মোবাইলে ইংরেজি পত্রিকা স্ক্রল করে যাচ্ছিলাম, তখন শিরোনামটা নজরে এলো। ‘একুশে বইমেলায় প্রীতির বই নিষিদ্ধ’। প্রত্যেক বইমেলাতেই কিছু বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে, নিষিদ্ধের দাবী করা হয়। বিস্তারিত পড়ে জানা গেলো এবার নিষিদ্ধ বইয়ের নাম ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’, লেখকের নাম জান্নাতুন নাঈম প্রীতি।
জান্নাতুন নাঈম প্রীতি কে?
জান্নাতুন নাঈম প্রীতির কোন লিখাই, হোক সেটা বই কিংবা ব্লগ-ফেসবুকে প্রকাশিত, পড়েছি বলে মনে করতে পারি না। তবে তার প্রোফাইল ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম শর্টফিল্মমেকার আসিফ খান এর ‘পোস্টার’ ছবিতে তিনি কাজ করেছিলেন। আসিফ খানের সাথে সেইসময় টুকটাক কথা হয়েছিল, পোস্টার টিমের কয়েকজনকেও চিনতাম। সে হিসেবে প্রীতিকেও হয়তো দেখে থাকতে পারি।
প্রীতি কেন নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে সেটা তার লিখায়, বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখক পরিচিতি এবং ফেসবুকে এবাউট পাতায় স্পষ্ট। প্রীতি ক্লাস টু-তে থাকতেই গল্প লিখে পুরস্কার পেয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন গ্রন্থ ও বইয়ের জন্য পুরস্কৃত হয়েছে। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড, এ্যাঙ্কর প্রথম আলো গল্প লেখা প্রতিযোগিতার খেতাব ইত্যাদি। তার গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের মধ্যে একটি হলো শিশুতোষ বই ‘বাংলাদেশ নামটি যেভাবে এলো’। এছাড়া, একাডেমিক পড়াশোনায় কৃতিত্বের জন্য তিনি জাতীয় পর্যায়ে, বিভাগীয় পর্যায়ে পুরস্কার পেয়েছেন বলেও জানা গেলো। এই স্বীকৃতি ও সাফল্য স্বাভাবিকের তুলনায় আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে কারণে সেটা হলো তার বয়স। ১৯৯৬ সালে জন্ম নেয়া প্রীতির জন্য অনেক বেশীই।
জন্ম ও যোনির ইতিহাস বইতে কী আছে
বাংলাদেশে বই নিষিদ্ধের পেছনে যে কারণগুলো সাধারণত বিদ্যমান থাকে, প্রীতির জন্ম ও যোনির ইতিহাস-এ তার সবগুলোই আছে। বইয়ের নামের মধ্যেই স্পষ্ট যে, প্রীতি তার আত্মজীবনীতে অবাধ যৌনতার গল্প বলবে। আত্মজীবনী হওয়ার কারণেই আরও এমন সব মানুষের নামও আসবে যাদেরকে দেশের মানুষ এক নামে চিনবে। এর ফলে আলোচনা হবে এবং বইয়ের কাটতি বাড়বে। হয়েছেও তাই।
প্রীতি তার যৌনজীবনের স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন জন্ম ও যোনির ইতিহাস বইতে, বিশেষ করে বিভিন্ন সময়ে যাদের সাথে তিনি শয্যাসঙ্গী হয়েছেন। এদের মধ্যে আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ এবং মনপুরা চলচ্চিত্রের পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম এর নাম রয়েছে। এছাড়া, অন্যান্যরা কার সাথে কে শুয়েছে তারও উল্লেখ করেছেন। ফলে গিয়াসউদ্দিন সেলিমের শয্যাসঙ্গী হিসেবে জয়া আহসান এবং পরীমনির নাম যেমন এসেছে, তেমনি টেকনাফে ওসি প্রদীপ-এসআই লিয়াকতের ক্রসফায়ারে নিহত মেজর রাশেদ সিনহার সাথে শিপ্রা দেবনাথের নামও এসেছে। আরও এসেছে বিখ্যাত কবি হেলাল হাফিজ সহ অনেকের নাম।
এটুকুই। বিভিন্ন জায়গায় প্রীতির এই জন্ম ও যোনির ইতিহাস বইকে যেভাবে অশ্নীল সাহিত্য, চটি ইত্যাদি বলে পরিচিত করানো হচ্ছে সেটা যথেষ্ট সৎ নয়। যারা এ ধরণের অশ্লীল সাহিত্য পড়তে আগ্রহী, তারাও বেশ হতাশ হবেন নিশ্চিত। এর চেয়েও অশ্লীল বর্ণনা লিখে বহু বাংলাদেশী সাহিত্যিক বিখ্যাত হয়েছেন, নির্দিষ্ট এক ঘরানার মানুষের কাছে পূজনীয় হয়েছেন। যেমন হুমায়ূন আজাদ। নারীদের মধ্যে তসলিমা নাসরিন ছাড়া আর কারও নাম জানি না। প্রীতি এই দুজনকেই পছন্দ করেন, হয়তো তাদের পথ অনুসরণ করতেও চেয়েছেন।
প্রীতির দৃষ্টিভঙ্গী
প্রীতির জন্ম ও যোনির ইতিহাস বইয়ের মজার দিক হলো প্রেম-যৌনতা বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গী। যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে বাংলাদেশের স্বাভাবিক মানুষের যে অবস্থান ও রক্ষণশীলতা, প্রীতির তা নেই। ফলে বিবাহ ব্যতিরেকেই কারও সাথে বিছানায় যাওয়াকে তিনি মোটেও অন্যায় মনে করেন না। তবে বিছানায় যাওয়ার স্বপক্ষে তিনি যুক্তি হিসেবে প্রেমের সম্পর্ক থাকা উচিত বলে মনে করেন। তার বইয়ে উল্লিখিত সকল পুরুষের দোষ হিসেবে তিনি প্রেমহীন শারীরিক আকর্ষণকে চিহ্নিত করেছেন।
ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে একদিকে যেমন তার রক্ষণশীলতাহীনতা রয়েছে, অন্যদিকে এমন সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রেমের পূর্ব শর্ত জুড়ে দিয়ে তিনি রক্ষণশীল অবস্থান নিচ্ছেন। যে সকল পুরুষ তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন বা করতে আগ্রহী হয়েছেন, তারা কিন্তু এ দুয়ের কোন ক্ষেত্রেই রক্ষনশীল নন। শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রীতি রক্ষণশীল না হয়ে রুচিশীল হতে পারতেন, তাহলে শারীরিক সম্পর্কের পেছনে প্রেমের অভাব উপলব্ধি করে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতেন না।
প্রীতির জন্ম ও যোনির ইতিহাস বইতে আরও যা থাকা উচিত – সমকামিতা, নাস্তিকতা, ধর্ম-বিরোধিতা – সবই আছে। সুযোগ পেলেই তিনি ধর্ম, বিশেষতঃ ইসলাম ধর্ম, এবং ধর্ম প্রচারক ও ধর্মের অনুসারীদেরকে কটাক্ষ করেছেন, আক্রমণ করেছেন। এছাড়া সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের দূর্নীতি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে গ্রেফতারি এড়াতে পালিয়ে বেড়ানো এবং ফ্রান্সে আশ্রয় গ্রহণ করার ঘটনাবলী উল্লেখ রয়েছে।
প্রীতির মত চিন্তাভাবনা যারা ধারণ করেন তারা ধর্মীয় নির্দেশনা, মতামত ও অনুসাশনের বিরোধী হবেন এটাই স্বাভাবিক। মোটাদাগে বাংলাদেশের সামাজিক রীতিনীতি ধর্মীয় অনুসাশনের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়েছে। ফলে প্রীতিদের অনৈতিক ও অবৈধ যৌনতার বিষয়ে সমাজ ও ধর্ম সবসময়ই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এবং এ কারণেই প্রীতিদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতেও পরিণত হয়।
প্রীতি কী করতে পারতেন
প্রীতি নিজেকে সাহসী মানুষ হিসেবে মনে করেন। নিজের জীবনের নোংরা বিষয়াবলী এবং সমাজের নোংরামি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা যদি সাহসের পরিচায়ক হয় তাহলে সিটি কর্পোরেশনের সুইপাররা এদেশের সবচেয়ে সাহসী হতো। প্রীতিকে খুব একটা দোষও দিতে পারি না। এদেশের পত্রিকাগুলো বিনোদন জগতের নায়িকার সংক্ষিপ্ত কাপড় পড়া বা কাপড় না পড়াকে যেভাবে সাহসের পরিচায়ক হিসেবে উপস্থাপন করে তাতে তাতে যে কারও এ ধরণের মানসিকতা গড়ে উঠতে পারে।
ব্যক্তিগত খায়েশ পূরণের জন্য বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও মতামতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সাহসিকতা নয়, আহাম্মকি। প্রতিবাদ করতে গিয়ে যৌক্তিক ও সর্বজনগ্রাহ্য কোন উপায় অবলম্বন না করে নিজেকে ন্যাংটোভাবে উপস্থাপন করাও এক ধরণের উন্মাদনা ও অসুস্থ্যতা যা আমাদের দেশের হিজড়াগোষ্ঠী চাঁদাবাজিতে ব্যর্থ হলে অবলম্বন করে। অবশ্য ফ্রান্সের আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত-পালিত হলেও এ ঘটনা ঘটতে পারে। শুনেছি সেখানকার অক্ষম নারী-পুরুষেরা নাকি প্রতিবাদের জন্য এ ধরণের অহিংস(!) উপায় গ্রহণ করে।
প্রীতি প্রকৃতপক্ষেই সাহসী হয়ে উঠতে পারতেন যদি জনমানুষের কল্যাণ হয় এমন বিষয়গুলোতে কাজে অংশগ্রহণ করতেন। নারীদের কল্যাণে করার মতো কাজের অভাব এই দেশে নেই। নারী স্বাধীনতার নামে প্রীতি যেরকম অবাধ যৌনতা, সমকামিতা, নাস্তিকতা আর ধর্ম-বিরোধিতার পথ বেছে নিয়েছে, তা বেশিরভাগ নারীরই না-পছন্দ। প্রীতির মাতো নারীর নেতৃত্বে নারীরা যে অগ্রসর হতে অনাগ্রহী সেটা প্রীতি এবং তার মতো নারীরা যত দ্রুত বুঝবেন ততই কল্যাণ।
বইটি পড়ে ফায়দা কী?
কে কার সাথে শুইল – সেটা জেনে আপনার আমার আসলে ফায়দা কি? জৈবিক তৃপ্তি ছাড়া আর কোন উপকার বোধহয় নাই। সাধারণভাবে কম বেশি সবার নৈতিকতা এখন এমন পর্যায়ে যে মনে মনে এ ধরণের ভোগের সম্পর্কে জড়াতে আগ্রহী। এদের বড় অংশই সুযোগ পায় না বলে কার সাথে কে শুইল তা জানতে আগ্রহী হয়। মিডিয়ায় কাজ করে এমন নারী পুরুষের মধ্যে কম বেশি সকলেই এ ধরণের অনৈতিক সম্পর্কে জড়ায়, গিয়াসউদ্দিন সেলিম, জয়া বা পরিমনির নাম না জানলেই বা কি হতো! পত্রিকার পাতায় প্রেমের গুঞ্জন বলে যা শুনবেন তার সবটাকেই সত্যি হিসেবে ধরে নিতে পারেন, কারণ নিশ্চিত জেনে রাখেন, বিনোদন সাংবাদিকরা না জেনে পত্রিকার পাতায় সংবাদ ছাপান না।
যদি শুধু প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণই আপনার লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে সত্যিই জন্ম ও যোনির ইতিহাস বইতে সেরকম কিছু নেই। এখানে শারীরিক বিষয়ে কোন রগরগে বর্ণনা নাই যেমনটা হুমায়ূন আজাদের বইতে পাবেন। যদি ধর্মীয় বিষয়ে কেউ কটুকথা বললে আপনার কষ্ট হয়, যদি মুসলমান হিসেবে আপনার প্রিয় নবী সম্পর্কে হাস্যকর ও অযৌক্তিক কথা শুনলে আপনার হৃদয়ে ক্ষত তৈরি হয় তাহলেও এই বই আপনার পাঠ করা উচিত হবে না।
কারণ, জেনে রাখুন, আপনাকে এই ধরণের কথাগুলো জানানোর জন্য, আপনাকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এই টোপ ফেলা হয়েছে। প্রীতি এমন কোন মহান ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেননি যার আত্মজীবনীর আড়ালে উপস্থাপিত অন্যের শিখিয়ে দেয়া বুলি থেকে আপনি প্রকৃতপক্ষেই কিছু শিখতে পারবেন। প্রীতির অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক আর যোগাযোগ ছাড়া আর কিছুই নেই, তিনি আরেকজন তসলিমা নাসরিন হয়ে উঠতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন কেবল, শেষ পর্যন্ত তাও হয়ে উঠতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে।
বরং প্রীতি ও প্রীতিকে যারা প্রমোট করেন তাদেরকে এড়িয়ে চলতে শিখুন। প্রীতির জন্ম ও যোনির ইতিহাস ও অন্যান্য বই না পড়লে আপনার জীবনে কোন প্রভাবই পড়বে না। প্রীতিকে নিয়ে না লিখলে, প্রীতির ফেসবুক প্রোফাইলে চোখ না বুলালে এবং কোন মন্তব্য না করলেই ভালো। কারণ আপনার এই কাজটিই তাকে নতুন করে শক্তি জোগাবে, তাকে আলোচনায় রাখবে এবং নতুন নতুন সমালোচিত বই লিখতে উৎসাহিত করবে। তাকে তার মতো থাকতে দিন, সামাজিকভাবে বয়কট করুন এবং আরও বহু মানুষের মতো কালের গহবরে তাকেও হারিয়ে যেতে দিন।