ট্রু গ্রিট এবং রুস্টার কগবার্ন বিষয়ক তিনটি ওয়েস্টার্ন

ট্রু গ্রিট বললেই সবাই ২০১০ সালের কোয়েন ব্রাদার্স এর সিনেমার কথা বুঝে। কিন্তু এই সিনেমাটি যে একই নামের আরেকটি সিনেমার রিমেক সেটা খুব কম লোকই জানবে। সিনেমার নায়ক রুস্টার কগবার্ন সম্পর্কে খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল তার স্রষ্টার কথা এবং আরও দুইটি সিনেমার নাম। সংক্ষেপে সেটাই তুলে ধরতে চাই।

সিনেমার প্রধান চরিত্র রুস্টার কগবার্ন একজন মোটাসোটা, বয়স্ক, রুক্ষভাষী এবং ভীষণ মদখোর ডেপুটি মার্শাল যে কিনা ইন্ডিয়ান টেরিটরি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে এবং সেখানে লুকিয়ে থাকা অপরাধীদের ধরতে সিদ্ধহস্ত। সমস্যা হলো এক চোখে পট্টি বাঁধা মার্শাল রুবেন কগবার্ন বেশিরভাগ অপরাধীকেই ঘোড়ার পিঠে উপুর করে বেঁধে ঝুলিয়ে আইনের সামনে হাজির করে। এই রুস্টার কগবার্নকেই ভাড়া করে চৌদ্দ বছরের কিশোরী ম্যাটি রস তার বাবার হত্যাকারী টম চ্যানিকে ধরে আনার জন্য।

টম চ্যানি পুরাতন অপরাধী, নাম পালটে ম্যাটির বাবার ফার্মে কাজ নিয়েছিল। হত্যার পর সে ম্যাটির বাবার হেনরী রাইফেল, ঘোড়া এবং অর্থসম্পদ নিয়ে পালিয়ে নেড পিপার গ্যাং এর সাথে যোগ দেয়। টমকে দীর্ঘদিন ধরে তাড়া করা টেক্সাস রেঞ্জার লা-বিফ যুক্ত হয় ম্যাটি-কগবার্নের সাথে এবং দীর্ঘ এ্যাডভেঞ্চারের পর ম্যাটি সফল হয়। ট্রু গ্রিট সিনেমার গল্প এটুকুই।

অন্য মার্শালের পরিবর্তে কগবার্নকে ভাড়া করার পেছনে দৃশ্যমান কারণ একটাই -কগবার্নের ট্রু গ্রিট বা সংকল্পের দৃঢ়তা। তবে কিশোরী ম্যাটির গ্রিট-এর পরিচয়ও আমরা পুরো সিনেমা জুড়ে পাই। বাবার হত্যাকারীর শাস্তি দেয়ার জন্য সে যেভাবে এই কঠিন এবং দুর্গম যাত্রায় শামিল হয় সেটা অনন্য। ফলে, ট্রু গ্রিট কেবল কগবার্নের নয়, ম্যাটিরও গ্রিট-এর প্রমাণ।

ট্রু গ্রিট বনাম ট্রু গ্রিট

আসল ট্রু গ্রিট সিনেমায় জন ওয়েইন এবং রিমেকে জেফ ব্রিজেস

২০১০ সালে কোয়েন ব্রাদার্স যে ট্রু গ্রিট পরিচালনা করেছিলেন তার প্রধান চরিত্র রুস্টার কগবার্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জেফ ব্রিজেস, টেক্সাস রেঞ্জার চরিত্রে ম্যাট ডেমন এবং ম্যাটি চরিত্রে হেইলি স্টেইনফিল্ড। অন্যদিকে, ১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মূল সিনেমায় এই চরিত্রগুলো করেছিলেন যথাক্রমে জন ওয়েইন, গ্লেন ক্যাম্পবেল এবং কিম ডারবি।

দুই সিনেমার মধ্যে তুলনা করা আমার উদ্দেশ্য নয় – তবে কিছু আলাপ করা যাইতে পারে। যেমন কগবার্নের চোখের পট্টি। জন ওয়েইনের পট্টি বাম চোখে থাকলেও জেফ ব্রিজেস্ট এর পট্টি ডান চোখে। এক চোখে জনের যে এক্সপ্রেশন সেইটা জেফ-এর চোখে পাই নাই। না পাওয়ার কারণ অবশ্য পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গী। কোয়েনের কগবার্ন অনেক বেশি গম্ভীর, সিনেমায় উপস্থাপিত পরিবেশটাও অনেক বেশি রুক্ষ, প্রতিকূল।

সম্ভবত পুরাতন সিনেমার তুলনায় রিমেকে ম্যাটি চরিত্রটি ছাপিয়ে গেছে। আগের ম্যাটি রস কিশোরী কিন্তু বাবার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য রিমেক সিনেমার ম্যাটির মতো যথেষ্ট গ্রিট-সম্পন্ন নন। নতুন ম্যাটি যেভাবে বাকী বিষয়গুলো ডিল করেছে – অসাধারণ।

কোয়েন ব্রাদার্সের সিনেমায় কিছু সিগনেচার বিষয় আছে। এর অন্যতম হল সংলাপ। ২০১০ সালের ট্রু গ্রিট সিনেমায় এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। প্রচুর কথাবার্তা, এইসব সংলাপের মধ্য দিয়ে কগবার্নের অতীত সহ বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়।

আসল ট্রু গ্রিট সিনেমার পরিচালক ছিলেন হেনরি হ্যাদাওয়ে, তিনি অনেকগুলো ওয়েস্টার্ন জনরার সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন। ঐ সময়ের আমেরিকান-ওয়েস্টার্ন সিনেমাগুলোর বৈশিষ্ট্য এই সিনেমায় উপস্থিত, যেমন – এখানে পরিবেশ অনেক বেশি সবুজ, গাছপালা-ঘাস ইত্যাদি দেখা যায়, স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন সিনেমায় যে রুক্ষতা দেখা যায় ততটা নেই এই সিনেমায়। রুস্টার কগবার্নও অনেকটা বন্ধুবৎসল। হাশিখুশিও।

দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন কিংবা ৩:১০ টু ইউমা সিনেমা সহ আরও অনেক সিনেমার রিমেকের ক্ষেত্রে যেটা দেখেছি – কাহিনীর মূলভাবই অনেকক্ষেত্রে পাল্টে গেছে। আনন্দের বিষয়, কোয়েন ব্রাদার্স তাদের নিজস্ব স্টাইলকে গুরুত্ব দিলেও এই জায়গায় হাত দেননি। ফলে নতুন এবং পুরাতন দুই সিনেমাতেই মোটামুটি একই ধরণের গল্প পাওয়া যায়, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংলাপও প্রায় একই। তবে, কোয়েন ব্রাদার্স বাকী দুই চরিত্র – ম্যাটি এবং লা-বিফের পরিণতি নিয়ে কিছু স্বাধীনতা নিয়েছেন – যা বলে দিয়ে সিনেমা দেখার মজা নষ্ট করতে চাচ্ছি না।

ট্রু গ্রিট মূলত একটি ওয়েস্টার্ন উপন্যাস যার লেখক চালর্স পর্টিস। সিনেমা মুক্তির মাত্র এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় এবং জনপ্রিয়তা পায়। মার্শাল রুস্টার কগবার্ন চরিত্রে জন ওয়েইন অভিনয় করে অস্কার জেতায় এই চরিত্রটি স্থায়ী জনপ্রিয়তা পায় বলা চলে। জানিয়ে রাখি, ওয়েস্টার্ন সিনেমার স্বর্ণযুগে জন ওয়েইন খুবই জনপ্রিয় নায়ক ছিলেন। সম্ভবত এ কারণেই রুস্টার কগবার্নকে নিয়ে আরও দুটি সিনেমা নির্মিত হয়েছিল যার প্রথমটি মুক্তি পায় ১৯৭৫ সালে, নাম ‘রুস্টার কগবার্ন’, অন্যটি ১৯৭৮ সালে টিভির জন্য নির্মিত সিনেমা ‘ট্রু গ্রিট: আ ফারদার এডভেঞ্চার’।

রুস্টার কগবার্ন

রুস্টার কগবার্ন সিনেমায়ও জন ওয়েইন অভিনয় করেন, যদিও সিনেমার পরিচালক পাল্টে স্টুয়ার্ট মিলার হাজির হন। এই সিনেমার গল্প মূল উপন্যাসিক চার্লস পর্টিসের নয়, তার চরিত্রকেই গল্পের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। এখানেও তিনজনের একটি দল – রুস্টার কগবার্ন ছাড়াও আছে এক ইন্ডিয়ান কিশোর ‘ওল্ফ’ এবং কগবার্নে চেয়ে বয়সে বড় এক সিস্টার ইউলা (অভিনয়ে ক্যাথেরিন হেপবার্ন)।

অরিজিনাল ট্রু গ্রিট সিনেমায় যেখানে রুস্টার কগবার্নের হাতে নিহতের সংখ্যা ১৫/২০ জন, এই সিনেমায় সেটা বেড়ে ৬০/৬৫টিতে পৌঁছেছে। এ অপরাধেই তার মার্শাল ব্যাজ কেড়ে নেয়া হয় কিন্তু একই সময়ে নাইট্রোগ্লিসারিনের চালানসহ আর্মিদের একটি ওয়াগন লুট করে হক গ্যাং। ইন্ডিয়ান টেরিটরিতে হওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে আবার ব্যাজ ফেরত দেয়া হয় কগবার্নকে এবং প্রথমে একাই গ্যাং এর পিছু নিলেও একসময় বাধ্য হয়ে ওল্ফ এবং ইউলার সাথে জোট বাঁধে রুস্টার কগবার্ন।

এই সিনেমার গল্প থেকেই স্পষ্ট, ট্রু গ্রিট এর তুলনায় এই সিনেমায় এডভেঞ্চার বৈশিষ্ট্যটি প্রকট। গ্যাং এর হাত থেকে ওয়াগন উদ্ধার করা এবং সেটাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ ছিল না এবং খরস্রোতা নদীতে নৌকা চালানোর বড় একটি দৃশ্যও এখানে ছিল।

রুস্টার কগবার্ন নিয়ে নির্মিত টিভি সিনেমা ট্রু গ্রিট: আ ফারদার এডভেঞ্চার-এর কোন কপি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কেবল জানি, এখানে রুস্টার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ওয়ারেন ওটস এবং এখানেও ম্যাটি রস চরিত্রের উপস্থিতি রয়েছে।

সব মিলিয়ে মার্শাল রুবেন জে ‘রুস্টার’ কগবার্ন চরিত্রটি তৃপ্তিদায়ক। জন ওয়েনের সিনেমাগুলো পরিবার নিয়ে দেখার মত উপভোগ্য। আসলে সে সময়ের সিনেমাগুলো সেভাবেই নির্মাণ করা হতো। তবে, এরকম একটা সুগঠিত চরিত্রকে নিয়ে আরও কিছু সিনেমা নির্মিত হতে পারতো – আউটলদের তাড়া করার যে এডভেঞ্চার সেটা রুস্টার কগবার্নের মধ্যে পেতে মন্দ লাগতো না। অবশ্য সেই সুযোগ ফুরিয়ে যায়নি এখনও – জেফ ব্রিজেস যদি আবারও রুস্টার কগবার্ন হতে রাজী হন, তাহলে হয়তো আরও ভালো কোন সিনেমা আমরা পেতে পারি।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *