ইসলামী ব্যাংকিং: ঘুরিয়ে সুদ খাওয়া বিষয়ক তিনটি বই পরিচিতি ও অন্যান্য আলাপ

ইসলামী-ব্যাংকিং

‘সুদী ব্যাংকিং এবং ইসলামী ব্যাংকিং এর মধ্যে আদতে কোন পার্থক্য নেই, ইসলামী ব্যাংক ঘুরিয়ে সুদ খায়, বাকীরা সরাসরি খায়’ – ইসলামিক ব্যাংকিং এর বিষয়ে এটা খুব প্রচলিত অভিযোগ। ইসলামিক ব্যাংকিং বিরোধিরা তো করেনই, সুদের বিপক্ষে অবস্থানকারী অনেক ইসলামপন্থীও এই অভিযোগ করেন। আরেকটি প্রচলিত অভিযোগ তোলেন – সাধারণত ইসলামিক ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ নিয়েছেন এমন ব্যক্তি। অভিযোগটি হলো – ‘ইসলামিক ব্যাংক যদি লাভ-লোকসানের শর্তেই ঋণ দেয় তাহলে আমার ব্যবসায়ের লোকসান কেন বহন করে না?’ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার আগে থেকেই জানা ছিল, কিন্তু গত দুই সপ্তাহে এ সংক্রান্ত কিছু পড়াশোনার কারণে নতুন করে বিষয়টা সামনে এলো। এই পোস্টে তিনটি বই সহ ইসলামিক ব্যাংকিং বিষয়ক আরও কিছু আলাপ করবো।

বই: ইসলামী ব্যাংকগুলো কি ঘুরিয়ে সুদ খায়?

ইসলামী ব্যাংকগুলো কি ঘুরিয়ে সুদ খায়?‘ – এই শিরোনামে যে বইটি পড়েছি সেটা পিডিএফ, লেখক হামিদা মুবাশ্বেরা। সম্ভবতঃ লেখক সোশ্যাল মিডিয়ায় ধারাবাহিকভাবে এই বিষয়ে লিখেছিলেন এবং এই লিখাগুলোকেই সংকলিত করে অনানুষ্ঠানিকভাবে এই বইটি প্রকাশ করা হয়েছে। হামিদা মুবাশ্বেরা একই সাথে কনভেনশনাল ও ইসলামিক ইকনোমিক্স এবং শরীয়াহ বিষয়ে জ্ঞান রাখেন, লেখক হিসেবেও বাংলাদেশের অনেক ইসলামপ্রেমীর নিকট সুপরিচিত। পিএইচডি গবেষক এই লেখকের ইসলামিক ইকনোমিক্স বিষয়ে কয়েকটি আর্টিকেল আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

হামিদা মুবাশ্বেরার বইতে সংক্ষেপে এবং সরাসরি ইসলামিক ব্যাংকগুলো ঘুরিয়ে সুদ খায় কি-না সে প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে। ইসলামিক ব্যাংকিং কী, সুদ কী, ইসলামিক ব্যাংকগুলো কী পদ্ধতিতে ব্যাংকিং করে ইত্যাদি বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। ইসলামিক ব্যাংকগুলোর কর্মকান্ডে যদি সুদের মিশ্রণ ঘটে তবে ব্যাংকগুলো কি করে এবং ইসলামিক ব্যাংকগুলো যদি সুদ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকতে না পারে সেক্ষেত্রে গ্রাহকের বা সাধারণ জনগণের কী করা উচিত সে বিষয়েও তিনি লিখেছেন।

মাত্র ২৭ পৃষ্ঠার এই পিডিএফ ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রথম ধাপ হতে পারে। তবে, মনে রাখতে হবে, হামিদা মুবাশ্বেরা ব্যাংকার নন এবং তিনি তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ হতে এই লিখাগুলো লিখেছেন। এছাড়া পুস্তকাকারে প্রকাশের উদ্দেশ্যে লিখলে যতটা ব্যপ্তি এবং গোছানো হতো ততটা নয় কিন্তু এজন্য পাঠককে হতাশ হতে হবে না। হয়তো ভবিষ্যতে তিনি এই বিষয়ে চমৎকার একটি বই প্রকাশ করবেন।

বই: ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা

হামিদা মুবাশ্বেরার বইয়ের ঘাটতি পূরণের জন্য এবং ইসলামিক ব্যাংকিং বিষয়ে আরও একটু ভালো জানার জন্য মোহাম্মদ আবদুল মান্নান রচিত ‘ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা‘ বইটি পড়া যেতে পারে। এই বইতে কনভেনশনাল অর্থনীতি, সুদ, ইসলামী ব্যাংকিং ইত্যাদি বিষয়ে একজন অভিজ্ঞ ব্যাংকারের বয়ান পাওয়া যাবে।

মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আইবিবিএল দখলের পূর্বে তিনিই এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ইসলামী ব্যাংকিং-এ তিনি প্রায় সাতাশ বছরের অভিজ্ঞ। লেখক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন বলে জেনেছি।

দুই শতাধিক পৃষ্ঠার এই বইতে তিনি একদম প্রাচীনকালের ব্যাংকিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন মুসলিম স্কলারদের অবদান, সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার ইতিহাস ইত্যাদি তুলে ধরেছেন। এছাড়া সুদ কী, সুদ কিভাবে হতে পারে, কুরআন-হাদীসে সুদ বিষয়ে কী বলা রয়েছে ইত্যাদি বিষয়গুলো তিনি অল্প কিছু পৃষ্ঠায় ব্যক্ত করেছেন। তারপর কয়েকটি অধ্যায় জুড়ে ইসলামিক ব্যাংকিং এর উদ্ভব, অগ্রগতি, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ইত্যাদি ইতিহাস তুলে ধরেছেন। সুদভিত্তিক ও ইসলামিক ব্যাংকিং এর তুলনামূলক আলোচনাও করেছেন কিছু জায়গায়। এরপর ইসলামিক ব্যাংকিং এর পদ্ধতি, চ্যালেঞ্জ, প্রচলিত সমালোচনা ও তার জবাব এবং কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করেছেন শেষের অধ্যায়গুলোতে।

সুপাঠ্য এই বইটি ইসলামিক ব্যাংকিং পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে সক্ষম। এছাড়া, ইসলামিক ব্যাংকিং নিয়ে প্রচলিত কিছু সমালোচনার জবাব বা ব্যাখ্যা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইসলামিক ব্যাংকিং এর সাথে সুদের মিশ্রণ সম্পর্কে ইসলামিক ব্যাংকিংগুলোর গৃহীত পদক্ষেপ কী সে বিষয়ে জবাব পাওয়া যাবে এই বইতে। তবে, যেহেতু আইবিবিএল এর তৎকালীন এমডি এই বইটির লেখক, সেহেতু তিনি এই বইটিকে ইসলামিক ব্যাংকিং-এর প্রচারণার লিখেছিলেন বলে ধারণা করি। কিন্তু, আমি এই বইটিকে গুরুত্ব দিতে চাই এই কারণে যে, এই বইয়ের লেখক দীর্ঘ সময় ব্যাংকিং পেশায় নিয়োজিত ছিলেন এবং ইসলামিক ব্যাংকিং এর সমস্যা ও এর জবাব/সমাধান সম্পর্কে তিনিই ভালো জানবেন। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু গোপন করে গিয়েছেন কি-না সেই বিষয়টি ইসলামিক ব্যাংকিং এর সাথে জড়িত অথবা গভীর ধারণা রাখেন এমন কেউ বলতে পারবেন।

বই: ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা

আবদুল মান্নানের বইটিই ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে জানার জন্য যথেষ্ট, তবে কেউ যদি ইসলামিক ব্যাংকগুলোর ‘ঘুরিয়ে সুদ খাওয়া’ বিষয়ে আরেকটু গভীরে যেতে চান তিনি মুহাম্মদ শামসুদ্দোহা রচিত ‘ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা‘ বইটি পড়তে পারেন। এই বইটিও হামিদা মুবাশ্বেরার বইয়ের মতো ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে প্রচলিত কিছু বিষয়ের জবাব প্রদান করার চেষ্টা করেছে তবে এর বৈশিষ্ট্য হলো – এখানে ইসলামী ব্যাংকিং এর অনুসৃত বিনিয়োগ পদ্ধতিগুলোর আরেকটু গভীর আলোচনা করা হয়েছে। লেখক অনেকগুলো উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। একশ ত্রিশ পৃষ্ঠার এই বইয়ের দুর্বল দিক হলো লেখক সম্পর্কে তথ্যের অভাব – কিচ্ছুটি নেই। বোধকরি তিনি কোন একটি ইসলামিক ব্যাংক এর কোন কর্মকর্তা।

উপরিল্লিখিত তিনটি বইয়ের মধ্যে বিস্তারিত ধারণার জন্য আবদুল মান্নান এবং সংক্ষেপে ধারণার জন্য হামিদা মুবাশ্বেরার বইটি পড়ার জন্য বলবো। সুদ থেকে যারা বেঁচে থাকতে চান এবং ইসলামিক ব্যাংকিং সম্পর্কে যাদের ধারণার ঘাটতি আছে তাদের জন্য বইগুলো নিঃসন্দেহে উপকারী।

ইসলামিক ব্যাংকিং এর কিছু সমস্যা

ইসলামিক ব্যাংকিং নিয়ে কিছু সমস্যা আমি ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করতে পারি। সে বিষয়ে সামান্য কিছু বলা প্রয়োজন।

প্রথমত, আমরা সুদ সম্পর্কেই জানি না। আরও বড় সমস্যা হলো – আমরা জানার চেষ্টাও করি না এবং নিজের মনে যে ধারণা আসে তাকেই সত্য বলে ধরে নেই। নিজস্ব ধারণা যে কতটা অদ্ভুত – সেটা অনেকের সাথে আলোচনা করলে তবেই বোঝা সম্ভব। কেউ সুদের হারকেই সুদ বলে মনে করেন, কেউ মহাজনের সুদকেই কেবল সুদ হিসেবে মেনে নিয়েছেন। প্রকৃত সংজ্ঞা কুরআন-হাদীসে রয়েছে, শত শত বছর ধরে তার আলোকে আলেমগণ এর ব্যাখ্যা করেছেন, তার পুরোটা না হলেও কিছুটা আবশ্যিকভাবে জেনে নেয়া উচিত।

দ্বিতীয়ত, আমরা ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কেও ধারণা রাখি না। ফলে ইসলামিক ব্যাংকগুলো কী পদ্ধতিতে আমানত গ্রহণ করেন এবং কী পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করেন, কিভাবে আয় করেন, কিভাবে লাভ-লোকসান শেয়ার করেন তার ধারণা রাখি না এবং এক্ষেত্রেও মনগড়া ধারণাকেই সত্য হিসেবে ধরে নেই ও তার ভিত্তিতে যত্রতত্র মতামত প্রকাশ করি। এই বিষয়টি উপলব্ধি করতঃ জ্ঞানার্জনের উদ্যোগ নেয়া উচিত।

তৃতীয়ত, ইসলামিক ব্যাংকগুলো সাধারণ মানুষদের অজ্ঞতা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। একমাত্র আইবিবিএল-কেই এই বিষয়ে যা পদক্ষেপ নিতে দেখেছি। ইসলামিক ব্যাংকগুলো কেন ঋণ না দিয়ে বিনিয়োগ দেয়, লাভ লোকসানের শর্তে বিনিয়োগ দেয় কিনা এবং অবধারিতভাবে সুদ মিশ্রিত হয় এমন বিষয়গুলোতে তাদের অবস্থান কী ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে নিয়মিতভাবে প্রচার করা উচিত। ব্যাংকগুলোর নিজস্ব ওয়েবসাইটের একটি অংশে অথবা ইসলামিক ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে পৃথক কোন ওয়েবসাইটে এ বিষয়গুলো থাকতে পারে। যদি বিনামূল্যে কোন শর্ট কোর্স চালু করা হয় তবে সেটা তো আরও উত্তম কাজ হবে।

চতুর্থত, ইসলামী ব্যাংকিং শব্দটাও গোলমেলে। ব্যাংকিং শব্দের সাথে ঋণ অঙ্গাঙ্গী জড়িত। অথচ ইসলামিক ব্যাংকগুলো ঋণের কারবার করে না, তারা করে ব্যবসা, ক্রয়-বিক্রয়, ইজারা। যেহেতু বর্তমান এই সমাজে ইসলামী শিক্ষার প্রচলন কম এবং ব্যাংক বলতে প্রধানত সুদভিত্তিক ব্যাংকিংকেই বোঝানো হয়, সেহেতু ইসলামিক ব্যাংকিং শব্দটা স্বচ্ছ ধারণা প্রদান করে না। এর বিকল্প কোন সমাধান খোঁজ করা যেতে পারে।

পঞ্চমত, ইসলামিক ব্যাংকিং ধারণাটাকে আরোপিত বলে মনে হয়। কনভেনশনাল ব্যাংকিংকে ইসলামিকীকরনের চেষ্টা থেকে ইসলামিক ব্যাংকিং এর ধারণা তৈরি হয়েছে বলে মনে করি। সুদভিত্তিক ব্যাংক যে সকল কাজ করছে সেগুলোরই একটা ইসলামিক ভার্সন দাঁড় করানো হয়েছে যা সাধারণ মানুষের কাছে, যার কিনা ইসলামিক বিনিয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নেই, একই কাজ ঘুরিয়ে করা হিসেবেই ধরা দেয়। আর, মোহাইমিন পাটোয়ারির মতো স্বল্পজ্ঞানসম্পন্ন লোকেরা তখন যুক্তিহীন ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’র মত বই রচনা করে।

বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিং সফল হবে কি?

বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিং সফল হওয়া প্রায় অসম্ভব একটি বিষয় বলে আমার মনে হয়। এর প্রধান কারণ ইসলামি ব্যাংকিং সেবা প্রদান এবং গ্রহণের জন্য যথাযথ মানসিকতাসম্পন্ন লোকের অভাব। ব্যাংকিং ব্যবসায়ের সাথে পুঁজিবাদি মানসিকতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যারা ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবসায়ে নিয়োজিত আছেন, যারা নতুন করে আগ্রহী হচ্ছেন তাদের সকলেই একে পুঁজি বানানোর একটা শক্তিশালী উপায় বিবেচনা করেই এগিয়ে আসছেন। আইবিবিএল এর মালিকানা-ব্যবস্থাপনায় জোরপূর্বক পরিবর্তনের ঘটনা এর স্পষ্ট প্রমাণ। ইসলামিক জীবনধারণের প্রতি আকৃষ্ট জনগণের নিকট থাকা বিপুল পরিমাণ আমানত সংগ্রহের জন্য ইসলামিক ব্যাংকিং এর পোষাক চাপানো উৎকৃষ্ট পন্থা। ইদানিং শুনতে পাচ্ছি, কিছু ইসলামিক ব্যাংক নাকি সুদ থেকে তৈরি তহবিলের টাকা আয়খাতে স্থানান্তর করছে। ব্যাপারটা সত্যি কিনা তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব নিতে পারে ইসলামিক ব্যাংকিং বিষয়ের গবেষকরা।

ইসলামী ব্যাংকগুলো থেকে যারা বিনিয়োগ সুবিধা নিচ্ছে তাদের কত অংশ সৎ এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে এই বিনিয়োগ গ্রহণে আগ্রহী – তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। ব্যবসায়ে টিকে থাকতে হলে ঋণখেলাপী হওয়া যাবে না। শোনা যায়, ইসলামিক ব্যাংকগুলোর ব্যাংকিং পদ্ধতির কারণে সহজেই খেলাপী হওয়া এড়ানো যায় বলে ইসলামিক ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ গ্রহণে আগ্রহীর সংখ্যা বেড়েই চলছে।

ইসলামিক ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাদী মানসিকতাকেও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ইসলামিক ব্যাংকগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল মানুষের কল্যাণ। অথচ, সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে মানব কল্যাণের তুলনায় মুনাফা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এ কারণেই সম্ভবতঃ বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইবিবিএল এর শাখার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং সারাদেশে বিস্তৃত থাকলেও ডাচ বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথের সংখ্যা বেশি। আবার, শুধুমাত্র ইসলামিক ব্যাংক হওয়ার কারণেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রচুর আমানত সংগ্রহ করতে পারলেও তাদের মুনাফার হার সুদী ব্যাংকের তুলনায় কোনভাবেই কম নয় এবং অনেকক্ষেত্রে বেশি৷

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবহেলার বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। ইসলামী ব্যাংকিং এর নীতি-পদ্ধতি কনভেনশনাল ব্যাংকিং এর তুলনায় ভিন্নরকম হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় সকল নীতিমালা অভিন্ন। ব্যাংক কোম্পানী আইন সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যা কিছু পার্থক্য তা মূলতঃ ইসলামিক ব্যাংকগুলোর (প্রধানত আইবিবিএল) প্রচেষ্টার ফল। অথচ ইসলামিক ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়ের জন্য প্রধান যে নীতি, অর্থ্যাৎ লাভ-লোকসানের শর্তে বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান, সেই পরিবেশ নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব ছিল। ১৯৮৩ সালে দেশের প্রথম ইসলামিক ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়ে এখন দেশে এক ডজনের বেশি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক ব্যাংক এবং অনেকগুলো ব্যাংকের ইসলামিক ব্যাংকিং শাখা/উইন্ডো থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব কোন স্বতন্ত্র কেন্দ্রীয় শরীয়াহ বোর্ড নেই, শরীয়াহ সুপারভিশনও নেই। ফলে, ইসলামিক ব্যাংকগুলো প্রকৃতপক্ষেই ইসলামিক কিনা তার তদারকি নেই। ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকগুলোর সকল দোষত্রুটির জন্য আমি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই অবহেলা এবং বিমাতাসুলভ আচরনকেই দায়ী করবো।

বাংলাদেশে বর্তমানে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর যে অবস্থা, তা থেকে সহজে উত্তোরণের কোন উপায় দেখি না। বেশিরভাগ ইসলামিক ব্যাংক এমন গোষ্ঠির মালিকানাধীন যারা লুটপাটের জন্য কুখ্যাত হয়ে গিয়েছে। গ্রাহকদের একটি অংশ অন্যায় সুবিধা গ্রহণের জন্য ইসলামিক ব্যাংকিং এর বিনিয়োগ/সেবা গ্রহণ করেন। অথচ ইসলামী ব্যাংকিং মডেলের সফলতার প্রধান পূর্বশর্ত হলো ব্যাংকার ও গ্রাহকের সততা, তাকওয়া ইত্যাদি। দুই পক্ষই যদি ইসলামের নীতিগুলো মেনে চলতে আগ্রহী না না হয় বা মেনে না চলে, তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত এই মডেল কার্যকর হবে না। তা সত্ত্বেও, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক যথাযথ নীতিমালা জারী করা এবং সুপারভিশন নিশ্চিত করা হলে এবং ব্যাংক এ বিষয়ে আগ্রহী থাকলে হয়তো অনেকটা সফল করা যেতো।

কিছু পরামর্শ

যেহেতু প্রকৃত ইসলামী ব্যাংকিং এ আগ্রহী মানুষের সংখ্যা কম নয়, সেহেতু ইসলামী ব্যাংকিং সেবাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। যারা পণ্যদ্রব্য উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসায়ে নিয়োজিত, তারা ইসলামিক ক্রয়-বিক্রয়ের নীতিমালা গ্রহণ করে ধারে বিক্রয়ের সুবিধা প্রদান শুরু করতে পারেন। এক্ষেত্রে ব্যাংকের উপর নির্ভরতা কমানো সম্ভব। ব্যাংকিং পণ্যগুলোর অনেকগুলোকেই সার্ভিস মডেলে রূপান্তর করে প্রদান করা যেতে পারে। ব্যাংকগুলো মুনাফার প্রতিযোগিতা থেকে সরে এসে কল্যাণমুখী ব্যবসায়ে অধিকতর নিয়োজিত হওয়া উচিত। সর্বোপরি, লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে বিনিয়োগের উপরই গুরুত্ব প্রদান করতে হবে, এজন্য যদি ব্যবসায় সংকুচিত হয়, বৃহত্তর কল্যাণে সেটাই গ্রহণ করা উচিত। ইসলামিক ব্যাংকিং ও ব্যাবসায়ের খুঁটিনাটি সম্পর্কে জনসাধারণ যেন সহজে জ্ঞানার্জন করে তাদের লেনদেন এবং ব্যবসায় উদ্যোগের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

মনে রাখা উচিত – ইসলামী ব্যাংকিং, ইসলামিক ব্যবসায়, ইসলামিক লেনদেন সব কিছুরই উদ্দেশ্য একটিই – আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। সেই উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হলে যতই লাভজনক হোক না কেন, আদতে সেটা ক্ষতিকর।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

2 Comments on “ইসলামী ব্যাংকিং: ঘুরিয়ে সুদ খাওয়া বিষয়ক তিনটি বই পরিচিতি ও অন্যান্য আলাপ”

  1. অনেক সুন্দর আলোচনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। বইগুলো আমি সংগ্রহে রাখছি। এখন পড়ে দেখতে হবে। ইউটিউব বা কোন ভিডিও আলোচনা থাকলে আরও ভাল হত। যেদিন থেকে মানুষ সামাজিক হয়েছে, সেদিন থেকেই বোধকরি ব্যবসার প্রচলন শুরু হয়েছে। কাজেই মহানবী (স:) এবং খোলাফায়ে রাশেদিন সময়কালের ব্যবসা ও অর্থনীতি বিশ্লেষণ করলে আশা করি পুরো ইসলামি অর্থনীতি সিস্টেম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেত। সেই ধরনের আলোচনা বা বিশ্লেষণ পেলে আশা করি আমাদের সাথে শেয়ার করবেন। অনেক ধন্যবাদ এই আলোচনার জন্য।

    1. স্বাগতম প্রিয় আল আমিন হোসেন এবং আপনার চমৎকার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

      রাসূল (স) এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়কালের ব্যবসা ও অর্থনীতি নিয়ে গত চৌদ্দশ বছর ধরেই বিশ্লেষণ হচ্ছে এবং সেই অনুযায়ী ইসলামী অর্থনীতির একটা কাঠামোও তৈরী হয়েছে। গবেষণা আরও চলছে। বাংলাদেশেও এ বিষয়ে কিছু গবেষক রয়েছেন। এদের একজন ড. কবির হাসান তো সারা দুনিয়ায় বেশ পরিচিত, যদিও বাংলাদেশে অতটা পরিচিত নন। এছাড়া বাংলা ভাষায় বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে। আসলে কেউ যদি আগ্রহী হয় তাহলে যথেষ্ট রিসোর্স আছে, একটু গুগল করে দেখতে হবে কেবল। আল্লাহ তওফিক দিলে ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছা করি।

      ভালো থাকবেন 🙂

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *