পিঁপড়াবিদ্যাঃ পিপীলিকার মত নয়

পিঁপড়াবিদ্যা Official Posterমোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পঞ্চম সিনেমা ‘পিঁপড়াবিদ্যা‘ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ন। প্রথমত, এটি তার প্রথম অ-বিতর্কিত চলচ্চিত্র, আগের প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রই নানা কারণে সমালোচিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এই ছবির প্রচারে তিনি নানাবিধ উপায় অবলম্বন করেছেন। প্রায় পাঁচটি ধাপে ছবির প্রচারনা শেষেই তিনি তার চলচ্চিত্র মুক্তি দিয়েছেন। বাকী চলচ্চিত্রগুলো স্বনির্ভর ছিল, প্রচারণার উপর ভর করে দর্শকের কাছে পৌছুতে হয় নি। তৃতীয়ত, ইমপ্রেসের তৈরী চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক পরিবেশনার ক্ষেত্রে এই চলচ্চিত্র ব্যতিক্রম। সাধারণত ইমপ্রেসের ছবি একটি হলে মুক্তি পায়, কিন্তু এই ছবি প্রথম সপ্তাহেই ২৭টি হলে মুক্তি পেয়েছে। ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রগুলোও এই পথ অবলম্বন করতে সক্ষম হলে চিত্রটা ভিন্নরকম হতো।

মাত্র দেড়ঘন্টা দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রের গল্প আবর্তিত হয়েছে নূর ইমরান মিঠুকে কেন্দ্র করে। বেকার মিঠু বড় হওয়ার আশায় কিভাবে লোভে পড়ে যায় এবং সেই লোভ তাকে কিভাবে কুট কুট করে কাটে সেই গল্প বলেছেন ফারুকী। এই গল্প বলতে গিয়ে ফারুকী তুলে এনেছেন সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন বিষয় যেমন মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যাবসায়ের উত্থান এবং পতন, ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্পর্শকাতর গোপনীয় অংশের নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি।

দুর্দান্ত এক পরিণতির দিকে আগাতে পারতো এই ছবির গল্প। কিন্তু ঝুলে গেল ঠিক সেই জায়গায় সিনেমার মাঝখানে যেখানে বলাকা সিনেমাহলের কর্তৃপক্ষ ‘বিরতি’ লেখা একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ‘পজ’ বাটন চাপল। হল কর্তৃপক্ষের এই আন্দাজবোধ খুবই চমৎকার এবং বিস্ময়কর। এর আগে হুমায়ূন আহমেদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার লক্ষ্য করেছি – বিরতিহীন সিনেমাগুলোর ঠিক যেখানে তারা পজ বাটন চাপে ঠিক সেখান থেকেই গল্প ঝুলে পড়ে। পরিণতি অংশে একটা ‘খোলা সমাপ্তি’ রাখার ইচ্ছে ছিল বোধহয় পরিচালকের, কিন্তু বুদ্ধিমান দর্শকতো আর মিঠুর ছোট বোন নয়, তারা জানে, ছোট বোনের ধারনা ভুল নয়।

পিঁপড়াবিদ্যা কি পয়সা উসুলের সিনেমা? না।ফারুকীর চতুর্থ চলচ্চিত্র ‘টেলিভিশন‘ দেখার পর থেকে তার ছবিতে নিজস্ব চলচ্চিত্রিক দৃশ্যাবলী দেখার যে আকাঙ্খা তৈরী হয়েছিল তা আংশিক পূরণ হয়েছে। গানের দৃশ্যে আপেল মুখে চিত্রনায়িকা রীমার উপরে লোভী মিঠুর অবস্থানের মাধ্যমে অ্যাডাম-ইভ-অ্যাপল এর সিম্বোলাইজেশন চমৎকার আইডিয়া। কিন্তু পোশাকের শো-রুমে লেডি পুতুলের পাশে শুয়ে থাকার আইডিয়াটা পছন্দ হয় নি বরং ফারুকীর ‘কেউ যৌনতা থেকে বিনোদিত হয়’ বক্তব্যের বাণিজ্যিক ব্যবহার হিসেবে বেশী উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে।

ক্যামেরার ব্যবহারে ফারুকীর সিগনেচার স্টাইল আবারও পাওয়া গেল এই চলচ্চিত্রে, তবে সেটা বেশী প্রকট। যেমন, গাড়ীতে ক্লোজআপে ড্রাইভারের কানের শট – ওটা আরেকটু ছোট হলে ভালো লাগত। আর হ্যা, ছবিটির একমাত্র গান – মাথায় ঢুকে যাওয়ার মত দারুন!

পিঁপড়াবিদ্যা কি পয়সা উসুলের সিনেমা? না। মিঠুর পিঁপড়ার মত এই ছবি আমাদের মাথায় কুট কুট করে কাটে না। ‘এর চেয়ে চানখারপুলে গিয়া বিরিয়ানী খাইলেও হইতো, আমাদের উপর এক্সপেরিমেন্ট না করলে কি হইতো না?’ আমার মন্তব্য নয় – সিনেমা শেষে একত্রে বেরিয়ে আসার সময় এক দর্শকের মুখ নিসৃত ক্ষোভ। আমি এতটা মৌলবাদী না, তবে প্রচারণা অনুপাতে এক্সপেক্টেশন আরও কম করা উচিত ছিল। এখন থেকে মনে রাখবো – শাহরুখের ‘হ্যাপী নিউ ইয়ার’ সিনেমার প্রচারণা কেন বেশী চলে!

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

2 Comments on “পিঁপড়াবিদ্যাঃ পিপীলিকার মত নয়”

  1. মাত্র দেড় ঘন্টার ছবি নাকি???
    আমি তো দেখতে বসে ভাবছিলাম অনন্ত সময়ের এই ছবি শেষ হবে কখন!

  2. আমার কাছেও লেডি ডল জড়িয়ে ঘুমানোটা অমন ই মনে হয়েছে। চমৎকার পর্যবেক্ষন আপনার। ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *