ভারতের ছবি ‘গুণ্ডে’ বাংলাদেশের পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে মুক্তি পাওয়ারও আগে। ‘গুণ্ডে’ হল যশরাজ ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত চলচ্চিত্র যা ভারতে একই সাথে হিন্দী এবং বাংলা ভাষায় মুক্তি পেয়েছে। মুক্তির আগে একটি গান নিয়ে কোর্টে দৌড়ঝাপ হয়েছে – ‘হটকেক’ হিসেবে সেই নিউজ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোয়। পত্রিকাগুলোকে দোষ দেয়ার আগে একবার ভেবে দেখা উচিত অবশ্য – এই আমরা ভারতীয় ছবির খবরের জন্য ‘হা’ করে বসে না থাকলে পত্রিকাগুলোর বিনোদন পাতায় ভারতীয় চলচ্চিত্রের খবর সিংহভাগ জায়গা দখল করে রাখতো না।
গুণ্ডে মুক্তির পর পরই আরও বেশী আলোচিত হয়ে গেল – কারণ, বাংলাদেশের দর্শকরা যারা ‘গুণ্ডে’ মুক্তির জন্য ‘হা’ করে অপেক্ষা করে ছিল, তারা মুক্তির পর পরই ক্যাম রিপে সিনেমাটা দেখতে বসে গেল এবং আবিস্কার করল – সিনেমায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সমালোচনা এবং প্রতিবাদের ঝড়ে ‘গুণ্ডে’ আবারও পত্রিকার শিরোনাম হয়ে গেল। সর্বশেষ আপডেট হল – ব্লগস্পটে যশরাজ ফিল্মসের ওয়েবসাইটে দুঃখপ্রকাশ করে বলা হয়েছে –
If this fictitious story and its telling have in any way upset the sentiments of anybody, we would like to clarify that it was totally inadvertent and it is sincerely further regretted.
এবং, এই দুঃখপ্রকাশের কল্যাণে আবারও ‘গুণ্ডে’ পত্রিকার শিরোনাম হয়ে গেল। সম্ভবত, এবার প্রতিবাদের ঝড় শান্ত হবে এবং ‘গুণ্ডে’ দেখা জায়েজ হবে। যশরাজ ফিল্মসের বাণীতে দুঃখপ্রকাশ করা হয়েছে, সেজন্য ধন্যবাদ, কিন্তু যা করা হয় নি – ১. ছবিতে ইতিহাসের বিকৃতি সংশোধন করার কোন ঘোষনা, সে বর্তমান থিয়েটার প্রিন্ট বা ডিভিডি/ব্লু-রে প্রিন্ট, দেয়া হয় নি ২. ইতিহাসের বিকৃতি করা হয়েছে তা স্বীকার করা হয় নি, বরং ‘ফিকটিশাস স্টোরি’ বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
এর ফলে কি হবে? এক বছর পর থেকেই গুণ্ডে চলচ্চিত্র দেখে কোন দর্শক, যে বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস সম্পর্কে ভালো ধারনা রাখে না, গুণ্ডে সিনেমায় বিবৃত ইতিহাসকেই সত্য বলে ধরে নেবে। উইকিপিডিয়ায় গুণ্ডে সিনেমার পাতায় ‘কন্ট্রোভার্সি’ শিরোনামে দুটো প্যারাগ্রাফ লেখা থাকবে বটে, কিন্তু কতজন দর্শক সেই পাতা পড়ে দেখবে সেটা প্রশ্ন। ‘দুঃখপ্রকাশ’ সিনেমার কোথাও থাকবে না, ব্লগস্পটের পাতায় শত পোস্টের ভীড়ে তলিয়ে যাবে, কিন্তু থেকে যাবে বিকৃত ইতিহাস সম্বলিত সিনেমা।
গুণ্ডে সিনেমা থেকে একটু সরে আসি। কিছুদিন আগেই কোলকাতায় ‘দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড’ (পরবর্তীতে নাম পাল্টে ‘চিল্ড্রেন অব ওয়ার’) সিনেমার ট্রেলার মুক্তি দেয়ার পর বাংলাদেশে ব্যাপক আলোড়ন তৈরী হয়। আমি খুঁজে বের করতে পারি নি, কিন্তু যতটুকু মনে পড়ে – বাংলাদেশে যেন ‘দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড’ মুক্তি দেয়া হয় তার জন্য গ্রুপ/পেজ/ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছিল। গুগল করে এ প্রসঙ্গে ঢাকাটাইমস২৪ পত্রিকার শিরোনাম পাওয়া যায় অবশ্য। ‘দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড’ চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটও ১৯৭১ এবং বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের যন্ত্রনা-কষ্ট নিয়ে নির্মিত।
‘গুণ্ডে’ এবং ‘দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড’ – দুটো সিনেমারই সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল এগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কোন না কোনভাবে তুলে ধরেছে। প্রশ্ন হল – তারা কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছে? বাংলাদেশের স্বার্থে? আমি তা মনে করি না। ভারতের স্বার্থেই এই ধরনের চলচ্চিত্র নির্মিত হয় বা চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ স্থান পায়। সিনেমায় বাংলাদেশ বড় হয়ে উঠে না, বরং ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তান ছোট হয়। These films are not FOR Bangladesh, but AGAINST Pakistan. পাকিস্তানের অ্যাগেইন্স্টে হোক, কিন্তু ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে যদি ভারতের স্বার্থবৃদ্ধি হয়, তবে বাংলাদেশের স্বার্থেও কিন্তু হানি হয় – এই সতর্কতা এদেশের দর্শকদের মধ্যে থাকা উচিত।
এখানে প্রাসঙ্গিক বলে উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করছি। ‘দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড’ সিনেমায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে গ্লোরিয়াসলি উপস্থাপন করা হয়েছে বলেই কি এই ছবিকে বাংলাদেশের সিনেমাহলে মুক্তি দেয়ার দাবী করা উচিত? বাংলাদেশের গল্প বলেই কি এই ছবিটা ভারতীয় ছবি থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং বাংলাদেশের সিনেমাহলে ব্যবসা করার যৌক্তিকতা লাভ করে? সম্ভবত না। ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানীর পক্ষে এবং বিপক্ষে ব্যবসা-ই সবচে বড় প্রভাবক। মুক্তিযুদ্ধের মোড়কে যদি ভারতীয় সিনেমা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে, তবে অন্যান্য সিনেমাও একসময় প্রবেশ করবে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মত করে এই দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি দখল করার যে আশংকা আমরা করি তাকেও সত্য প্রমাণিত করতে পারে। ভেবে দেখা উচিত।
(যতটুকু জানি – দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড মুক্তি পেয়েছে গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। ট্রেলার মুক্তির পর সোশ্যাল মিডিয়ায় যতটুকু আলোড়ন টের পেয়েছিলাম – মুক্তির পর সেটা দেখি নি। এই পোস্টের পাঠকদের মধ্যে যদি কেউ দেখে থাকেন – তবে কাইন্ডলি ছবিটি সম্পর্কে মতামত জানাবেন, বিশেষ করে ইতিহাসের চিত্রায়ন সম্পর্কে)
‘গুণ্ডে’ নিয়ে শুরু করেছিলাম, ‘গুণ্ডে’তেই শেষ করতে চাই। আমি মনে করছি – যশরাজ ফিল্মসের দুঃখপ্রকাশে সন্তুষ্ট হওয়া উচিত হবে না। সিনেমায় বিবৃত ইতিহাস যে বিকৃত সেটা স্বীকার করা এবং কমপক্ষে ডিভিডি/ব্লু-রে ভার্সনে সিনেমার শুরুতেই যেন এ বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য থাকে তার দাবী করা উচিত। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত চলচ্চিত্র নির্মানের জন্য আরও বেশী উদ্যোগী হওয়া উচিত। সরকারী/বেসরকারী অনুদানে যেন বছরে কমপক্ষে একটি ভালো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয় তার দাবী তোলা যেতে পারে। ‘জীবনঢুলী’র মত চলচ্চিত্র যেন শুধু পাবলিক লাইব্রেরীর মত জায়গায় সীমাবদ্ধ না থাকে এবং সারা দেশের দর্শকের কাছে পৌছাতে পারে – সেক্ষেত্রেও সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। আর সর্বশেষে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের জন্য আমাদের ‘হা’ করে রাখা যে মুখ, বাংলাদেশী সিনেমার স্বার্থে সেটাও কিছু সময় পর্যন্ত হলেও বন্ধ করা উচিত।
valo laglo..vijan…:D