দাওয়াতে যাচ্ছি। মাঝে দেশের অন্যতম বিখ্যাত একটি মিষ্টির চেইনশপে ঢুকে দুই কেজি মিষ্টি কিনলাম। কাউন্টারে মূল্য পরিশোধের সময় বললাম – ভ্যাট চালান দিয়েন। উনি জানালেন – মেশিন যিনি ব্যবহার করেন তিনি বাইরে গেছেন। তারপর, একটি স্লিপে হাতে লিখে ধরিয়ে দিলেন।
মিষ্টি কেনার এই ঘটনার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সরকার মিষ্টিতে ভ্যাটের পরিমাণ বাড়ানোর নির্দেশনা দিলেন। এরকম বহু পণ্যেই ভ্যাতের হার বাড়ানো হয়েছে। ভ্যাট এমন ধরণের কর যেটা সর্বশেষ ব্যাবহারকারীর উপরে গিয়ে পড়ে, ফলে আমার মতো ভোক্তারা বাড়তি মূল্যটুকু দিবেন। বিগত সরকারের যথেচ্ছ লুটপাটের বোঝা টানতে গিয়ে আমাদের জান যায় যায় অবস্থা,অন্তর্বর্তীকালীন বর্তমান সরকার মৃত্যু নিশ্চিতের জন্য বোঝা আরেকটু বাড়িয়ে দিলো।
বাংলাদেশে ভ্যাট চালু হয়েছিল ১৯৯১ সালে। চালুর অল্প কিছুদিন পরেই সরকার বুঝতে পারে – বাংলাদেশের মত দুর্নীতিপরায়ন দেশে ভ্যাটই হলো রাষ্ট্রীয় আয়ের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। ভ্যাটের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয়ের এক তৃতীয়াংশ অর্জিত হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের মোট রাজস্ব আয় ছিল ৩ লক্ষ ১ হাজার কোটি টাকা, এর মধ্যে ভ্যাটের মাধ্যমে আয় হয় ১ লক্ষ ৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ধারণা করা হয়, ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ এই অর্থের কাছাকাছি।
‘পকেট থটস’ নামে আমার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ এবং টেলিগ্রাম চ্যানেল রয়েছে। নিমন্ত্রণ রইল।
কয়েকদিন আগে বণিকবার্তা একটি প্রতিবেদনে ভ্যাট বিভাগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বরাতে জানিয়েছে ‘মাঠ পর্যায়ে ভ্যাট ব্যবস্থাপনার বড় ত্রুটি হলো ফিক্সড ভ্যাটের প্রচলন’। প্রকৃতপক্ষে ফিক্সড ভ্যাট বলে কিছু নেই। তবে যে সমস্ত দোকানে ক্রয় বিক্রয়ের হিসাব রাখা হয় না, যেমন পাড়ার মুদী দোকান, সেখানে সরকারের কোন কর্মকর্তা একটি ভ্যাটের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন, এটাই ফিক্সড ভ্যাট নামে পরিচিত। বলা বাহুল্য, ভ্যাট নির্দিষ্ট করে দেয়ার দায়িত্বের এই কর্মকর্তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘বেড়ায় ক্ষেত খাওয়া’র নজির সৃষ্টি করেন।
যে ধরণের পণ্যগুলোর মূল্য নির্ধারিত এবং সাধারণত প্যাকেজড অবস্থায় কারখানা থেকে বের হয় সেগুলোর ভ্যাট ফাঁকির উপায় আছে কিনা জানা নেই, প্রতিষ্ঠানের চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টরা এ বিষয়ে ভালো জানেন। কিন্তু মিষ্টি, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রায় সকল বিক্রেতাই ভ্যাট ফাঁকি দেন, সহায়তা করেন রাজস্ব আদায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা। তারা দোকান থেকে যৎসামান্য ভ্যাট আদায় করেন, কিছুটা পকেটে নেন আর বিনিময়ে দোকানদারকে বাকীটা ছাড় দেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভোক্তা ভ্যাট পরিশোধ করলেও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যায় না, তবে অল্প কিছু ক্ষেত্রে ভোক্তাও উপকৃত হন। যেমন: আবাসিক হোটেল। কক্সবাজারের বেশিরভাগ হোটেল তাদের কাস্টমারকে দেয়া ডিসকাউন্ট সুবিধা ভ্যাট চালান না দেয়ার মাধ্যমে সমন্বয় করে নেন।
২০১৫ সালে বাংলানিউজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ইকবাল ক্যাটারিং এর ভ্যাট ফাঁকির কথা জানিয়েছিল। দৈনিক ২০ লক্ষ টাকার খাবার বিক্রি করলে দৈনিক ভ্যাটের পরিমাণ আড়াই লক্ষ টাকা, অথচ সেখানে প্রতিষ্ঠানটি মাসে মাত্র ৫০ হাজার টাকার ভ্যাট দেয়। আশা করি এই ঘটনা থেকে ভ্যাট ফাঁকির বর্তমান পরিমাণ সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে।
এই যে কোটি কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হচ্ছে প্রতিদিন, এ থেকে প্রতিকারের জন্য সরকারের কোন দৃশ্যমান মেকানিজম নাই। বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস বসানোর উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। ভ্যাট চালানের বিপরীতে পুরস্কার দিয়েও ফলাফল পায়নি। ভ্যাট আদায় নিশ্চিতের জন্য ভোক্তার কাঁধেই দায়িত্ব চাপিয়েই যেন দায় সেরেছে।
ভ্যাট ফাঁকির অন্যতম উদাহরণ হিসেবে মিষ্টির দোকানের কথা ভ্যাট প্রচলনের পর থেকেই বলা হচ্ছে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ভ্যাট সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একটি টিভিসি বানিয়েছিলেন। সেখানেও মিষ্টির দোকানে দেয়া ভ্যাটের বিপরীতে চালানের কপি সংগ্রহের উপদেশ দেয়া হয়েছিল। আজকেও কোন এক স্থানে ‘ভ্যাট চালান বুঝে নিন’ স্টিকার দেখলাম।
প্রশ্ন হলো – ভ্যাট দেয়ার পর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার দায়িত্ব কেন জনগণকে কাঁধে নিতে হবে যেখানে ভ্যাটের বোঝার চাপেই তাদের নাভিশ্বাস উঠে যায়? যেখানে সরকার জনগণের দেয়া ভ্যাটের সম্পূর্ণটা আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে আদায় নিশ্চিতের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিয়েই মিষ্টি, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি খাতে ভ্যাট বাড়ানোর কী যুক্তি থাকতে পারে?
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো – ভ্যাট চালান চাওয়ার পরও না পেলে এর প্রতিকারের কোন সুনির্দিষ্ট পন্থা নেই। এনবিআর এর ওয়েবসাইটে মূসক প্রশ্ন পাতায় বলা হয়েছে,
বিক্রিত পণ্যের সঙ্গে ভ্যাট চালান প্রদান করা বিক্রেতার দায়িত্ব, একই সঙ্গে ক্রেতার দায়িত্ব যথাযথ ভ্যাট চালান বুঝে নেয়া। যদি বিক্রেতা কোন কারনে ভ্যাট চালান প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করে তাহলে বিক্রেতা কেন ভ্যাট চালান প্রদান করছেন না তার যথাযথ কারন উপস্থাপন করবেন। কারণ, যদি ভ্যাট চালানপত্র সঠিকভাবে নেওয়া হয়, এটা নিশ্চিত হয় যে ভোক্তার প্রদেয় ভ্যাট সরকারী কোষাগারে জমা হয়েছে। অথচ, যদি বিক্রেতা ভ্যাট চালান প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করে, সেক্ষেত্রে ক্রেতা বিষয়টি ভ্যাট কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে পারেন, ইহা অনলাইনে অথবা নিকটতম ভ্যাট কর্তৃপক্ষকে সরাসরি জানাতে পারেন।
যে পাতায় এই পরামর্শ রয়েছে সেখানে অনলাইনে জানানোর কোন লিংক দেয়া নেই, হয়তো অন্য কোন পাতায় রয়েছে – সেটা খোঁজার আগ্রহ কয়জনের থাকবে? কেউ যদি অভিযোগ দেন তাহলে তার প্রেক্ষিতে কাজ হলো কিনা তা জানার উপায় কি রয়েছে? আর অভিযোগ প্রমাণের জন্য যদি সশরীরে হাজির হয়ে বা নাম-পরিচয়ের বিস্তারিত তথ্য দেয়, তাহলে পরবর্তী ঝুঁকি মোকাবেলা করবে কে?
প্রশ্ন অনেক, কিন্তু উত্তর জানা নেই। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতেও কেউ বাধ্য থাকে না। এ কারণেই ক্ষমতার পালাবদল হয়, কিন্তু জনগণের ভাগ্যের বদল হয় না। স্বৈরাচারি সরকারও জনগণের গলায় ভ্যাটের করাত চালায়, বিপ্লবী জনগণ যাকে এনে বসায় সেও গলা কাটতে পিছপা হয় না।