খুব যত্ন আর গাঢ় মনযোগ নিয়ে ধীরে ধীরে আমার টাইয়ের নট বেঁধে দিচ্ছে স্বপ্না। টাই বাঁধাটা আমিই শিখিয়েছিলাম। তারপর থেকে প্রতিদিনই সে যত্ন করে বেঁধে দেয়। নট্টা নেড়ে চেড়ে জায়গামত বসিয়ে দিল স্বপ্না। চোখে চোখ রাখল। মুখে গাঢ় অন্ধকার, নিচের ঠোট আলতো করে কামড়ে ধরে রেখেছে। তারপর প্রচন্ড আবেগ, ভালোবাসা আর মমত্ব নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে, পিষে ফেলবে যেন! অনেকদিন যা করিনি, আজ শিশুর মত কেঁদে ফেললাম। স্বপ্না ছাড়ল না, কিছু বলল না, সান্তনাও দিলনা। শুধু বাঁধন আরেকটু শক্ত হল।
গত সাড়ে তিন বছরের কিছুটা বেশী সময় এভাবেই বেঁধে রেখেছে স্বপ্না আমাকে, তার জোড়া হাত, গভীর অন্ধকার চোখ, আর অন্তহীন ভালোবাসা দিয়ে। প্রত্যেকটি দুঃসময়ে পাশে থেকেছে স্বপ্না, আমার ছোট্ট খুটিটি হয়ে দাড়িয়েছে। গত চারমাস যাবৎ এই খুটিটি নড়চড় হয়নি একবিন্দুও, বরং প্রতিনিয়তই মজবুত হচ্ছে। শুধূ দুর্বল হয়ে যাচ্ছি আমি, ভাঙতে পারছি না নিজেকে, স্বপ্নার জন্য!
আমাদের সাংসারিক জীবনের সবচেয়ে বাজে সময় যাচ্ছে গত চারমাস ধরে। প্রথম আঘাতটা অবশ্য স্বপ্নার ওপরই আসে। ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা থেকে পেটে সাড়ে সাতমাস বয়সের বাচ্চাটা মরে গেল। দুদিন বেঁহুশ হয়ে নার্সিং হোমের বেডে শুয়ে থাকল স্বপ্না। বাকী ছয়দিন কাদঁল। তারপর চুপ মেরে গেল। হাসিটা কমে গেল। কিন্তু সমস্যা বেড়ে গেল।
স্বপ্নার অসুস্থ্যতাকে কেন্দ্র করে সাতান্ন হাজার টাকা বেড়িয়ে গেল। ধার করলাম ষোল হাজার টাকা। অস্বাভাবিক প্রয়োজন ছাড়া কখনো ধার করি না বলে এই ষোল হাজার টাকা পাথর হয়ে চেপে বসেছে। কাটিয়ে উঠব ভেবেছিলাম। পারতামও যদি আমার অফিসে নতুন ঝামেলায় না জড়াতাম। আমার সই করা কিছু ফাইলে বড় অংকের টাকার গোলমালে কোম্পানির বড় দুটি প্রজেক্ট হাতছাড়া গেল। এখন তার তদন্ত চলছে। শাস্তি হিসেবে আমি সহ আরও তিনজন সাসপেন্ডেড। বেতন বন্ধ হয়ে আছে দুমাস যাবত। আমাদের জড়িত থাকা প্রমাণিত হলে চাকরি চলে যাবে। স্বপ্নাকে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়ে যাব আমি। প্রতিদিন অফিসে যাই, খোঁজখবর আর চেষ্টা করি যদি কিছু উন্নতি করা যায়।
আম্মা গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে পড়ে রয়েছে মেজো ভাইয়ের বাসায়। আমাদের দেখতে চেয়েছে। যেতে পারছি না এ সকল সমস্যার কারনে। স্বপ্নাকে বলেছি চলে যেতে। স্বপ্না রাজী হচ্ছে না। বলেছে আমাকে ফেলে যাবে না। অথচ মাকে দেখার জন্য ছটফট করছি। ঢাকায় এসে থাকছি বছর খানেক ধরে। প্রত্যেকমাসে অন্তত একবার করে গিয়েছি মা’র ওখানে। গত চার মাস সেটাও বন্ধ। মা প্রতিদিন একবার করে ফোন করে।
এত সমস্যা আর সইতে পারছি না। হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করছে। সহজে হারি না আমি। আগে ভেঙ্গে পড়িনি কখনো। কিন্তু এবার আর পারছি না। স্বপ্নার শক্ত বাধন আমাকে প্রতিবার শক্তি যোগায়। কাটিয়ে তোলে সকল বাধা বিপত্তি। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি,করতে চেষ্টা করি- এবারও পারব, আর সামান্য কটা দিন। অবশ্যই সমস্যা কেটে যাবে। আমাদের ছোট্ট বাবু হবে। আমার চাকুরীর সমস্যার সমাধান হবে, মা সুস্থ্য হয়ে যাবেন, আমরা মোটামুটি স্বচ্ছল জীবন যাপন করব। শুধু ক’টা দিন সহ্য করতে হবে। এই গভীর ভালোবাসা, প্রগাঢ় মমত্ব আর দু’বাহুর শক্ত বাঁধনের কাছে কোন সমস্যাই সমস্যা নয়।
আমি স্বপ্নার কপালে একটি গভীর চুমু আকঁলাম।