জৈন্তাপুর ও অন্যান্য

সকাল থেকে বৃষ্টিতে ভিজছি। গায়ের জামা ভিজে আবার শুকিয়ে আবার ভিজেছে। প্যান্ট ভারি হয়ে কোমরে চাপ বাড়াচ্ছে, কাধের ব্যাগ যার অস্তিত্বই টের পাওয়ার কথা না, সেটা দুই কাধে কেটে বসতে চাচ্ছে। বুঝতে পারছি ব্যাগে রক্ষিত একমাত্র জিন্সপ্যান্টটি ভিজে গিয়েছে। দুই পায়ে কাপড়ের কেডস ভিজেছে ভালোই, বাসে জুতা খুলে বসেছিলাম। পানিতে ভিজে পায়ের রং ফ্যাকাশে সাদা হয়ে গেছে। এই ভেজা জুতা নিয়ে আরও একদিন ভ্রমন কিভাবে সম্ভব জানা নেই। গলার ভেজা গামছাটা নিংড়ে আবার গলায় ঝুলিয়ে দিলাম

আমি দাড়িয়ে আছি জৈন্তাপুর বাসস্টপেজে, একটা দোকানের ঝাপির নিচে। ছেলেরা গেছে জৈন্তাপুর রাজবাড়িটা কোথায় সেটা জানার জন্য। জৈন্তাপুর রাজবাড়ী নিয়ে আমার খুব বেশী আশা নেই। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের যে কটা জমিদার বাড়ি বা রাজবাড়ী ভ্রমন করার সুযোগ হয়েছে তার অল্প কটাই আগের সেই রূপে বর্তমান। কিছুর অবস্থা এতটাই খারাপ যে সীমানা পিলারও বোঝা যায় না, কোথাও একদলা ইট দেখে বুঝতে হয় এটাই সেই রাজবাড়ি। জৈন্তাপুর রাজবাড়ি যদি খুব বিখ্যাত হত তবে অবশ্যই ছবি দেখা হয়ে যেত। মাহদীকে আপডেট জিজ্ঞাসা করতেই জানা গেল রাজবাড়িটা এখানেই, এক মিনিট হাটতে হবে। হাটার প্রয়োজন হল না। আসলে জৈন্তাপুর বাসস্টপেজটাই রাজবাড়ির সাথে। রাজবাড়ির দেয়ালের পাশ দিয়েই মহাসড়ক গিয়েছে, কিন্তু সেই দেয়াল এখন এক প্রকার অদৃশ্য হয়ে আছে ছোট ছোট দোকানের আড়ালে। আর দালানের উচ্চতা মাত্র একতলা, সুতরাং পাশ দিয়ে আসা যাওয়ার সময় কেউ খেয়াল করবে না।

বাচ্চারা খুব হতাশ, তারা রাজবাড়ির গেটের সামনেও বেশী সময় দাড়ালো না। জ্যাক এর প্রয়োজন একটা বিক্যাশ এর কাউন্টার, ঢাকা থেকে টাকা আসবে তার। যুবা’র প্রয়োজন এক জোড়া স্যান্ডেল। সুতরাং তারা সেদিকেই গেল। আমি আর মাহদী দুজনে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

জৈন্তাপুর রাজবাড়ির সদর দরজা। ঝকঝকে আলোয় ছবিটি তোলা গেলে হয়তো আরও ভালো লাগতো। দুর্বল ক্যামেরায় এর বেশী কিছু সম্ভব ছিল না।

ফটকের বামদিকের গায়ে একটি নামফলক। আনাড়ি এই ছবিটির জন্য দু:খিত।

ফটকের ঠিক ভেতরেই – বোধহয় গার্ড রু

জ্যাক বলে, সম্ভবত এই স্ট্রাকচারগুলা স্টোন এইজ যুগের। আমি জানি না। তবে বাংলাপিডিয়ায় অনেক তথ্য পাওয়া গেল এই নিয়ে। কিছু তথ্য তুলে দিচ্ছি।

জৈন্তাপুর তার অবস্থানগত সুবিধার কারণে বেশীর ভাগই স্বাধীন রাজ্য ছিল। ৭ম/৮ম শতাব্দীতে কামরুপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়, পরবর্তীতে চন্দ্র ও বর্মন শাসকদেরও অন্তর্গত রাজ্য হিসেবে পরিচালিত হয়েছিল। তাদের পরে দেব শাসনামলের শেষ শাসক জয়ন্ত রায়ের মেয়ে জয়ন্তী বিয়ে করেছিল খাসিয়া প্রধাণকে। সুতরাং রাজকন্যাকে বিবাহের মাধ্যমে জৈন্তাপুর খাসিয়া রাজ্যের অন্তুর্ভুক্ত হয়ে গেল। এটা ১৫০০ সালের কথা। তারপর থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত এই রাজ্য স্বাধীন থাকে, তারপর ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়।
জৈন্তাপুর রাজবাড়ি আসলে জৈন্তাশ্বরী মন্দির যা নির্মিত হয়েছিল জৈন্তা রাজা লক্ষী সিনহা কর্তৃক ১৬০২ সালে। বিশালাকৃতির পাথর নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনাগুলো সাধারণত কবর চিহ্নিত করতে তৈরী হয় যা আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় এই ধরনের স্থাপনা দেখা গেলেও বাংলাদেশে এটাই একমাত্র। দুই ধরনের পাথর দেখা যায় এই ধরনের স্থাপনায়। একটি হরাইজোন্টাল – দন্ডায়মান স্থাপনা, অন্যটি হল ভার্টিকাল বা পাথরের টেবিল। বলা হচ্ছে জৈন্তাপুরে মোট ২৫টি হরাইজোন্টাল এবং ৩২টি ভার্টিকাল পাথর রয়েছে। কবে এই পাথর গুলো আনা হয়েছিল সেটা সঠিকভাবে জানা সম্ভব না হলেও ধারনা করা হয় খ্রীষ্টপূর্ব ১২০০ বছর আগে এই স্থাপনাগুলো তৈরী হয়েছিল।

ব্লগার রেজওয়ানা আপুর কাছ থেকে পাওয়া গেলো আরও কিছু তথ্য, সেগুলোই যোগ করে দিলাম এখানে।

মানেই যে সমাধি হবে এমন না, এটা স্মারক সৌধও হতে পারে। আর জৈন্তাপুরের মেগালিথিক গুলোর কোনটাতেই পদ্ধতিগত কোন উৎখনন না হবার কারণে এটা এখনও নিশ্চিত নয় যে এগুলো আসলেই সমাধি সৌধ কিনা, এবং এগুলো নিয়ে প্রত্নতাত্বিকদের মধ্য বেশ কয়েকি হাইপোথিসসি ও আছে। সেই ঝামেলা আমরা না গেলাম! আমি আর একটু এড করছি এ ব্যাপারে, যাতে সকলের এই এলাকাটির গুরুত্ব বুঝতে সুবিধা হয়।

নিওলিথিক-চ্যলকোলিথিক সময়ে অর্থাৎ খ্রী: তৃতীয় শতকের মাঝামাঝিতে মেগালিথিক সংস্কৃতির উদ্ভব হয়। মেগালিথিক হলো বড় পাথরের খন্ড, এগুলো একক ভাবে অথবা কয়েকটি এক সাথে করে সমাধি স্থাপত্য নির্মান করা হত। এই স্থাপত্য কাঠামো তৈরিতে কোন মর্টার বা সংযোজক পদার্থ ব্যবহার করা হতো না, পাথর গুলো ইন্টারলকিং পদ্ধতিতে জোড়া লাগানো হতো।

মেগালোথিক সাধারণত দুই রকমের হয়। মেনহির আর ডলমেন।

সাধারণত লম্বা, খাড়া একটা পাথর খন্ড দিয়ে তৈরি হয় মেনহির। এটা একটা পাথর অথবা অনেক গুলো দন্ডায়মান পাথরের সমস্টি হতে পারে। এগুলো সারি বদ্ধ, গোলাকার ভাবে সাজানো থাকতে পারে। মেনহির সাধারণত স্মারক সৌধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

আর ডলমেন অনেকটা টেবিল আকৃতির। দুই, তিন বা ততোধিক পাথর খন্ডের উপরে পাথরের স্লাব বসিয়ে তৈরি হয় ডলমেন। ডলমেনের ভিতরে এক বা একাধিক চেম্বার থাকতে পারে এবং এখানেই মৃতদেহ রাখা হতো। এগুলো স্মারক ও সমাধি, এই দুই কাজে ব্যবহার করার নিদর্শন পাওয়া যায়। দক্ষিন ভারতের বেশির ভাগ ডলমেনের নীচেই সামাধির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। জৈন্তাপূরে এই দুই ধরণের মেগালিথিক স্থাপত্যই দেখা যায়। এখানে ২৫ টি ডলমেন আর ৩২টি মেনহির আছে।

জৈন্তাপুরের এই মেগেলিথিক সৌধ এলাকায় এখনও পর্যন্ত কোন পদ্ধতিগত প্রত্নতাত্বিক উৎখনন হয়নি, তাই এগুলো আসলেই মেগালিথিক সমাধি সৌধ না স্মারক সৌধ, সময়কাল কত ইত্যাদি বিষয় গুলো এখনও বিতর্কিত রয়ে গেছে। তবে অনেক গবেষক এগুলো রাজকীয় বিচার কাজের আসন, বানিজ্যক টোল আদায়ের কেন্দ্র ছিল, বিশ্রামের জায়গা ইত্যাদি হিসেবে ব্যাখা দিয়েছেন।

উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত আয়ারল্যান্ডের একটি মেগালিথিক স্ট্রাকচার

রাজবাড়ির সদর দরজার বামদিকের দেয়াল, মেগালিথিক স্ট্রাকচারগুলো কি বোঝা যাচ্ছে?

ভালো করে খেয়াল করুন। দেয়ালের বাম কোনায় সম্ভবত একটি ঘোড়া দেখা যাচ্ছে। মাঝে পিলারের সাথেই যে মানুষটা তার হাতে রয়েছে লম্বা একটি বর্শা।

এখানেও ভালো করে দেখুন। সেই মানুষটার বর্শা গেথেছে দুই পিলারের মাঝে অংকিত হাতিটির বুকে।

বাংলাপিডিয়ায় এই স্থাপনাটি একটি সিরিজের অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছে। অবশ্য আমাদের পক্ষে এর বেশী কিছু দেখার সুযোগ হয় নি। রাজবাড়ির ভেতরে টিনের চালার একটি মাত্র ঘর। ঘরের গঠনপ্রকৃতি দেখে রাজবাড়ির দেয়ালের মত পুরাতন বলে মনে হয় না। ভেতরে মাত্র একটিই রুম। দরজার সাথে একটি গরু বৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করেছে, এক কোনায় কয়েকটা বাচ্চা ছেলে সাপ লুডু খেলছে। ঘরের ভেতরে একটি বেদী। কোথাও কোন বর্ণনা পাওয়া গেল না, তবে এ সংক্রান্ত একটি বই যে পাওয়া যাবে তা জানা গেল।

জৈন্তাপূর থেকে একটু ভেতরে রয়েছে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির। বর্তমান কাঠামোর মধ্যে রয়েছে বৃষ্টিতে ডুবে যাওয়া জমিতে একটি চারকোনা ঘর।

জুমার নামাজ শেষ হল, আমরা জৈন্তাপূর ভ্রমন শেষ করলাম। এবার ফিরতে হবে সিলেট শহরে। সেখানে খাওয়া দাওয়া, তারপর সময় থাকলে শাবিপ্রবি এবং যদি সুযোগ পাওয়া যায়, তবে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের কক্ষের সামনে দাড়ায়া একটা ফটু (মাহদী এই খবরটা দিল, কেউ কেউ নাকি এইরকম ছবি আপলোডও করে :পি)। ওয়েব ঘেটে মাহদী জেনে এসেছে – সিলেটে খাবার জন্য বিখ্যাত দুটো হোটেল। একটার নাম উন ডাল (Woon Daal), আরেকটা হোটেলের নাম সম্ভবত পাচ ভাই হোটেল। আমরা খাবো এক বেলা, সুতরাং কোন একটিকে বেছে নিতে হবে। পাচ ভাই হোটেলের বৈশিষ্ট্য নাকি বিভিন্ন পদের বাংলা খাবার পাওয়া যায়, ভর্তা ভাজিই নাকি প্রায় দশপদ। আর, উন্ডাল হোটেলে স্পেশাল কাচ্চি – সেখানে খাসি এবং মুর্গী দুইটাই দেয়। ফকিরের মত ভ্রমণ করছি, খাওয়ার জন্য বিলাসিতা করা সাজে না। কিন্তু জ্যাক-এর টাকা আসছে ঢাকা থেকে, সুতরাং সে পুরোটা বহন না করে পার্ট বহন করলেও এই জমিদারী দেখানো সম্ভব। এই আশায় আমরা উন্ডাল হোটেলে চলে গেলাম, জ্যাক গেল টাকা তুলতে। পূর্ব জিন্দাবাজারে অবস্থিত উন্ডাল হোটেল বেশ অভিজাত রেস্তোরা। খাবারের দামও সেইরকম। কাচ্চি ১৮০ টাকা।

আমাদের পরিকল্পনা ছিল, রাতে কুলাউড়ায় চলে যাবো, সেখানে হোটেলে রাত কাটিয়ে সকালে মাধবকুন্ড। কিন্তু কুলাউড়ার বাস পাওয়া গেল না, ট্রেনে গেলে পৌছুতে পৌছুতে রাত সাড়ে বা্রোটা। হোটেল পাওয়া যাবে কিনা সে নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ। সুতরাং শ্রীমঙ্গলের বাসে উঠে গভীর ঘুম দিলাম। শ্রীমঙ্গলে নেমে হোটেল খুজে দুটো রুম নিয়ে নিলাম ৫০০ টাকায়। ৫ জন থাকা যাবে। হোটেলে বাথরুমের দরজায় একটু সমস্যা, ধাক্কা দিলে খুলে যায়, আর বাতিতেও একটু সমস্যা। মিনিট দুয়েক পরে অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়, তখন গুতা দেয়া লাগে।

আমাদের অন্য কোন উপায় নাই, জ্যাক দুপুরের কাচ্চিতে অতিরিক্ত এক টাকাও শেয়ার করে নাই। গত রাতে ট্রেনের গার্ড কম্পার্টমেন্টে ঘুমানোর ফলে আর সারাদিনের ভ্রমনে আমরা বেশ কিছু টাকা বাচিয়ে ফেলেছি – সুতরাং কোন সমস্যা ছাড়াই চলে যাবে এ যাত্রা।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *