কেন চাই ইসলামিক ব্যাংকিং ও প্রতিষ্ঠান আইন

কেন চাই ইসলামিক ব্যাংকিং ও প্রতিষ্ঠান আইন

সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে নবনিযুক্ত গভর্নর গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলেছেন, ইসলামী ব্যাংক ব্যতীত অন্যান্য ছোট ছোট ইসলামী ব্যাংকগুলো একীভূত করে আরও একটি বড় শক্তিশালী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক তৈরি করা হবে।[] পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকগুলোর একটি ছাড়া সবগুলোই একটি গোষ্ঠীর মালিকানাধীন ছিল এবং আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে ডুবতে বসেছে বিধায় একীভূত করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো যায়। তবে যেহেতু ইসলামিক ব্যাংকিং শাখা এবং উইন্ডো হিসেবে আরও অনেকগুলো ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে ইসলামিক ব্যাংকিং প্রচলিত রয়েছে এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, সেহেতু ইসলামিক ব্যাংকিং এর উন্নতিকল্পে ইসলামিক ব্যাংকিং ও প্রতিষ্ঠান আইন কেন চাই সে বিষয়ে কিছু কথা বলা উচিত।

ইসলামিক ব্যাংকিং বলতে বর্তমানে সারা বিশ্বে যা প্রচলিত রয়েছে তা মূলত শরীয়াহসম্মত ব্যবসায়িক লেনদেনের পরিবর্তিত রূপ। যেহেতু রাসূল (স) এর যুগে আলাদা ভাবে কোন ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু ছিল না, তাই পারস্পরিক লেনদেন ও বিনিয়োগের জন্য প্রচলিত কুরআন এবং হাদীসের নির্দেশনাগুলোকে অনুসরণ করেই ইসলামিক ব্যাংকিং এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিনিয়োগের উপর সুদ নয় বরং ব্যবসায়ের মুনাফা ও ঝুঁকির অংশিদারিত্ব ইসলামিক ব্যাংকিং এর অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচিত।

জনসাধারণের মধ্যে বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকিং এর অন্যতম সমালোচনাও এই মুনাফার ভাগাভাগি বিষয়ে। লাভ-লোকসানের অংশিদারিত্ব বা মুশারাকা পদ্ধতিতে যদি ইসলামিক ব্যাংক পরিচালিত হয় তাহলে বিনিয়োগগ্রহীতা (ঋণগ্রহীতা) ক্ষতিগ্রস্থ হলে ব্যাংক কেন তার ভাগ বহন করে না – এই অভিযোগ প্রায়শঃই শুনতে পাওয়া যায়। যদিও ইসলামিক ব্যাংকগুলো সাধারণত মুদারাবা-মুশারাকা বা লাভ-ক্ষতি ভাগাভাগির শর্তে বিনিয়োগ প্রদান করে না, বরং ক্রয়-বিক্রয় বা মুরাবাহা, বাই মুয়াজ্জল ইত্যাদি এবং ইজারা পদ্ধতি অনুসরণ করে, মুদারাবা-মুশারাকা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ কেন করে না সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

এর উত্তর পাওয়া যায় বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকিং এর পথপ্রদর্শক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা থেকে। ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান তার ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা বইয়ে উল্লেখ করেছেন – প্রতিষ্ঠার পর মুশারাকা পদ্ধতিতেই বিনিয়োগ প্রদান করা হয়েছিল বটে কিন্তু দেশের আইন ও কিছু বাস্তব সমস্যার কারণে এই পদ্ধতি থেকে সরে আসতে হয়।[২] ইসলামিক ব্যাংকিং এর গবেষকরা দেখিয়েছেন, অংশিদারী পদ্ধতিতে বিনিয়োগগ্রহীতাদের মধ্যে বিনিয়োগের অর্থের সদ্ব্যবহারের চেয়ে লোপাটে বেশি আগ্রহ, ফলে জনগণের আমানতের নিরাপত্তার স্বার্থেই মুদারা-মুশারাকা পদ্ধতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো।

ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতিতে বিনিয়োগ নিয়েও দেশের ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনা রয়েছে। নিজস্ব কোন পণ্য না থাকা এবং কেবল কাগজে-কলমে ক্রয়-বিক্রয়ে নিয়োজিত থেকে প্রকারান্তরে নগদ অর্থ সরবরাহ করার অভিযোগ রয়েছে এই ধারার ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংগুলোর নিজস্ব গোডাউন-শো রুমের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়ের কার্যক্রম থাকলেও এদেশে তা এখনও চালু হয়ে উঠেনি।

তবে, সারা দেশে সুদ ভিত্তিক ও সুদবিহীন পদ্ধতিতে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত কিস্তিতে পণ্য বিক্রেতা হিসেবে পরিচিত। ইলেক্ট্রনিক্স গৃহসামগ্রী থেকে শুরু করে ব্যাটারিচালিত রিকশা-সিএনজি, এমনকি ফ্ল্যাট-প্লট বিক্রয়ে নিয়োজিত এ সকল প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মেয়াদে শূণ্য থেকে তিন অংকের সুদেও পণ্য বিক্রয় করছে।

কেন চাই ইসলামিক ব্যাংকিং ও প্রতিষ্ঠান আইন

সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাপ্তরিক কাজে ভ্রমণের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা যায়। ব্যাটারিচালিত একটি রিকশা ভাড়া করে একজন যানবাহন বিক্রেতার সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলাম। ব্যবসায়ী ভদ্রলোক জানালেন এক লক্ষ টাকা ডাউনপেমেন্ট জমা দিয়ে একটি সিএনজি অটোরিকশা কিস্তিতে কিনতে গেলে প্রয়োজন হবে ছয় লক্ষ সত্তর হাজার টাকা, তবে নগদ অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে পাঁচ লক্ষ বিশ হাজার টাকা হলেই চলবে।

ফেরার পথে রিকশা চালক ছেলেটির সাথে আলাপে সে জানিয়েছিল, এই রিকশাটির মূল্য বাবদ তাকে পরিশোধ করতে হবে দশ মাসে এক লক্ষ সাতাশি হাজার টাকা, অর্থ্যাৎ মাসে প্রায় বিশ হাজার টাকা। অথচ ঢাকায় নগদে কিনলে এই রিকশার দাম পড়ে এক লাখ পনেরো থেকে পঁচিশ হাজার টাকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে রিকশা চালিয়ে মাসে বিশ হাজার টাকা কামানো সম্ভব নয় জেনেও সে এই ঝুঁকি নিয়েছে।

হিসাব করে দেখলাম, কিস্তিতে কিনতে গিয়ে ক্রেতারা পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ মুনাফা প্রদানের ঝুঁকি নিছে। এটা তাদের কাছে অপেক্ষাকৃত বেহতর, কারণ মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনলে সুদের পরিমাণ পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি পড়বে। অথচ ইসলামিক ব্যাংক বা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনলে প্রদেয় মুনাফার হার দাঁড়ায় সর্বোচ্চ চব্বিশ শতাংশ, ঋণের মেয়াদের ক্ষেত্রেও চাপ কম পড়ে।

এই ধরণের প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় এনে গ্রাহক স্বার্থ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতিশীলতা আনয়নের জন্য ইসলামিক প্রতিষ্ঠান আইন জারী ও বাস্তবায়ন করা উচিত। অন্যদিকে, ইসলামিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো যেন ইসলামী বিনিয়োগ ও ক্রয়-বিক্রয়েরর প্রকৃত পদ্ধতি তথা মুদারাবা, মুশারাকা এবং বাঈ-এর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয় সেজন্য প্রয়োজন ইসলামী ব্যাংকিং আইন। সকল ইসলামিক ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে শরীয়াহর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য চাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে কেন্দ্রীয় শরীয়াহ বোর্ড।

প্রকৃত ইসলামিক লেনদেন ও ব্যাংকিং বাস্তবায়নের জন্য ইসলামিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলো পরস্পরের সহযোগী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এজন্য ইসলামিক পদ্ধতিতে ক্রয়-বিক্রয়ে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি)-এর আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এর ফলে গ্রাহকের ঋণ ও পরিশোধের তথ্য সহ ডেটাবেজ তৈরি হবে যা গ্রাহকের ঋণ পরিশোধে সদিচ্ছা ও নিয়মানুবর্তিতা নিরূপনে সহায়ক হবে। মুদারাবা-মুশারাকায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ঝুঁকি নিরসনে গ্রাহকের ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের ইতিহাস (ক্রেডিট এন্ড রিপেমেন্ট হিস্ট্রি) কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

প্রকৃতপক্ষে শুধু ইসলামিক ব্যাংকিং নয়, বিনা জামানত ও সহজ শর্তে ক্ষুদ্র ঋণ ও বিনিয়োগ প্রদানের জন্য বিভিন্ন ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ, ক্রয় ইত্যাদি এমনকি বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা গ্রহণে ব্যয়ের তথ্য সম্বলিত একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ তৈরির পদক্ষেপ নেয়া হলে শুধুমাত্র ইসলামিক ব্যাংকিং ও প্রতিষ্ঠানই নয়, মূলধারার প্রতিষ্ঠানগুলোও উপকৃত হতে পারবে।

সারা বিশ্বের মুসলিম প্রধান দেশগুলো ছাড়াও অমুসলিম প্রধান দেশেও ইসলামিক ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স নিয়ে গবেষণা এবং প্রয়োগ চলছে। লন্ডনে ইসলামিক ফাইন্যান্স নিয়ে পৃথক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, হংকং এও বিভিন্ন ধরণের কাজকর্ম চলছে।[] মূলধারার ব্যাংকিং এর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য ইসলামিক ব্যাংকিং এ শরীয়াহভিত্তিক নানা রকম প্রোডাক্ট চালু করা হয়েছে যার অনেকগুলো বাংলাদেশেও ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু ইসলামিক ব্যাংকিং এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ গাইডলাইন এবং বিদ্যমান কোম্পানী ও ব্যাংক আইনে কতিপয় ধারায় বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং ও লেনদেনের বিস্তৃত কার্যক্রমকে সুসংহত ও পরিচালনা করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি বিদ্যমান আইনের আওতায় থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে শরীয়াহর ব্যত্যয় এড়ানোও প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে সম্ভব হয় না।

ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। ইসলামিক ব্যাংকিং এবং লেনদেনের সত্যিকারের তাৎপর্য লাভের জন্য একটি পরিপূর্ণ ইসলামিক ব্যাংকিং ও প্রতিষ্ঠান আইন জারী করার এখনই উপযুক্ত সময়। আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি এড়িয়ে যাবেন না।

বণিকবার্তায় প্রকাশিত

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *