শোনা গল্প।
বাংলাদেশে সিনেমার শ্যুটিং এ প্রথম নাকি ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছিল ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ সিনেমাতে। ভারত থেকে একটা ক্রেন নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু সেই ক্রেন কিভাবে ব্যবহার করা হবে কেউ জানে না। নানা জনে নানা মতামত দিলো। কোনভাবেই সেই ক্রেনের ব্যবহার ঠিক করা যাচ্ছে না। পরিচালক তখন উপস্থিত ছিলেন না, দায়িত্ব কলাকুশলীদের হাতে। বেশ চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল এবং সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক সিনেমার হিরো এবং হিরোইনকে ক্রেনের উপরে তুলে দেয়া হলো !পরিচালক মশাই এসে তাদেরকে নামিয়ে জানালেন, মানুষ নয় ক্যামেরা বসবে ওখানে।
ক্রেন শটের সংজ্ঞা হলো এমন শট যা নেয়ার জন্য ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে। ক্রেন কি জিনিস? এফডিসিতে ঢোকার পরই সামনের মাঠে যা স্তুপীকৃত করে রাখা হয়েছে সেটাই ক্রেন। সাধারণত আমাদের দেশে যে ক্রেনগুলো ব্যবহার করা হয় সেটা পুরোনো আমলের। ক্রেনের মাথায় ক্যামেরাম্যানসহ ক্যামেরা বসার ব্যবস্থা। পরিচালক বসার ব্যবস্থা্ও থাকে কোন কোন ক্রেনে। যেহেতু, কিছুদিন আগ পর্যন্তও ফিল্ম ক্যামেরাতে কোন মনিটর ব্যবহার করার সুযোগ ছিল না (বাংলাদেশে), তাই শট নেয়ার সময় পরিচালককে অবশ্যই বসতে হতো ক্যামেরাম্যানের পাশে।
এরকম একটা ক্রেন দেখুন
বর্তমানে এ ধরনের ক্রেন ব্যবহার কমে আসছে, কারণ আরও আধুনিক ক্রেন পা্ওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশেই রিমোট ক্রন্ট্রোলড ক্রেন ব্যবহার হচ্ছে। এই ধরনের ক্রেনের মাথায় শুধু ক্যামেরা থাকে, রিমোট ক্রন্ট্রোলের সাহায্যে তা নিয়ন্ত্রন করা হয়।
এ ধরনের একটি ক্রেন দেখুন।
কখন সিনেমায় ক্রেন ব্যবহার করা হবে সেটা নিতান্তই পরিচালকরে নন্দনভাবনার উপর নির্ভর করে। সাধারণত লঙ টেক নেয়ার সময় ক্রেন শট ব্যবহার করা হয়, অনেক কিছু একবারে পর্দায় তুলে আনা সম্ভব হয়। তানভীর মোকাম্মেলের ‘লালন’ সিনেমায় বেশ চমৎকার একটা ক্রেন শট আছে যেখানে নদীতে নৌকা বেয়ে লালনের আখড়ায় কিছু লোক আসে – ক্রেন প্রথমে নদীতে নৌকা, তারপর ঘাটে ভিড়ানো এবং তারপর আখড়ার ছাদ বেয়ে উঠানে এসে নামে যেখানে নৌকার আরোহীরাও এসে দাড়ায়। সাধারণভাবে এখানে বেশ কিছু ‘কাট’ এর প্রয়োজন হতো, কিন্তু ক্রেন শটের দরুন বেশ চমৎকার একটি গ্রহনযোগ্য শটে পরিণত হয়েছে।
অপর্না সেনের ‘ফিফটিন পার্ক এভিনিউ’ সিনেমার শেষ শটটি একটি ক্রেন শট – এক ধরনের বিষন্নতা, হতাশা ফুটে উঠে সেই শটে।
ক্রেন এর একটা ছোট ভার্সন আছে, একে বলে জিব আর্ম। আজকালকার নাটক, মিউজিক ভিডিওতে এর ব্যবহার দারুন। কেন? জিবআর্মে ক্যামেরা একবার সেট করে নিলে, পাচটি টেক একবারেই নেয়া যায়, ফলে পাচবার ক্যামেরা পরিবর্তন করার সময় বেচে যায় – তাছাড়া দেশী মিউজিক ভিডিও এবং নাটকে নান্দনিকতা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না, গল্পটা বোঝা গেলেই হলো – সুতরাং জিব আর্ম মাস্ট। দেখে নিন একটি জিব আর্ম।
ক্রেন শট একসময় হলিউডের দখলে ছিল, ‘হাই নুন’ নামের সেরা ওয়েস্টার্ন সিনেমাতে ক্রেন শটের ব্যবহার বিখ্যাত হয়ে আছে, পরবর্তীতে সব দেশেই ক্রেনশটের ব্যবহার চলে আসে। ফলে, সত্যিকারের সৃষ্টিশীল নির্মাতাদের পাশাপাশি আনাড়িদের হাতেও ক্রেন পৌছে যায় – এবং অপব্যবহার শুরু হয়। বাংলাদেশে, যা বলেছিলাম, এই অপব্যবহারটা চোখে পড়ার মতো।
ক্রেন শটের ব্যবহার দর্শককে পর্দায় আটকে রাখে, যদিও এই আটকে রাখার কারণটা দর্শক বুঝতে পারেন না। দুটো মিউজিক ভিডিও দেখুন, ক্রেন শটের মহাত্ম বুঝতে পারবেন। প্রথমেই পড়শী এবং আরেফিন রুমীর গান ‘তোমারই পরশ’
এই গানটিতে ক্রেন শটের ব্যবহার বেশী নেই, তবে যে অংশগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে, লক্ষ করুন সেগুলোই দারুন লেগেছে।
এবার কোলকাতার সিনেমা ‘লভ’ থেকে একটা গান দেখুন, টাইটেল – ‘পৃথিবীটা অনেক বড়’
খেয়াল করেছেন কি এই গানটার পুরোটাই একপ্রকার ক্রেন শট ব্যবহার করে নেয়া হয়েছে? এ কারনেই গানটার ভিজ্যুয়ালাইজেশন চমৎকার।
নান্দনিক ক্রেন শটের ব্যবহার দেখা যায় ১৯৫৮ সালে ওরসন ওয়েলস নির্মিত একটি সিনেমা টাচ অব এভিলস এর শুরুর শটে। দেখে নিন –
ক্রেন শটের যথেচ্ছ ব্যবহারের কোন নমুনা দেখতে চান? রিঙ্গো পরিচালিত এই ‘লভ’ সিনেমাটিই দেখে ফেলুন।
ভালো লেখা। মুভি রিভিউয়ের পাশাপাশি এইসব টেকনিক্যালি আলোচনা ভালো লাগছে। বেশ কাজের জিনিসও বটে।
রিঙ্গোর যে কয়টা কাজ দেখেছি জঘন্য লেগেছে। এই মুভিটেও দেখেছি। রিঙ্গো বানিয়েছে তা জানতাম না। এটা তো বিখ্যাত লাভ স্টোরি মুভির নকল। আর ‘পৃথিবী অনেক বড়ো’ এই গানটা প্রিয় বাপ্পা মজুমদারের বলেই জানি। এখানে কে গাইছে। শুনতে বেশ বিশ্রী লাগছে।
শুভ কামনা রইল।
ও আচ্ছা এই গানের লিরিকে পরিবর্তন করা হয়েছে।
রিঙ্গোর কাজের সাথে তেমন পরিচয় নাই, সে যখন দেশে ছিল, তখনকার আর্ক ব্যান্ডের ভিডিও ‘সুইটি’ দেখে বেশ ভালো লেগেছিল। শুনলাম সে নাকি প্রায় ১৩ বছর ধরে বিজ্ঞাপন সিনেমা বানাচ্ছে, এক দুটো সিনেমাও বানিয়েছে ইদানিং।
সিনেমাটা আমারও ভালো লাগে নাই, তাছাড়া এটা যে নকল সেটা জানা ছিল না, আপনাকে ধন্যবাদ সুজন ভাই 🙂
খুব ভালো লাগলো। তবে আনাড়ি শব্দটা বাদ দিলে ভালো লাগতো। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ সৈনিক,
অ্যামেচার শব্দের বাঙলা করতে গিয়ে আনাড়ি শব্দের প্রয়োগ, অন্য কোন উদ্দেশ্য নয়। 🙂
দারুন হইসে নাজমুল!
কিপিটাপ!!
বেসিক টেকনিক্যাল সবগুলা জিনিস নিয়া যদি বাংলায় এরকম পোস্ট আসে আরও, মোটামুটি ভালো একটা রিসোর্স হয়ে দাঁড়াবে জিনিসটা।
ঠিক এইরকম একটা চিন্তা থেকেই এই ধরনের পোস্ট লিখা শুরু, কাইয়ুম ভাই। চলবে আশা করি। আপনি শুধু মাঝে মাঝে ইন্সপায়ার করে যাবেন।
🙂
এসব টেকনিক্যাল দিকগুলোর পাশাপাশি, হলিউডের আপডেট ফিল্ম টেকনোলজি নিয়ে পোস্ট দিলে আমাদের নতুন কিছু জানা হয়। ধন্যবাদ।
একজনের পক্ষে তো সব সম্ভব না, কয়েকজন মিলে যদি এগিয়ে আসা যায়, তবে দারুন একটা ব্যাপার হবে। চেষ্টা করে দেখুন না।
আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে ইনশাল্লাহ। 🙂
নতুন কিছু জানলাম। আপনাকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ জাহিদ, আসবেন মাঝে মধ্যে 🙂
দারুণ লাগল।
মোটামুটি জানতাম কিন্তু এত গুছিয়ে বুঝতাম না।
পড়ে খুব ভাল লাগ্লো।
এই পোস্টে আসলে তেমন টেকনিক্যাল কিছু আলোচনা করা হয় নাই, সামান্য আপডেট আরকি:)
আপনাকেও ধন্যবাদ 🙂
মুভি রিভিউয়ের পাশাপাশি এইসব টেকনিক্যালি আলোচনা জব্বর হইছে।
ইদানিং এ টাইপের পোস্ট দিচ্ছেন দেখা যাচ্ছে যা খুবই উপকারি।
ধন্যবাদ
চালিয়ে যান
একটা এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছি, সে কারণেই এই পোস্ট।
যা দেখছি তাতে চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ পাচ্ছি বেশ। 🙂
valo laglo…utsahito hoite iccha kortese!!!!
উতসাহিত হ্ওয়ার জরুর আছে, হতে বাধা কি?
ভাল লাগল লেখা। একটা কথা, আপনি কি তানভীর স্যারের স্টুডেন্ট?
বুঝে ফেলেছেন তাই না? আমি সরাসরি তানভীর স্যারের ছাত্র নই, তবে ফিল্ম হিস্ট্রী নিয়ে তার দুটো লেকচারে পার্টিসিপেট করার সুযোগ আমার হয়েছিল – ব্যাস এটুকুই।
ভাই সাহিত্য ক্যাফে নামে একটা (http://www.sahityacafe.com/. ) ম্যাগাজিনে সিনেমা বিষয়ক লেখা খুজছি। আপনি তো নিয়মিতি সিনেমা নিয়ে লেখেন। আমার জন্য কি লেখো দিতে পারেন? আমার email address ujjalmc@gmail.com, cell: 01716003911, মেইল বা ফোনে জানালেেই হবে।
সত্যি অসাধারণ লেখা। টেকনিক্যাল বিষয়ে এত সুন্দর উপস্থাপনা সচরাচর দেখা যায়না। আপনার সাথে আড্ডা দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছিনা, মুভি আড্ডায় দেখা হবে নিশ্চয়ই।
:p
মুভি আড্ডা মিস করা যাবে না – তাহলে আমারে কেউ ছাড়বে না মনে হয়। তবে ভাইয়া, আড্ডাবাজিতে আমি কিন্তু খুবই কাচা – অপদার্থ টাইপের। আগেই বলে রাখলাম, পড়ে হতাশ হবেন না তবে 🙂
দারাশিকো’র ব্লগে স্বাগতম 🙂
ফেবু থেকে দৌড়াইতে দৌড়াইতে চইলা আসছি। ক্রেনএর ব্যাপারটা বুঝছি, কিন্তু জিবআর্ম মাথার উপ্রে দিয়া গেল। পাঁচটা টেক একবারে নেওয়া বা আলাদা আলাদা নেওয়ার মাহাত্য বুঝলামনা
হাপিয়ে গেছেন নিশ্চয়ই? একটু বিশ্রাম নিন – এই সুযোগে পুরানো পোস্টগুলাও পড়ে নিতে পারেন 🙂
ধরুন একটা সিন শ্যুট করা হচ্ছে। মোট পাচ ধরনের শট নেয়া হবে – একটা টপ অ্যাঙ্গেল, একটা লো অ্যাঙ্গেল, একটা নরমাল, একটা ডানদিক থেকে আরেকটা বাম দিক থেকে। আপনি যদি ট্রাইপডের উপর রেখে ক্যামেরা নিয়ন্ত্রন করতে চান, তবে পাচ ধরনের শটের জন্য পাচবার ক্যােমরা সেটআপ করতে হবে। কিন্তু লাইটিঙ ফাইনাল করে সেখানে একটি জিব আর্ম ব্যবহার করুন – জীবআর্মের শরীর নড়াবার কোন দরকার হবে না, কেবল হাতটিকে নড়াচড়া করেই আপনি পাচটি শট নিয়ে নিতে পারবেন। বোঝা গেল?
আরও দেখুন – জিব আর্ম ট্রলি/ডলি ইত্যাদির সুবিধা একাই সার্ভ করছে। জুম ইন আউটের জন্যও িক দারুন সাহায্য করছে। হয়তো আরও সুবিধা আছে – মাঠে নামলে জানা যাবে সেগুলো। এই তো – ভালো থাকুন ইকরাম উল্যাহ 🙂