নির্মলেন্দু গুণের একটি কাব্যগ্রন্থ আছে, নাম ‘মুঠোফোনের কাব্য‘। এই বইয়ের কবিতাগুলো নাকি তিনি মোবাইলে লিখেছেন। চলতি পথে যখনই তার মনে ভাবের উদয় হয়েছে, তিনি সেগুলো মোবাইলে টুকে রেখেছেন৷ পরে অবসরে সেগুলোকে ঘষে মেজে চূড়ান্ত করেছেন। এ কারণেই বইয়ের নাম মুঠোফোনের কাব্য।
কবি যখন এই কাজ করেছেন, ২০০৩ সালে, তখন স্মার্ট ফোন সম্ভবত আবিষ্কৃতই হয়নি, মোবাইলে বাংলা ফন্টও সহজলভ্য ছিল না। এমনকি, লিখার জন্য মোবাইল ফোনে লিখালিখির জন্য কোন এপ্লিকেশনও থাকতো না। মেসেজে সাতশর বেশি ক্যারেক্টার লিখার সুযোগ ছিল, সেখানেই লিখে ড্রাফট করে রাখতে হতো। সুতরাং কবি যে প্রচন্ড সংগ্রাম করে লিখেছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বেসিক ফোনে লিখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছেন এমন আরেকজনের নাম জানি। আখতারুজ্জামান আজাদ, ছড়াকার। তিনি বিশাল বিশাল ফেসবুক পোস্ট এবং ছড়া লিখে ফেসবুকে পোস্ট করে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার গোটা দশেক বই বেরিয়ে গিয়েছে, শীঘ্রই তিনি এক নামে চেনার মত বিখ্যাত হয়ে যাবেন বলে বিশ্বাস করি।
আমার প্রিয় বন্ধু সাকিব শাহরিয়ার একজন উদীয়মান ঔপন্যাসিক। তার দুটো বই ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তৃতীয় উপন্যাসও সমাপ্ত হয়েছে, প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। তার এই তিনটি উপন্যাসই মোবাইলে লিখা হয়েছে, তবে বেসিক ফোনে নয়, স্মার্টফোনে। দেশের বাহিরেও অনেক লেখক আছেন, বিশেষ করে যারা অন্য পেশায় যুক্ত থেকে লিখালিখি করেন, তারা মোবাইল ফোনকেই লিখালিখির জন্য বেছে নিয়েছেন।
বলে নেয়া ভালো, লিখালিখি বলতে আমি নিছক ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া, মন্তব্য করা ইত্যাদিকে বুঝাই নি বরং সময় নিয়ে চিন্তা ভাবনার সন্নিবেশ ঘটিয়ে যুক্তি তর্ক উদাহরণ ইত্যাদি উপস্থাপন করে প্রতিষ্ঠিত মিডিয়ায় প্রকাশযোগ্য কিছুকেই লেখালিখি বলছি।
লিখালিখির জন্য হোক বা ফেসবুকিং – ডেস্কটপ কম্পিউটার আমার প্রথম পছন্দ। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আমি লিখালিখি শুরু করেছি অনেকটা বাধ্য হয়ে এবং তাও মাত্র দেড় থেকে দুই বছর আগে। কর্মস্থল পাল্টানোর কারণে হঠাৎ করে আমার সময় নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেল। রাস্তায় থাকতে হয় চার থেকে পাঁচ ঘন্টা, বাসায় ফিরেও কম্পিউটারে বসার আগ্রহ পাই না। ফলে মোবাইলের উপর ভর করতে হলো। প্রধানত দুটো উদ্দেশ্য। এক, সময়কে কাজে লাগানো এবং দুই, লিখালিখির চর্চা চালিয়ে যাওয়া৷
লিখালিখির জন্য বিভিন্ন এপ্লিকেশন ব্যবহার করেছি। শুধু লিখালিখির জন্য অনেকগুলো এন্ড্রয়েড এপ্লিকেশন আছে। গ্রামারলি, জটারপ্যাড, মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, সেগুলো অনেক কাস্টমাইজড। কিন্তু কোনটাই আমার ভালো লাগলো না। লেখার ক্ষেত্রে আমি ঢং কম করি, ফলে শব্দ বোল্ড, ইটালিক বা আন্ডারলাইনড করা অথবা বিভিন্ন রং/ডিজাইনের ফন্ট ব্যবহার করার প্রয়োজন আমার হয় না। মোবাইলে অযথা এপ্লিকেশন ব্যবহার করার পক্ষপাতিও নই। ফলে গুগল কিপ ছাড়া আমার অন্য কোন এপ্লিকেশন পছন্দ হয় নি।
গুগল কিপ ব্যবহারের প্রধান দুটো সুবিধা। এক, আমি যে কোন ডিভাইসেই লিখতে পারছি। কারণ যা লিখছি তা ক্লাউডে জমা হচ্ছে এবং সিঙ্ক হয়ে যাচ্ছে। দুই, গুগল কিপ ব্যবহার করে আমার চেকলিস্ট, টু ডু লিস্ট টাইপের কাজগুলোও করতে পারছি।
মোবাইলে লিখালিখির কিছু সমস্যাও আছে। ঘরে বসে লিখলে সমস্যা হয় না, কিন্তু বাইরে লিখলে উৎসুক জনতা পড়ার চেষ্টা করে, এতে মনযোগের বিঘ্ন ঘটে, বিরক্তিও তৈরি হয়। এইমাত্র হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ আসলো – এটাও মোবাইলে লিখার অন্যতম সমস্যা। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো – লেখার প্যাটার্ণ। আমি অনুভব করতে পারছি, মোবাইলে এবং ডেস্কটপে লেখার মধ্যে গুণগত পার্থক্য হয়। যেমন, মোবাইলে অল্প লেখা হলেই মনে হয় অনেক লেখা হয়ে গিয়েছে। তখন মনের ভেতর থেকে লেখা শেষ করা বা সংক্ষেপ করার তাড়না তৈরি হয়। এমনকি বাক্যগঠনও প্রভাবিত হয় মোবাইলে লিখতে গেলে। আমি প্রায়ই কোন লেখা রিভাইস করার সময় দুটি বাক্যের মধ্যে সম্পর্কের ঘাটতি দেখতে পাই। অনেক সময় নতুন করে লিখতে হয়। এটা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন রকম হতে পারে৷ সবচেয়ে বড় ব্যাপার, মোবাইলে লিখতে সময় অনেক বেশি ব্যয় হয়। তবে এই সময় যদি রাস্তাঘাটে ব্যয় হয় তখন সেটা অপচয় না হয়ে সময়ের যথার্থ ব্যবহার হয়।
এটাও মোবাইলে লেখা হলো। আপনাদের অভিজ্ঞতা কেমন?
ছবি কৃতজ্ঞতা: awai.com