বরং ব্যাংক প্রতিনিয়ত চাপ দিচ্ছে পাওনা পরিশোধের জন্য। এমনকি নানা ছলাকৌশলও বেছে নিচ্ছে।

ফেনী জেলার একজন মৎস খামার ব্যবসায়ীর ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা সুদে আসলে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৯২ লক্ষ টাকায়। আগস্টের বন্যায় সব হারানোর পরে ব্যাংকের কাছে সময় ও নতুন পুঁজি চেয়েছিলেন। উল্টো ব্যাংক জানিয়েছে, সুদ ও আসলে পরিশোধ না করা হলে বন্ধকী জমি বিক্রির উদ্যোগ নিবে। ভদ্রলোক কিছু সুদ মাফ করার অনুরোধ করলে ব্যাংক মাফ করার সম্ভাবনা দেখিয়ে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত আদায় করে নিয়েছে, বাকীটুকু আদায়ের চাপ দিলেও সুদ মওকুফের কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

আগস্টের বন্যা কতটা বিপর্যয় ঘটিয়েছে তার নজির সোশ্যাল মিডিয়ায় রয়ে গেছে। লাখ লাখ মুরগির মৃত্যুতে নিঃস্ব হয়েছে হাজারো খামারি, মাছের খামার ভেসে গেছে, কৃষক আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথা বাদই দিলাম। সিপিডির গবেষণা বলছে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। কিন্তু এই ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্য, বিশেষতঃ যারা ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণগ্রহীতা ছিলেন, তাদের জন্য তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

আগস্টের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সেপ্টেম্বর মাসে একটি নির্দেশনা জারী করে ঋণের মেয়াদ তিন মাস বাড়িয়েছিল। এছাড়া বিলম্বে পরিশোধের জন্য কোন প্রকার দন্ডসুদ আরোপে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। বন্যায় ক্ষতির তুলনায় এই সুবিধা নগন্য। সর্বস্বান্ত কৃষক-খামারি কিভাবে এই কিস্তির টাকা শোধ করবে সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদাসীন থেকে গেছে।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যোগ্য লোকেরা দায়িত্ব পেয়েছেন। অনেক বছর বাদে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে আসীন হয়েছেন একজন অর্থনীতিবিদ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ ও ঋণগ্রহীতাদের দুর্দশা তারা ভালোমতই বুঝবেন জানি কিন্তু সেরকম পদক্ষেপ দেখতে না পাওয়া হতাশাজনক। অথচ তিক্ত হলেও সত্য, পতিত সরকারের সময়কার বন্যায় বাংলাদেশ ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য উদারহস্তে সহায়তা প্রদান করেছিল। কিছু উদাহরণ দেই।

২০২২ সালে এরকম আকস্মিক বন্যা হয়েছিল সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ইত্যাদি জেলায়। সে সময় জুন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে দুবার নির্দেশনা জারী করা হয়। সেখানে ২০২১ সালে শুরু হওয়া ৩ হাজার কোটি টাকার রিফাইন্যান্স স্কীমের আওতায় ২০০ কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্যে ব্যাংকের অব্যাবহৃত স্থিতির ২০ শতাংশ বন্যাকবলিত জেলায় বিতরণের নির্দেশনা দেয়া হয়। পরবর্তীতে একে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়। এই ঋণে সুদের হার মাত্র ৪ শতাংশ। এছাড়া ছয়মাস পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি ঋণ আদায় স্থগিত রাখা হয় এবং বিনা ডাউনপেমেন্টে কৃষি ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা প্রদান করা হয়। এমনকি আগের কিস্তি বকেয়া থাকা সত্ত্বেও নতুন ঋণ দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।

এর আগে ২০২০ সালে প্রধাণত উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো সহ পূর্ববঙ্গের জেলাগুলোতে বন্যা হয়। এসময় জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ একুশটি জেলার নামোল্লেখ করে ঋণগ্রহীতাদের কল্যাণে বিভিন্ন সুবিধা সম্বলিত নির্দেশনা জারী করে। এর মধ্যে নতুন করে ঋণ প্রদান, পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত কৃষি ঋণ আদায় স্থগিতকরণ, সহজ শর্তে পুনঃতফসিলকরণ, নতুন করে সার্টিফিকেট মামলা না করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল।

প্রায় একই রকম নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল ২০১৯ সালের জুলাই, ২০১৭ সালের এপ্রিল ও ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। লক্ষ্যণীয়, উল্লিখিত সকল সুবিধাই মূলত কৃষি ঋণগ্রহীতাদের জন্য। কৃষি ঋণের পরিমান সাধারণত কয়েক হাজার টাকা থেকে কয়েক লক্ষ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। অপেক্ষাকৃত বড় আকারের বিনিয়োগ হয় এসএমই উদ্যোগে।

বিগত বছরগুলোতে এসএমই প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, নানা বয়সী উদ্যোক্তারা বড় অংকের বিনিয়োগ করেছেন কৃষি নির্ভর বিভিন্ন প্রকল্পে। ফলে এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক সহায়তা প্রয়োজন। এজন্য বিগত সময়ের মত ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান, ঋণের কিস্তি পরিশোধে সময় প্রদান, সুদের হার কমানো, পুনঃতফসিল করা ইত্যাদি সহায়তা প্রদান করা উচিত। তবে, করোনা মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্থদের প্রনোদনা সহায়তা প্রদানের নামে যেভাবে হাজার কোটি টাকা লুটপাটের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল তেমন ব্যবস্থা যেন না থাকে সেটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

আশা করি মাননীয় উপদেষ্টা সহ অন্যান্য কর্তাব্যক্তিগণ এ বিষয়ে বিলম্বে হলেও নজর দিবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *