বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকবার ফরিদপুর যাওয়া হলেও বেড়ানোর সুযোগ হয়নি। এটা নিয়ে একটা আফসোস ছিল। আফসোস কমেছে ২০১৮ সালে অফিসের কাজেই ফরিদপুরে আসার পর পল্লী কবি জসিমউদদীনের বাড়িতে ঝটিকা ভ্রমণের পর। তাই এবারও যখন ফরিদপুর যাবো বলে ঠিক হলো, তখন থেকেই পরিকল্পনা করলাম – যদি সময়ের আগেই কাজ শেষ করতে পারি তাহলে ফরিদপুরের আরও কিছু স্থাপনা ঘুরে দেখবো। দেখার মধ্যে আছে – সাতৈর মসজিদ, পাতরাইল মসজিদ, জগদ্বন্ধু সুন্দর-এর আশ্রম, নদী গবেষনা ইনস্টিটিউট আর মথুরাপুর দেউল।
অবশ্য এর পুরোটাই ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, কারণ আবহাওয়া সংবাদ বলছে – বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে যা ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’-তে রূপান্তরিত হয়ে দুই একদিনের মধ্যে আঘাত হানতে পারে। ফরিদপুরে যেতে পারবো কিনা তা নিয়েই সংশয় শুরু হলো। যাবার সময় শিমুলিয়া-কাঁঠালিয়া নৌ-পথ পার হবো স্পিড বোটে। হয়তো দেখা গেলো, গুলিস্তান থেকে বাসে যেতে যেতেই আবহাওয়া এত খারাপ হয়ে গেলো যে স্পিড-বোট, লঞ্চ, ফেরী সব বন্ধ করে দেয়া হলো, আর আমাদের ফিরতে হলো ঢাকাতে।
ফণী পৌঁছানোর আগেই আমরা ফরিদপুর পৌঁছে গেলাম। এক বেলার কাজ, তাও শেষ করতে করতে বেলা চারটা বেজে গেল। এবার আমি ফ্রি। টিমের বাকী সদস্যরা ঢাকার দিকে রওয়ানা হলো, আর আমি মথুরাপুর দেউলের দিকে। আকাশে মেঘ জমেছে, বৃষ্টি নামবে যে কোন সময়, তাছাড়া সন্ধ্যাও নামছে দ্রুত।
মথুরাপুর দেউল ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার গাজনা ইউনিয়নের মথুরাপুরে অবস্থিত। দেউল শব্দের অর্থ মন্দির বা মঠ। মথুরাপুরের মঠই আজকের মথুরাপুর দেউল। রাজবাড়িগামী বাসে চড়ে প্রথমে মধুখালী যেতে হবে, তারপর সেখান থেকে অটো-তে চরে দেউল। মধুখালী যেতে যেতে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। অটোতে করে যখন দেউলের সামনে নামলাম, তখন আমি যথেষ্ট ভিজে গিয়েছি।
বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মের অনেক ধরনের স্থাপনা দেখেছি, কিন্তু মথুরাপুর দেউলের মতো কোন স্থাপনা দেখিনি। আমার দেখা বেশিরভাগ স্থাপনাই ধ্বংসপ্রায়, সে তুলনায় মথুরাপুর দেউলের অবস্থা বেশ ভালো। দেউলটি বারো কোনা বিশিষ্ট, উচ্চতায় ২১ মিটারের সামান্য বেশি। মঠটি উপরের দিকে কিছুদূর সোজা উঠে গিয়েছে, তারপর সরু হয়ে উঠেছে। তবে চূড়া সমতল। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ফলক বলছে – এটি আগে আরও উঁচু ছিল।
যেহেতু বৃষ্টি হয়েছে, তাই মথুরাপুর দেউলের চত্ত্বরে কিছু জায়গায় পানি জমেছে। সবুজ ঘাসে মোড়ানো চত্ত্বর। আমি ছাড়া আর দুজনে সনাতন ধর্মাবলাম্বী ভদ্রলোক আছেন। তারা বেশ কসরত করে দেউলের বহিরাংশের টেরাকোটার ছবি তুলছেন।
সুন্দরবনের যে অংশে হরিণ চড়ে সেখানে গাছপালায় একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার মধ্যে গাছের পাতা পাওয়া যায় না। কারণ হরিণ পেছনের পায়ে ভর করে যতটুকু পর্যন্ত মাথা তুলতে পারে ততটুকু অংশের পাতা খেয়ে নেয়। দেখে মনে হয় নিপুণভাবে গাছের নিম্নাঙ্গের পাতা ছেটে রেখেছে কোন মালি। এখানে হরিণ নেই, কিন্তু দুপেয়ে জীব মানুষ আছে। ফলে এখানেও একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার মধ্যে কোন টেরাকোটা নেই। টেরাকোটাগুলো অসাধারণ। সেখানে নানা ধরনের ছবি রয়েছে। দিনাজপুরের কান্তজি মন্দিরেও এ ধরনের টেরাকোটা ছিল। টেরাকোটার মাধ্যমে সম্ভবত রামায়ন ও মহাভারতের কোন গল্প বলা হয়েছে, অথবা প্রত্যেকটি টেরাকোটাই স্বতন্ত্র কোন গল্পের চিত্র।
কবে এই মথুরাপুর দেউল তৈরী হয়েছে? এর সঠিক কোন তথ্য পেলাম না। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ফলক বলছে –
এই মঠ কে নির্মাণ করেছিলেন, সে সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। ফরিদপুর-যশোর জেলার এই অঞ্চলে একটি জনপ্রবাদ আছে যে, রাজা প্রতাপাদিত্যকে যুদ্ধে পরাজিত করে সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ এই বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। মানসিংহের সাথে প্রতাপাদিত্যের কোন যুদ্ধ হয়েছিল এবং সে যুদ্ধে মানসিংহ জয়লাভ করেছিলেন, এমন কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রামাণ্য ইতিহাসে পাওয়া যায় না। সপ্তাদশ শতাব্দীতে সংগ্রাম সিংহ নামক একজন ফৌজদার ভূষণাতে ছিলেন। তিনি বহুকাল ধরে এই অঞ্চলের ফৌজদার ছিলেন বলে জানা যায়। যশোর ও ফরিদপুরের আরেকটি জনপ্রবাদ মতে এই সংগ্রামসিংহ মথুরাপুর দেউল নির্মান করেছিলেন। এর স্থাপত্যিক শৈলী অনুযায়ী এটি সপ্তাদশ শতাব্দীর বলে ধারনা করা হয়।
এ রকম মঠ বা দেউল বাগেরহাটে আছে একটি, নাম কোদলা মঠ। ফরিদপুরের কাছে বাকেরগঞ্জের মাহিলারাতেও একটি আছে। সবগুলোই কাছাকাছি সময়ে নির্মিত। ভেতরে একটি কক্ষ থাকলেও সেখানে কোন মূর্তি নেই, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ফলক বলছে, কখনও ছিলও না।
খুব বেশি সময় কাটানোর মতো জায়গা নয় মথুরাপুর দেউল। তাই বের হয়ে এলাম। পাশেই ফরিদপুর চিনি কল। স্বাধীনতার পরে এই চিনিকলটি স্থাপিত হয়। দক্ষিণবঙ্গের একমাত্র ভারী-শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল একসময়। এখন আখ মাড়াই বন্ধ। তাই চিনিকলের ভেতরেও শুনশান নিরবতা। এই ধরনের কল-কারখানাগুলো বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে উঠে। সেখানে প্রচুর গাছপালা থাকে। পরিবেশটা মন ভালো করে দেয়ার মতো। বৃষ্টিতে ভিজে আর একাকী ভ্রমণ করার কারণে মনটা একটু বিষন্ন হয়ে ছিল, চিনিকলের পরিবেশ সেটা কিছুটা দূর করলো।
সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। ফিরতি পথে মধুখালী বাজারে দাঁড়িয়ে ট্রাকে পাট বোঝাই করতে দেখলাম। ফরিদপুর অঞ্চল পাটের জন্য বিখ্যাত ছিল। সোনালী আঁশ একসময় আমাদের গৌরবের বিষয় ছিল, এখন বোঝা। অবশ্য দুর্নীতির চেয়ে পাটের বোঝা বোধহয় ভারী নয়। কিন্তু সে ভেবে কি হবে।
বাসে চড়ে বসলাম। যাবো জগদ্বন্ধু সুন্দর-এর আশ্রম।