বিশ্বের প্রাচীনতম রেস্তোরাঁ

বিশ্বের-প্রাচীনতম-রেস্তোরাঁ-সেন্ট-পিটার-স্টিফ্সকুলিনারিয়াম

খাই খাই করো কেন, এসো বস আহারে
খাওয়াবো আজব খাওয়া ভোজ কয় যাহারে

সুকুমার রায় তাঁর বিখ্যাত ছড়ায় প্রাচীনতম রেস্তোরাঁ সম্পর্কে কিছু বলেননি, কিন্তু নানা দেশের আজব সব খাবারের কথা বলে গিয়েছেন, নতুন করে সেগুলো উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। তা সত্ত্বেও, বর্তমানকালে খাওয়া যখন বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম এবং যে কোন উপলক্ষ্য উদযাপনে ‘ট্রিট’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তখন যেখানে খাওয়া হয় তার গল্পও করা উচিত। বাসা বাড়িতেই আমরা সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর খাবার খেলেও বেড়াতে এবং ‘ভালো কিছু’ খেতে আমরা নামকরা রেস্টুরেন্টগুলোতে ছুটি। তাই, বিভিন্ন খাবারের পাশাপাশি খাবারের দোকানও একসময় বিখ্যাত হয়ে উঠে।

রেস্তোরাঁ বিখ্যাত হয়ে উঠে নানা কারণে, তবে খাবারের স্বাদ ও মান হলো প্রধানতম কারণ। অনেক সময় বিখ্যাত লোকদের পদচারণার কারণেও বিখ্যাত হয়ে উঠে অনেক রেস্টুরেন্ট। দীর্ঘ সময় খাবারের ব্যবসায়ে টিকে থাকলেও বিখ্যাত হতে পারে কেউ কেউ। টিকে থাকাটা জরুরী কারণ ওহাইও ইউনিভার্সিটর গবেষকরা বলেন, শতকরা ষাট ভাগ খাবারের দোকান চালু হবার প্রথম বছরেই বন্ধ হয়ে যায়, পাঁচ বছরের মধ্যে বন্ধ হয় শতকরা আশি ভাগ। শত শত বছর ধরে টিকে রয়েছে এমন রেস্তোরাঁকে সেক্ষেত্রে বিখ্যাত না বলে উপায় কি?

বিশ্বের প্রাচীনতম রেস্তোরাঁর কয়েকটির পরিচয় তুলে ধরা যাক।

বিশ্বের প্রাচীনতম রেস্তোরাঁর একটি হঙ্ক ওয়ারিয়া
বিশ্বের প্রাচীনতম রেস্তোরাঁর একটি হঙ্ক ওয়ারিয়া

সবরিনো ডি বতিন (Sobrino de Botin)

স্পেনের মাদ্রিদে অবস্থিত এই প্রাচীনতম রেস্তোরাঁর বয়স আর কদিন বাদেই পাঁচশ বছর হবে৷ চালু হয়েছিল সেই ১৭২৫ সালে। জ্যাঁ বতিন নামের একজন ফরাসী ভদ্রলোক স্ত্রীর সাথে মিলে এই রেস্তোরাঁটি চালু করেছিলেন। তখন এর নাম ছিল কাসা বতিন (Casa Botin)। ভদ্রলোক নিঃসন্তান ছিলেন, তাই তার মৃত্যুর পর তার ভাতিজা/ভাগ্নে এর মালিকানা লাভ করেন এবং নাম পরিবর্তন করে সবরিনো ডি বতিন রাখেন। স্প্যানিশ শব্দ সবরিনো মানে ভাতিজা/ভাগ্নে। সেই থেকে সবরিনো ডি বতিন ক্ষুধার্ত মানুষদের তৃপ্ত করে আসছে।

সবরিনো ডি বতিন কিন্তু পৃথিবীর প্রাচীনতম রেস্টুরেন্ট নয়। তা সত্ত্বেও এই খাবারের দোকানটি গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছে। কারণ কি? এটিই একমাত্র রেস্তোরাঁ যেটি শুরু থেকেই চালু রয়েছে, এমনকি যেখানে চালু হয়েছিল সেখানেই রয়েছে এবং ভেতরের কাঠামো প্রায় আগের মতই রয়েছে। প্রচলিত আছে – এই ভোজনালয়ের চুলার আগুন কখনোই নিভানো হয়নি।

বিখ্যাত লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখায় এই রেস্টুরেন্টটির কথা রয়েছে। সেখানে তিনি সবরিনো ডি বতিনের একটি স্পেশাল ডিশের বর্ণনা দিয়েছেন। উপন্যাসটির নাম ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’। এছাড়া প্রখ্যাত থ্রিলার লেখক ফ্রেডেরিক ফরসাইথ সহ আরও কয়েকজন লেখকের লেখায়ও এই রেস্টুরেন্টের বর্ণনা রয়েছে বলে জানা যায়।

হোয়াইট হর্স টেভার্ন ( White Horse Tavern)

আমেরিকার রোড আইল্যান্ডে অবস্থিত হোয়াইট হর্স টেভার্নকে আমেরিকার সবচেয়ে পুরাতন রেস্তোরাঁ, সরাইখানা এবং বার হিসেবে গণ্য করা হয়। অবশ্য ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, এটি কেবল রেস্তোরাঁ ছিল না, বরং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

হোয়াইট হর্স টেভার্ন যে ভবনে অবস্থিত সেটি ১৬৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৬৭৩ সালে উইলিয়াম মায়েস নামের এক ভদ্রলোকের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। তখন একে আরো বড় করে তৈরি করা হয় এবং সরাইখানা চালু করা হয়।

আকারে বিশাল হওয়ার কারণে ভবনটি আদালত, টাউন হল, এসেম্বলি ভবন হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়ে এটি ব্রিটিশ ও আমেরিকান সৈন্যদের বাসস্থান হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। বেশ অনেকদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পরে মেরামত করে ১৯৫৭ সালে হোয়াইট হর্স টেভার্ন পুনরায় চালু করা হয়। তখন থেকে রেস্তোরাঁ এবং বার হিসেবে আজও চালু রয়েছে হোয়াইট হর্স টেভার্ন।

লা ট্যুর ডি’আরহেন্ট (La Tour d’Argent)

এনিমেশন সিনেমা ‘রাটাটুয়ি’র কথা মনে আছে যেখানে একটি ইঁদুর রান্না করতে ভালোবাসে এবং একটি রেস্তোরাঁর শেফ হয়? বলা হয় সিনেমার রেস্তোরাঁটি এই লা ট্যুর ডি’আরহেন্ট-কে মাথায় রেখে তৈরি। বিশ্বের প্রাচীনতম রেস্টুরেন্টগুলোর একটি লা ট্যুর ডি’আরহেন্ট। ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত এই রেস্তোরাঁ ফ্রান্সের প্রাচীনতম রেস্তোরাঁ।

বিশ্বের প্রাচীনতম রেস্তোরাঁ সেন্ট পিটার স্টিফ্সকুলিনারিয়াম
বিশ্বের প্রাচীনতম রেস্তোরাঁ সেন্ট পিটার স্টিফ্সকুলিনারিয়াম

প্রচলিত আছে যে ১৫৮২ সালে তৈরি এই প্রাচীনতম রেস্তোরাঁয় রেস্টুরেন্টে ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ হেনরি খাওয়া দাওয়া করতেন। তবে এই কথার কোন সত্যতা নেই। এমনকি, যে স্থানে রেস্তোরাঁটি স্থাপিত সেটি সেসময় নীচু এলাকা ছিল, ফলে এই তথ্য নিয়ে সন্দেহ রয়ে যায়। রাজা চতুর্থ হেনরি না খেলেও অনেক বিখ্যাত মানুষ এই রেস্তোরাঁয় খেয়েছেন। এদের মধ্যে উড়োজাহাজ আবিষ্কারক রাইট ভাতৃদ্বয় রয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো – সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটি উপন্যাসে এই রেস্তোরাঁটির উল্লেখও রয়েছে।

হংক ওয়ারিয়া (Honke Owariya)

বিশ্বের প্রাচীনতম রেস্তোরাঁগুলোর একটি আমাদের এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত। জাপানের কিয়েটোতে অবস্থিত এই রেস্টুরেন্টটি ১৪৬৫ সালে জাপানের ওয়ারি অঞ্চলে কনফেকশনারি শপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে তৎকালীন সম্রাটের নির্দেশে কিয়েটোতে স্থানান্তরিত হয়। এই রেস্তোরাঁয় বিখ্যাত জাপানিজ খাবার সোবা রাইস কেক, সোবা নুডুলস বিক্রি করা হয়।

এই রেস্টুরেন্টটি বিখ্যাত হয়ে উঠার পেছনে অন্যতম কারণ সম্ভবত রাজপরিবার এবং উপসনালয়ের সাথে যোগযোগ। জেন ধর্মাবলাম্বীদের কিছু উপাসনালয় বা মন্দির এই রেস্তোরাঁ থেকে খাবার নিচ্ছে বহু বছর ধরেই। উইকিপিডিয়ার তথ্য মোতাবেক – এই রেস্টুরেন্টের বর্তমান মালিক ষোলতম পুরুষ।

সেন্ট পিটার স্টিফস্কেলার (St. Peter Stiftskeller)

বিশ্বের প্রাচীনতম রেস্তোরাঁটি অস্ট্রিয়ার সালজবার্গে অবস্থিত। ৮০৩ খ্রিস্টাব্দের নথিতে এই রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার ভিত্তিতে একে সবচেয়ে প্রাচীন রেস্তোরাঁ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটি মূলত একটি গীর্জার অভ্যন্তরে অবস্থিত খাবারের দোকান। প্রাচীনতম এই রেস্তোরার মূল ভবন অবিকৃত থাকার কথা নয়, বিভিন্ন সময়ে একে মেরামত করা হলেও এর ভেতরের খাবারের জায়গাটি প্রায় আগের মতই আছে।

বিশ্বের প্রাচীনতম রেস্তোরাঁয় কাল্পনিক ভ্রমণ এখানেই সমাপ্ত হচ্ছে। সত্যিকারের অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য বাস্তবে বেড়ানোর কোন বিকল্প নেই। একটি প্রশ্ন রেখে যাই – বাংলাদেশের প্রাচীনতম খাবারের দোকান কোনটি সেটা কি চিহ্নিত করা গিয়েছে?

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *