গল্প: চোর ধরা

‘২০১৫ সালের মে মাসে সন্ধ্যার দিকে আমার বাসায় চুরি হল। আমি তখন ওই বিল্ডিং এর দোতলায় থাকতাম’, এই বলে রাশেদ ভাই চায়ে চুমুক দিলেন।

কোন বিল্ডিং এর কথা বলেছেন সেটা আমি এবং সুজন ভাই দুজনেই বুঝতে পারলাম। যে বাড়িতে গুপ্তধন পাওয়া গেছে সেই গলিতেই দু তিনটে প্লট আগে একটা সাদা রঙ এর পাঁচতলা ভবনের দোতলার বাসাটার কথা বলেছেন রাশেদ ভাই। ২০১৫ সালের মে মাসে তিনি তার পরিবার নিয়ে ওই বাসাতে থাকতেন।

আমি এখানে যে ঘটনাটা বলছি সেটা রাশেদ ভাইয়ের নিজের জীবনের ঘটনা। রাশেদ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় সেদিনই, ঘন্টা দেড়েক আগে। স্পষ্ট করে বললে ২১ জুলাই ২০১৮ তারিখ শনিবার বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে। রাশেদ ভাইয়ের সাথে পরিচয়ের সূত্র ওয়াহিদ সুজন ভাই। রাশেদ ভাই তার সহকর্মী।

সকাল সাড়ে দশটার দিকে সুজন ভাই কল দিলেন আমাকে? ‘দারাশিকো ভাই, মিরপুরে নাকি গুপ্তধন পাওয়া গেছে?’
‘আমিও তাই শুনেছি। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভিতে গতকাল রিপোর্ট দেখে জানলাম। আমার বাসার কাছেই বাসাটা, সি ব্লকে।’
‘আপনার কি ছুটি নাকি আজকে?’
‘হ্যা। বাসাতেই আছি।’
‘থাকেন। আমি আর আমার এক কলিগ আসবো। কল দিলে শহীদ মিনারের সামনে থাইকেন।’

পাঠকের পড়ার সুবিধার্থে এই গল্পটিকে পিডিএফ-এ রূপান্তর করেও প্রকাশ করা হয়েছে। পিডিএফ ডাউনলোড করতে ছবিতে অথবা এই লিংকে ক্লিক করুন।

আধা ঘন্টার মধ্যেই সুজন ভাই এবং রাশেদ ভাই উপস্থিত হলেন। নিউজ কভার করবে রাশেদ ভাই, সুজন ভাই আগ্রহ নিয়ে সাথে এসেছেন। ঘন্টাখানেক উপস্থিত উৎসুক জনতা, পুলিশ আর সংবাদকর্মীদের মধ্যে থেকে, কথা বলে বেড়িয়ে আল আমিন সমিতির মোড়ে বায়তুস সুজুদ মসজিদের উল্টোদিকে ক্যাফে ফারুক হোটেলে বসেছি আমরা। চা খেতে খেতেই রাশেদ ভাই পুরো ঘটনাটা বললেন। তিনি বেশ ভালো গল্প বলেন। লেখকদের মতই রসিয়ে রসিয়ে সাসপেন্স ধরে রেখে পুরো ঘটনাটা বলেছিলেন। ক্রাইম রিপোর্টার বলেই হয়তো এত ভালো উপস্থাপন করতে পারেন। আমি হুবহু উনার জবানীতেই ঘটনাটা বলার চেষ্টা করছি৷ জানি না উনি যত ভালো বলেছেন ততটা পারবো কিনা।

আমি তখন সাংবাদিকতার পাশাপাশি একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মে পার্ট টাইম করি। পাঁচটা থেকে নয়টা বা দশটা। ইভেন্টের আগে সারারাতও থাকতে হয়। তখন সামনে একটা ইভেন্ট ছিল, তাই কাজের চাপ ছিল। আমি সব গুছিয়ে মাত্র কাজে বসেছি এমন সময় আমার ওয়াইফ ফোন দিল। রিসিভ করতেই শুনি তার চিৎকার – আমাদের বাসায় চুরি হয়েছে, আমি বাসায় যাচ্ছি, তুমি তাড়াতাড়ি আসো!

‘ভাবী তখন কই ছিলেন?’
‘আমার শ্বশুরের বাসায়। ও একটা প্রাইভেট কলেজে দেড় মাস আগে থেকে পড়ানো শুরু করেছে। আমাদের মেয়েকে শ্বশুরের বাসায় রেখে পড়াতে যায় আবার ফেরার সময় মেয়েকে নিয়ে আসতো। কোন কোনদিন সে ফিরে ওখানেই থেকে যায়, আমি ফেরার সময় নিয়ে আসি। ওইদিন আমি দেরী করে ফিরবো বলে ও ওখানেই ছিল। সন্ধ্যার পরে বাড়িওয়ালী আন্টি ওকে ফোন দিয়ে চুরির খবর জানায়। ও তৎক্ষনাৎ রেডি হয়ে বাসার দিকে রওয়ানা করে আর আমাকে ফোন করে।’

চুরির খবরে আমার বুক ধ্বক করে উঠলো। আমার ওয়াইফ প্রায় বছরখানেক ধরে পরিকল্পনা করে টাকা জমিয়ে একটা গলার হার-এর অর্ডার দিয়েছিল। কিছু টাকার ঘাটতি ছিল বলে আনা হচ্ছিল না। আমি কিছু টাকা দিয়েছিলাম। সেই টাকা দিয়ে হারটা মাত্র সপ্তাহখানেক আগেই জুয়েলারী শপ থেকে আনা হয়েছে। আজ চুরি হয়ে গেল। ওর তো হার্টফেল করার কথা!

অফিস থেকে বেরিয়ে আমি রিকশায় উঠে হিসাব নিকাশ করতে শুরু করলাম। চোর বাসা থেকে কী নিতে পারে? একটা সময় ছিল যখন বাসায় চোর ঢুকলে টিভি, ইস্ত্রি, ক্যামেরা, জামাকাপড় ইত্যাদি চুরি করতো। এখন আর সেইরকম হয় না। মূলত নগদ টাকা পয়সা, মোবাইল বা ছোটখাটো ডিভাইস, ক্যামেরা ডেবিট ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি চুরি হয়। এগুলো দ্রুত ক্যাশ করা সম্ভব হয়, তাই ডিমান্ডও বেশি। তাছাড়া এখন পেশাদার চোর কম, বেশিরভাগই পার্টটাইমার, সুযোগে চুরি করে। বাসায় খুব বেশি টাকা পয়সা রাখা নেই। গুরুত্বপূর্ণ যা তার সব কিছুই স্টিলের আলমারিতে রাখা। বাসায় আমার আর আমার ওয়াইফের দুজনের হাজারখানেক নগদ টাকা, গয়নাগাটি, এফডিআর, ডেবিট কার্ড থাকার কথা। যদি চোর সফল হয় তাহলে লাখকয়েক টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে।

ডেবিট কার্ড! মাই গড! আমার হার্টবিট বেড়ে গেল। মাসখানেক আগে আমি একটা এটিএম কার্ডের পিন ভুল করায় কার্ড আটকে গিয়েছিল। সেই কার্ড নতুন পিনসহ উদ্ধার করেছি সপ্তাহ দুয়েক আগে। ব্যস্ততার কারণে পিন পরিবর্তন করা হয়নি এবং পিনের কাগজপত্রসহ এটিএম কার্ড আলমারিতেই আছে। অর্থ্যাৎ, চোর বুদ্ধিমান হলে কমপক্ষে ৫০,০০০ টাকা সে নিয়ে নিতে পারবে আমি কার্ড বন্ধ করার আগেই!

বউকে ফোন দিলাম। ও বাসায় পৌঁছে গেছে। বুদ্ধি করে সাথে ওর চাচাতো ভাই মোবারককে নিয়ে গেছে। বাসায় বিল্ডিং এর প্রায় সকল ফ্ল্যাটের মহিলারা এসেছে। কি চুরি হয়েছে, কখন চুরি হল ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথাবার্তা চলছে। কি কি চুরি হয়েছে তা কি বুঝতে পেরেছে কিনা জানতে চাইলাম। এত মানুষের কারণে ঠিকমতো বলতে পারলো না। মোবারককে ফোন দিয়ে বললাম, সবাই বের হয়ে যাওয়ার পর যেন কি কি চুরি হয়েছে তার তালিকা তৈরি করে।

বাসায় পৌছে গেলাম। আমার বাসার দরজায় হ্যাচ-বোল্ট আছে। তালা লাগানো হয় সেখানেই। স্প্রিং তালা নয়, চাবি ঘুরিয়ে লাগাতে হয় যে তালা সেগুলো। এই তালা সহজে ভাঙ্গা সম্ভব না। চোরেরও ভাংতে কষ্ট হয়েছে বোঝা গেল। তালার মাঝে রড বা এইটাইপ কিছু ঢুকিয়ে চার দিয়ে তালা ভাঙ্গা হয়েছে। কাঠের দরজায় তা স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে।

চোর আলমারি এবং সাথের ওয়ার্ডরোব ছাড়া আর কিছুই ধরেনি। আলমারির চাবি ছিল ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ারে। লুকানো ছিল না। তাই সামান্য খুঁজতেই তারা পেয়ে গেছে। তবে আলমারির তালা খুলতে গিয়ে ওদের কোন সমস্যা হয়েছিল। দরজার চাবিটা ভেঙ্গে ফেলেছে। ড্রয়ারে আমার ওয়াইফের প্রথম মাসের বেতনের পুরোটাই ছিল। প্রথম চাকরীর প্রথম বেতন বলে খরচ করা হয়নি। ওটা নিয়ে গেছে। সংসারের খরচ বাবদ কিছু টাকা ছিল। প্লাস্টিকের একটা ব্যাংকে খুচরা পয়সা ছিল। আমার তিনটা এবং আমার ওয়াইফের একটা এটিএম কার্ড নিয়ে গেছে। আমার ন্যাশনাল আইডি কার্ড নিয়েছে। ছোট একটা পয়েন্ট এন্ড শ্যুট ক্যামেরা ছিল আমার। ওটাও নিয়েছে।

‘নেকলেস?’
‘আল্লাহর বিশাল রহমত ভাই। ওইটা নিতে পারেনি। খুঁজে পায়নি। কেন পায়নি জানি না। কাপড়ের মাঝখানে বক্সসহই ছিল ওটা। সামহাউ ওরা টের পায় নাই। ওর বিয়ের গয়নাগাটি ওর আম্মার বাসায় রাখা ছিল, ফলে ওগুলা নিয়ে টেনশনের কিছু ছিল না।’
‘আপনার এটিএম থেকে টাকা তুলতে পেরেছিল?’
‘পারেনি। আমার এসএমএস ব্যাংকিং চালু আছে। টাকা তুললেই মেসেজ আসতো। আমি বাসায় আসতে আসতে কল সেন্টারে ফোন করে কার্ডটা বন্ধ করতে পেরেছিলাম।’
‘এফডিআর?’
‘নেয়নি ভাই। সম্ভবত ব্যাংকে গিয়ে ভাঙ্গাতে হবে এবং ঝামেলা বেশি বলে নেয় নি। তবে ওরা ওটা পেয়েছিল।’
‘কিভাবে বুঝলেন?’
‘স্টিলের আলমারিতে একটা হিডেন চেম্বার থাকে দেখেছেন?’
‘দেখেছি। যে কোন একটা তাকের পার্টিশনের মধ্যে থাকে। না জানলে কেউ খুঁজে পাবে না। সাধারণত দলিল-দস্তাবেজ, গুরুত্বপুর্ণ কাগজপত্র ইত্যাদি রাখে।’
‘হ্যাঁ, ওইটাই। এফডিআর রাখা ছিল ওইখানে। জরুরী প্রয়োজনে কাজে লাগানোর জন্য কিছু টাকা আলাদা করে রাখা ছিল ওখানে। টাকাগুলো ছিল না, কিন্তু রশিদটা ছিল।’
‘তারপর?’
‘হিসাব করে দেখলাম সব মিলিয়ে হাজার ত্রিশেক টাকার ক্ষতি হয়েছে, এর মধ্যে প্রায় পুরোটাই নগদ টাকা।’
‘পুলিশকে জানাননি?’
‘না ভাই। এই থানার ওসি তখন সুলায়মান। চিনেছেন?’
‘হ্যাঁ। দুই বছর আগে জঙ্গী হামলায় মারা গেছে, উনি না?’
‘জ্বী। সে অলরেডি কুখ্যাত হয়ে গেছে। ওর কাছে গেলে আমার আরও কিছু খরচ বাড়তো। আমি বরং অন্য রাস্তা ধরলাম।’
‘কি করলেন?’
‘আমাদের সবার মধ্যেই তো এক-দুইজন গোয়েন্দা বাস করে, তাই না? আর এই ফেসবুকের যুগে আলহামদুলিল্লাহ সবাই-ই এনালিস্ট। তার উপর বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচের শার্লক টিভি সিরিজ তখন সুপারহিট। সুতরাং আমি এনালাইসিস করতে বসলাম।’
‘এনালাইসিস করে কি পেলেন?’
‘চুরি যে বা যারা করেছে তারা আমাদের খুব আশে পাশেই থাকে, আমাদেরকে চিনে।’
‘মাই গড! কিভাবে বুঝলেন?’
‘অনেকভাবে। এক নাম্বার, চুরি হয়েছে সন্ধ্যার ঠিক আগে বা পরে। আমাদের উপরতলায় তাইমারা থাকে। তাইমা ক্লাস ফোরে পড়ে। বিকেলে খেলা শেষ করে ফেরার সময় সে দেখেছে তালা লাগানো। আর সন্ধ্যার পর আরেকজন নামতে গিয়ে তালা ভাঙ্গা দেখে বাড়িওয়ালী আন্টিকে জানায়।
দুই নাম্বার, আমি আর আমার ওয়াইফ দুজনেই সকালে বের হয়ে যাই, ফিরি রাত আটটা নয়টার দিকে। এই বিল্ডিং এ একমাত্র আমাদের ফ্ল্যাটই সারাদিন খালি থাকে – এই খবরটা চোরের কাছে ছিল।’
তিন নাম্বার, ওইদিন সকালেই আমাদের দারোয়ান বাড়িতে গিয়েছিল। ওর বাড়ি সাভার। সে সপ্তাহে একবার বা দুই সপ্তাহে একবার বাড়ি যায়। সকালে গিয়ে বিকালে চলে আসে। আমি যখন বের হচ্ছি তখন সে বলেছে সে বাড়ি যাবে। আবার ফিরে এসে দেখি সে সদ্য ফিরেছে। দারোয়ান যে বাড়ি গেছে সেটা প্রি-প্ল্যানড না। সকাল বেলা উঠেই সে ঠিক করেছে যে বাড়ি যাবে।
চার নাম্বার, এবং এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের বিপরীত দিকের ফ্ল্যাটে থাকে মুন্নীরা। মুন্নী ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। ওদের বাড়ি শেরপুর। চুরির ঠিক আগের রাতে ওরা গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে প্রায় ছয়মাস পরে এবং মাত্র তিনদিনের জন্য। যাবার সময় আমাদেরকে বলে গিয়েছে যেন তাদের বাসার দিকে খেয়াল রাখি। দুই বাসার মধ্যে যাতায়াত ছিল। আমরাও বেশ নিরাপদ ফিল করতাম মুন্নীর আম্মা সারাদিন বাসায় থাকতো বলে।

‘দারোয়ানের ব্যাপারটা সাসপিসাশ। সে কি চুরির সাথে ইনভলভড?’
‘হতে পারে। ইন ফ্যাক্ট, প্রথমে আমিও তাই ধারণা করেছিলাম। কিন্তু ধারণা থেকে সরে আসলাম যখন দেখলাম মুন্নীদের বাসায় কোন তালা নেই।’
‘ওরা বাড়ি যায় নি? তাহলে তো তালা ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা।’
‘ওরা সত্যিই বাড়িতে গিয়েছিল। কিন্তু ওদের বাসা খালি ছিল না।’
‘তাহলে?’
‘মুন্নীরা ওই মাসেই একটি রুম সাবলেট দিয়েছিল। তিনজন ব্যাচেলর ছেলে। ইয়াং, কিন্তু স্টুডেন্ট না। মুন্নীরা বাড়িতে গেলেও তারা ছিল বাসায়। আমি এই খবর জানলাম আমার বউয়ের কাছ থেকে। ও আরও বললো, বাড়িওয়ালী আন্টি নাকি ওদেরকে জিজ্ঞেস করেছে ওরা কিছু শুনতে পেয়েছে কিনা। জবাবে ওরা জানিয়েছে, খুটখাট আওয়াজ শুনতে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু দরজা খুলতে এসে ওরা দেখেছে দরজা বাহির থেকে বন্ধ। ভেবেছে কেউ বোধহয় দুষ্টুমী করে দরজা লাগিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে ওরা আবার দরজা খুলতে এসে দেখে দরজা খোলা। ব্যাপারটাকে ওরা গুরুত্ব দেয় নি।’

আমি মুন্নীদের বাসায় নক করলাম। একটা ছেলে দরজা খুললে পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলাম। সে দরজায় দাঁড়িয়েই কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু আমি বসতে চাইলাম পরে ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে ফ্লোরের উপর দুটো তোষক বিছানো, তার একটায় চাদর নেই। ঘরে মালপত্রের মধ্যে কয়েকটা কাপড়ের ব্যাগ আর এক কোনায় কিছু হাড়ি-পাতিল এবং বাসন কোসন ছাড়া কিছু নেই।

ছেলেগুলা নিরীহ গোছের। ময়মনসিংহ জামালপুর থেকে এসেছে ঢাকায়। দুটো ছেলে কয়েকমাস ধরেই আছে, বাকীজন নতুন। সবাই-ই চাকরীর জন্য চেষ্টা করছে। ওরা আমাকে নতুন কোন গল্প বললো না। খুটখাট শব্দ শুনে তারা ভেবেছিল তাদের দরজায় কেউ এসেছে। খুলতে এসে দেখে খোলা যাচ্ছে না। আই হোল দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কিছু দেখতে পায়নি। তারা ভেবেছে সিঁড়ির লাইট বন্ধ। দরজা কেউ বন্ধ করেছে নাকি এমনিতে আটকে গেছে সেটাও ওরা বুঝতে পারেনি। ডাকাডাকি করেছে ভেতর থেকে, কেউ সারা দেয়নি বলে পাত্তা দেয় নি। ‘কাউকে ডাকলেন না কেন দরজা খোলার জন্য?’
‘কাকে ডাকবো? কাউকে তো চিনি না আমরা।’
‘পরে কিভাবে দরজা খুললেন?’
‘সিঁড়িতে লোকজনের আওয়াজ পেয়ে দরজার কাছে গেলাম যেন বাহিরের লোকদের বলে খুলতে পারি। কিন্তু চেষ্টা করে দেখি দরজা খোলা যায়, আটকানো নাই। খুলে দেখলাম কয়েকজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। একজন বয়স্ক মহিলা, সম্ভবত উনিই এই বাড়ির মালিক, উনি জিজ্ঞেস করলেন কিছু শুনেছি কিনা। তখন এই ঘটনাই বলেছি।’

‘দারোয়ানের চেয়েও তো এদের চুরি করা বেশি সহজ। তাই না?’
‘জ্বি ভাই। ওদের সাথে আমি যদিও কথা বলেছি কিন্তু নিশ্চিত হতে পারি নি এরাই কালপ্রিট কিনা। আপনাদের মতই তখন আমার অবস্থা। কোন প্রমান নাই। কেবল সন্দেহ করতে পারছি। এদের ব্যাপারে একটামাত্র পজিটিভ দিক, সেটাও ধারনা, প্রমানিত নয়। আলমারিতে হিডেন চেম্বার সম্পর্কে চোরের জ্ঞান আছে৷ এদের সেই জ্ঞান আছে এমনটা মানতে পারছিলাম না। শুধু সন্দেহের কারণে এদেরকে তো দায়ী করা যায় না। ধরেন, আমি পুলিশকে এইটুকুই বললাম যে, বিপরীতদিকের ফ্ল্যাটে ব্যাচেলর ছেলেরা ছিল এবং তারা বলেছে তাদের দরজা বাহির থেকে আটকানো ছিল, তাহলেই পুলিশ এদেরকে হ্যারাস করবে, ধরে নিয়ে যাবে। কিন্তু এরা যদি দোষী না হয়, তাহলে?’
‘তারপর কি করলেন?’
‘তারপর আসলে আর কিছু করার ছিল না। গোয়েন্দাগিরির সমাপ্তি ওখানেই। ক্ষতি মেনে নেয়া ছাড়া আর কিছু করার নাই। আমি আমার আব্বা এবং ভাইদেরকে ফোন দিয়ে ঘটনাটা জানালাম। মেজ ভাই পরামর্শ দিল থানায় গিয়ে এনআইডি হারানোর ব্যাপারে জিডি করতে। আমি সকালে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওর চাপে সাড়ে নয়টার দিকে জিডি করে আসলাম।’
‘শুধু ন্যাশনাল আইডি?’
‘হ্যাঁ। চুরির কথা বলিনি। হারিয়ে গেছে বলে জিডি করেছি।’
‘চোর তাহলে আর ধরা পড়ল না?’
‘পড়েছে। সেই গল্পটাই তো বলছি।’
‘কিভাবে ধরলেন?’
‘মেজো ভাইয়ের বুদ্ধিতে। ও ব্যাংকার। রাত এগারোটার দিকে আবার ফোন দিল। বললো, যেহেতু এটিএম কার্ড চুরি হয়েছে তাহলে চোর অবশ্যই বুথ থেকে টাকা উঠানোর চেষ্টা করবে। বুথে সিসি ক্যামেরা আছে। চোর খুব বুদ্ধিমান না হলে নিজেই টাকা তুলবে। সুতরাং আমি যেন সকালে ব্যাংকে যোগাযোগ করি।’

সৌভাগ্যক্রমে পরের দিন আমার ডে অফ। সাধারণত বন্ধের দিনে ইভেন্টের কাজ করি। ওইদিন একটু দেরী করে যাবো ঠিক করলাম। এগারোটার দিকে ব্যাংকে গিয়ে সরাসরি ম্যানেজারের রুমে গেলাম। নিজের সাংবাদিক পরিচয় দিলাম। মেশিনে কার্ড আটকে যাবার কথা বললাম। উনি তার অফিসারকে ডেকে আমার নাম দিয়ে আটক কার্ডের মধ্যে আছে কিনা দেখতে বললেন। দুই মিনিটের মধ্যেই কার্ড পেলাম। ম্যানেজার সাহেব জানালেন, কার্ড আটক হলে পিন বাতিল হয়ে যায়। নতুন পিনের জন্য আমাকে যে শাখায় একাউন্ট সেখানে যোগাযোগ করতে হবে।

কিন্তু আমার তো দরকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ। নিদেনপক্ষে একটা স্টিল ছবি। ম্যানেজারকে বললে দিবে কিনা সন্দেহ আছে, তারপরেও তাকে ঘটনাটা খুলে বললাম। একদম চুরি থেকে শুরু করে আমার এনালাইসিস – সব। উনি প্রথমে গাইগুঁই করলেও সহযোগিতা করলেন। সরাসরি ফুটেজ দিলেন না, তবে মনিটর থেকে ভিডিও করার সুযোগ দিলেন। ভিডিওতে দেখলাম দুটো ছেলে এটিএম বুথে ঢুকল, তারপর কার্ড ঢুকিয়ে পিন নাম্বার দেয়ার চেষ্টা করলো। একবার, দুইবার, তিনবার। ব্যাস কার্ড আটকে গেল। আরও কয়েকবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কার্ড বের হল না। বাহিরের সিকিউরিটি গার্ড ঢুকলো। সম্ভবত কার্ড যে পাওয়া যাবে না সে কথা বলল ছেলেগুলোকে। তারপর তিনজনই বের হয়ে গেল। ভিডিওর টাইম দেখে মোবাইলে চেক করলাম। আমার কপাল খুবই ভালো ছিল ভাই, আলহামদুলিল্লাহ। আমি যদি রাস্তায় থাকতেই কার্ড বন্ধ না করতাম তাহলে আরও মিনিমাম পঞ্চাশ হাজার টাকা বেশি ক্ষতি হত। মাত্র সতেরো মিনিট পরেই ওরা এটিএম দিয়ে টাকা তুলতে চেষ্টা করেছিল।

‘ছেলেগুলোকে চিনলেন?’
‘না ভাই। এই ছেলেগুলোকে আমি চিনি না।’

ফুটেজ নিয়ে আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম সেই ছেলেগুলো কিংবা দারোয়ানকে দেখতে পারবো। নিদেনপক্ষে চেনা মুখ। কিন্তু সেরকম কিছু না। খুব হতাশ লাগছিল। এনালাইসিসগুলো মনে মনে রিপিট করছিলাম। যদিও এই এনালাইসিসের কোন রেজাল্ট নাই। সিসিটিভি ফুটেজ আমার এনালাইসিস ঠিক কিনা সেইটা প্রমাণ করার কথা। কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি। নতুন করে কোন চিন্তাও আসলো না।

অফিসে আর গেলাম না। দুপুরের পরে যাবো বলে বাসায় ফিরে এলাম। ওই গলির ঠিক উল্টোদিকের বিল্ডিং এ ফার্মেসীর পাশে একটা মুদি দোকান আছে, ঢাকা জেনারেল স্টোর, খেয়াল করেছিলেন?
না।
সুমনের দোকান নামে বেশি পরিচিত। আমি বাজার সদাই সাধারণত ওর দোকান থেকেই করি। ওর দোকানের পাশ দিয়ে ফিরছি, ডাক দিয়ে বলল, ‘মামা, আপনার বাসায় নাকি চুরি হইছে?’
‘হ্যা। তুমি জানলা কিভাবে?’
‘এইগুলা কি আর চাপা থাকে! কি কি নিলো?’
‘যা যা নেয়। টাকা পয়সা আর টুকটাক।’
‘বাবাখোরদের কাজ।’
‘এই এলাকায় বাবাখোরও আছে নাকি?’
‘নাই আবার!’
‘তুমি চিন নাকি?’
‘কি যে বলেন মামা, চিনবো না ক্যান?’
‘দেখো তো এদের চিনো কিনা?’
‘কই পাইলেন এই ভিডিও?’
‘আমার এটিএম কার্ড দিয়া টাকা তুলতে গেছে এরা।’
‘কি করবেন এই ভিডিও?’
‘পুলিশকে দিবো ভাবতেছি। দেখি কিছু উদ্ধার করা যায় কিনা।’
‘মামা একটা কথা বলি, ক্ষতি যদি বেশি না হয়, তাহলে পুলিশের কাছে যাইয়েন না। ক্ষতি আরও বাড়বে।’
‘চিনো মনে হচ্ছে? কে?’
‘ওয়ারেন্টিতে দেন মামা। শাহ আলীতে দিলে নষ্ট করে ফেলতে পারে – মোবাইলটা ফেরত দিল সুমন।’

সুমনের এই কথায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কি কথার কি উত্তর! সুমনকে যে আবার জিজ্ঞেস করবো তার কোন সুযোগ সে দিল না, ভেতরের দিকে চলে গেল, তারপর একটা নুডলসের প্যাকেট এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। ‘চৌষট্টি টাকা।’

হয়তো আমার বউ বলে রেখেছিল, এই ধারনায় আমি মানিব্যাগ বের করতে করতে দোকানের সামনেই একটা পরিচিত মুখ দেখলাম, ‘একটা সিগ্রেট দে সুমন।’
সুমন সিগারেট দিল। ছেলেটা গ্যাসলাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে চলে গেল। এটিএম বুথের ভিডিওর দুইজনের একজন! এত কাছ থেকে এভাবে দেখতে পারবো কল্পনায়ও আসেনি!

আমি বাসায় ফিরলাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। সুমন আমাকে বলেনি ছেলেটা কে। তবে সে যে এই এলাকার এবং সুমন যে তাকে খুব ভালোভাবে চিনে এতে কোন সন্দেহ নাই। সুমনকে সিগারেটের দাম দেয়নি। অর্থ্যাৎ বাকীতে কিনল, পরে দাম দিয়ে দেবে। মানে সে এই এলাকাতেই থাকে। আমার এনালাইসিস ভুল ছিল না। আমাদের আশেপাশের কেউই চুরিটা করেছে বা করিয়েছে।

ছেলেটা কে সেটা জানার জন্য আমাকে প্রায় তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল। সুমন লাঞ্চের ব্রেকে বাসায় গিয়ে আমাকে কল ব্যাক করে বিস্তারিত জানালো। আমার বিল্ডিং এর দুইটা প্লট আগে যে বিল্ডিংটা, তার তিনতলায় থাকে। নাম মাহফুজ। বাড়িওয়ালার ছেলে। গুন্ডা পান্ডা না। কিছু করেও না। ইয়াবাসক্ত। সম্ভবত এভাবেই নেশার টাকা পয়সা জোগাড় করে। ভিডিওর অন্য ছেলেটা এলাকার না। মাহফুজের বন্ধু হবে। সুমন আবারও সতর্ক করে দিল যেন এই নিয়ে ঘাঁটাঘাটি না করি।

সুমনের উদ্বেগের কারণ বুঝতে আমার বেগ পেতে হয়নি। মাহফুজ স্থানীয়। আমি ভাড়াটে। বউ বাচ্চা নিয়ে থাকি। আবার বাসায় থাকিনা সারাদিন। ওকে প্রটেকশন দেয়ার মত লোক এই মহল্লায় আছে। আমার কেউ নাই। আমি যদি থানা পুলিশ করি তাহলে এই মহল্লায় থাকা আমার পক্ষে কষ্টকর হবে। এলাকা ছাড়লেও রক্ষা পাবো তার গ্যারান্টি কই? তাছাড়া পুলিশ ম্যানেজড হয়ে যাবে সেই সম্ভাবনা মোটেও কম না। ফলে আমি বিষয়টা নিয়ে আর এগোই নি।

‘বাসা ছাড়লেন কেন?’
‘বাসা রাখার প্রয়োজন ফুড়ালো, তাই। শ্বশুর তার নিজ বাড়িতে উঠে গেলেন। আমার বউও চাকরী পাল্টালো। মেয়েটা বড় হয়েছে। বাসায় ওকে দেখাশোনার জন্য একটা মেয়ে আছে। চলে যাচ্ছে।’
‘গল্পের তাহলে এখানেই ইতি?’
‘বলতে পারেন তাই। তবে আমি আরও একটা কাজ করেছিলাম। ওই কাজটার জন্যই এই গল্পটা বলা।’
‘কি করলেন?’

বিকেলের পরে আমি থানায় গেলাম। ওসি সোলায়মান তখন ছিলেন না। প্রায় ঘন্টাখানেক বসার পর উনি ফিরলেন। পরিচয় দিয়ে উনার সাথে কথা বললাম। চুরির ঘটনা থেকে শুরু করে ফুটেজ কালেকশন এবং মাহফুজের আইডেন্টিফিকেশন। সব শুনে উনি বললেন, ‘মামলা করতে চান?’
‘জ্বি না, চাই না।’
‘তাহলে?’
‘আমি কেবল ফুটেজটা আপনাকে দিতে চাই।’
‘দিন।’

ফুটেজ ট্রান্সফার করে আমি অফিসে চলে গেলাম। কয়েকদিন পর শুনলাম, মাহফুজকে নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছিল। দুইরাত পরে ছেড়ে দিয়েছে। কেন ধরেছে বা ধরে রেখে কি করেছে জানা গেল না। আমি কেবল ধারনা করতে পারি। আগে শুনতাম, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ৷ এই যুগে নতুন কথা শুনি। বাঘ বিলুপ্তপ্রায়, আর পুলিশে ছুঁলে মিনিমাম এক লাখ টাকা।

-সমাপ্ত-

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

2 Comments on “গল্প: চোর ধরা”

  1. বেশ মনযোগ দিয়ে পড়লাম, তবে একটা সুন্দর সমাপ্তি আশা করেছিলাম।

    1. ধন্যবাদ শাহিন, মনযোগ দিয়ে পড়ার জন্য এবং মন্তব্য প্রকাশের জন্য। আপনার আশা পূরণ করতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। ভালো থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *