Okja (ওকজা) দেখার জন্য এর পরিচালকের ফিল্মোগ্রাফি জানাই যথেষ্ট ছিল কারণ সেখানে আছে ‘মাদার’ এবং ‘মেমরিজ অব আ মার্ডার’ এর মত সিনেমা। অবশ্য দুনিয়ার অন্যান্য সিনেমাপ্রেমীদের কাছে এই দুইয়ের চেয়েও বেশী পরিচিত তার অন্য দুটি সিনেমা, ২০০৬ সালের দ্যা হোস্ট এবং ২০১৩ সালের স্নোপিয়ার্সার। ২০১৮ সালের শুরুতে দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ফিচারে ‘জালালের গল্প’ নির্মাতা আবু শাহেদ ইমনের রেকমেন্ডেশনে এই সিনেমাটা দেখা হয়ে গেল। সাউথ কোরিয়ান পরিচালক বং জুন-হো’র এই সিনেমাতে জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড অর্গানিজম (জিএমও) / ফুড, কর্পোরেট কালচার, পশুপ্রেমীদের কর্মকাণ্ড ইত্যাদি ছাপিয়ে গেছে মানুষ আর পশুর বিশ্বস্ত, বন্ধুত্বপূর্ণ, আন্তরিক সম্পর্ক!
মিরান্ডো কর্পোরেশনের নতুন সিইও লুসি মিরান্ডো দায়িত্ব গ্রহনের পর জানান, তার কোম্পানী সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে ছাব্বিশটি সুপার পিগ (শুয়োর) প্রজনন করতে সক্ষম হয়েছে। এগুলো ছাব্বিশটি দেশের ছাব্বিশজন কৃষককে দেয়া হবে লালন পালনের উদ্দেশ্যে। দশ বছর পরে নির্বাচন করা হবে শ্রেষ্ঠ সুপার পিগ। দশ বছর পরে আমরা দেখতে পাই দক্ষিন কোরিয়ায় পাহাড়ের চূড়ায় এক নিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশে মাতৃ-পিতৃহীন মিজার সাথে সুপার পিগ ওকজাকে। জলহস্তীর মত দেখতে ওকজা আকৃতিতে আরও বিশাল কিন্তু সে অনেকটা লাজুক, বুদ্ধিমতী এবং বন্ধুভাবাপন্ন। পরদিনই মিরান্ডো কর্পোরেশনের প্রতিনিধিদল এসে ওকজাকে নিয়ে যায় সিউল হয়ে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিতব্য বেস্ট সুপার পিগ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনের উদ্দেশ্যে। দাদুর কাছ থেকে জানতে পেরে রাতের আঁধারেই সিউলের উদ্দেশ্যে একাকী রওয়ানা হয়ে যায় মিজা, ওকজাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবে বলে, আর এর মাধ্যমেই এক উত্তেজনাপূর্ণ অভিযাত্রার সূচনা হয়।
মিজা ‘ওম বাক’ সিনেমার হিরো টনি ঝা নয়, সে সহজ সরল একজন কিশোরী, ফলে টনি ঝা’র মত পোষা হাতিকে মুক্ত করার ন্যায় পোষা শূকর ওকজাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য তার পক্ষে একাই লড়াই চালিয়ে সবাইকে কুপোকাত করা সম্ভব নয়। সুতরাং অ্যানিমেল লিবারেশন ফ্রন্ট বা এএলএফ এর সদস্যরা পর্দায় হাজির হন এবং তাদের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি ওকজা প্রকৃতপক্ষে একটি জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড জন্তু, কোন ন্যাচারাল সুপার পিগ নয়। মূলত এএলএফ-এর উপর ভর করেই সিনেমার বাকী কাহিনী এগিয়ে গিয়েছে। জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড পশুদের দুর্দশা, কর্পোরেট পশুখামারগুলোর জবাইখানা, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের কার্যক্রম ইত্যাদির বিস্তারিত চিত্র ফুটে উঠেছে বাকী অংশে। এর মাধ্যমে পশুর সাথে মানুষের আন্তরিকতা এবং বন্ধুত্বের যে সম্পর্ক তার পরিচয়ও পাওয়া যায়।
জিএমও বর্তমান বিশ্বে আলোচিত একটি বিষয়। এর পক্ষে বিপক্ষে বিস্তর আলোচনা হয়েছে এবং এখনো চলছে। জিএমও-র মাধ্যমে গৃহপালিত পশু-পাখিকে যেমন একদিকে কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বানানো হয়েছে, অন্যদিকে জিএমও-র মাধ্যনেই সারা বিশ্বের সাতশ কোটি মানুষের ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা পূরণ হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধানের উৎপাদনে তো জিএমও-র অবদান অকল্পনীয়। অতিবৃষ্টি বা বন্যার কারণে ধানক্ষেত ডুবে গেলেও যেন ফসল নষ্ট না হয়, বর্তমানে সেই গবেষনা প্রায় সাফল্যের পর্যায়ে চলে এসেছে। এর বিরুদ্ধ মতের মধ্যে শক্তিশালী যুক্তি হল, জিএমও ফুড মানুষের শরীরে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি এবং এলার্জী সংক্রান্ত সমস্যা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া জিএমও-র অন্যান্য যে শারীরিক, নৈতিক এবং পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে তা নিয়ে সারাবিশ্বেই জিএমও-বিরোধী আন্দোলনকারীরা বেশ সরব।
ওকজা কি জিএমও বিরোধী ছবি? নাকি পশুহত্যাবিরোধী, হোক সেটা খাবারের প্রয়োজনে পশুহত্যা? ছবির গল্পে যে নির্মমতা ফুটে উঠেছে তা সরাসরি জিএমও-র বিরুদ্ধে নয়, বরং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অতিমুনাফালোভী মানসিকতা, ভোক্তা এবং সেবাগ্রহীতাদেরকে অন্ধকারে রেখে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে শুধুমাত্র অর্থের লোভে যে অমানবিক এবং পাশবিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবার প্রবণতা তা মূখ্য হয়ে উঠেছে ছবিতে। এই দৃষ্টিকোন থেকে প্রকারান্তরে জিএমও-র বিরোধিতাই করা হয়, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জিএমও-র উদ্যোক্তা এবং সুবিধাগ্রহীতা হচ্ছেন এই কর্পোরেট দুনিয়া। ওকজা ছবিতে পশুহত্যার যে বিভৎস চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, বাস্তবতা তার চেয়েও অনেক মর্মান্তিক। তা সত্ত্বেও, ওকজাকে পশুহত্যাবিরোধী ছবি বলাও দুষ্কর, কারণ প্রধান চরিত্র মিজার পছন্দের খাবার হল মুরগীর স্ট্যু।
সচেতন দর্শকের কাছে বরং ছবির রম্য ও ব্যাঙ্গাত্মক বিষয়গুলো ধরা পড়বে। মিরান্ডো কর্পোরেশনের সিইও লুসি মিরান্ডা এবং তাকে ঘিরে রাখা মোসাহেবের দল, সত্যকে চেপে রেখে বিজ্ঞাপন এজেন্সীর সহায়তায় বিপুল বাজেটে মিথ্যার প্রচার ইত্যাদি বিষয়গুলোর ব্যাঙ্গাত্মক উপস্থাপন রয়েছে সিনেমায়। শুধু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান নয়, ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকেও ছাড়েনি ওকজা, এর একটি দৃশ্য তো হুবহু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং হিলারি ক্লিন্টনের উপস্থিতিতে বিন লাদেন হত্যার অভিযান সরাসরি দেখার ছবির সাথে মিলে যায়।
অন্যদিকে এ্যানিমেল লিবারেশন ফ্রন্টের কার্যকলাপও হাস্যকর। যদিও তাদের অবদানেই ছবির মূল রহস্যের কিনারা হয়, এর সদস্যরা যেন ফ্যান্টাসীর এক দুনিয়ার বাসিন্দা। পৃথিবীর কোন পশুকেই যেন কষ্ট পেতে না হয় তার জন্য যিনি আন্দোলন করছেন তিনি যখন আন্দোলনকারী আরেক সদস্যের উপর নির্মম আক্রমণ করেন তখন কিছুক্ষণের জন্য হতবাক হতে হয়। প্রশ্ন জাগে, মানুষ কি তবে পৃথিবীর প্রাণিকুলের বাইরে?
সবকিছুকে ছাড়িয়ে মানুষের সাথে গৃহপালিত পশুর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই প্রধান হয়ে উঠেছে ছবিতে। হাজার বছরের পুরানো এই সম্পর্ককে কর্পোরেট বেনিয়ারা নষ্ট করতে পারবে না – শেষ অংশটুকু যেন এই স্লোগানই প্রতিধ্বনিত করে।
ওকজা’র নির্মাতা অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং প্রতিষ্ঠান নেটফ্লিক্স। ফলে অত্যন্ত সুনির্মিত এই ছবিটি হাতে গোনা অল্প কিছু প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল। কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ওকজা’র উপস্থিতি নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। এ বছর কান চলচ্চিত্র উৎসব কর্তৃপক্ষ তো নেটফ্লিক্সের ছবি নিষিদ্ধই করেছে – প্রেক্ষাগৃহে যে ছবি মুক্তি পায়না, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল তার জন্য নয় – এমনই তাদের বক্তব্য। উৎসব কর্তৃপক্ষের সাথে হয়তো পৃথিবীর বেশিরভাগ দর্শক একমত হবেন। থিয়েটারের অন্ধকার পরিবেশে বিশাল স্ক্রিনে প্রদর্শিত সিনেমার সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়াই অর্গানিক, অনলাইনে বসে অপেক্ষাকৃত ছোট পর্দার দিকে তাকিয়ে বাহির থেকে উপভোগ করা নয়। দর্শকগোষ্ঠীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে কর্পোরেটের ইচ্ছানুযায়ী চলতে বাধ্য করার মধ্যে জিএমও মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই দিক থেকে মিরান্ডো কর্পোরেশনের সাথে নেটফ্লিক্সের কি খুব বেশি তফাৎ?
৬ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে বণিকবার্তা’র সিল্করুট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত