শেষ বিকেলে ফোন দিয়ে যে বিল্ডিং এর ছাদে হেলিপ্যাড আছে তার গোড়ায় আসতে বলল সাকিব। গাড়িওয়ালা বন্ধুদের ‘না’ বলতে বাঁধে, সাকিব হল আমার গাড়িওয়ালা বন্ধু, তাই মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মতিঝিলের সিটি সেন্টারের সামনে হাজির হলাম আর সাকিবও দোতলার পার্কিং লট থেকে গাড়ি চালিয়ে উপস্থিত হল। তারপর একটা বইয়ে দুই কথা লিখে আর স্বাক্ষর দিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল সে। বইয়ের নাম সত্তাবর্তন। লেখক সাকিব শাহরিয়ার, আমার বন্ধু।
সাকিবের সাথে আমার বন্ধুত্ব এক যুগের। আমরা দীর্ঘদিন একসাথে থেকেছি, পথ চলেছি, ঘুরে বেড়িয়েছি। তাই সাকিবের সাহিত্যিক যে সত্তা তার সাথে আমার পরিচয় আছে। গল্প-উপন্যাসের মত রসালো শাখায় তার বিচরন যেমন, ব্যবসায়িক বিষয়ে কাটখোট্টা ইংরেজি বা চলচ্চিত্রের সমালোচনাতেও তার সমান পদচারণ। বাংলা মুভি ডেটাবেজ (বিএমডিবি)-তে তার বেশ কিছু চলচ্চিত্র সমালোচনা আছে। তার আরও একটি সত্তা আছে। সাকিবের সাথে যারা চলে – মিশে তারা তার এই সত্তা সম্পর্কে জানে। সেটি হল সাকিবের দার্শনিক সত্তা। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস সত্তাবর্তনে সাকিবের এই দুই সত্তার সংমিশ্রন পাওয়া যায়।
তিন জোড়া মানব-মানবীকে ঘিরে এই উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত। একদিকে আছে প্রাণময়ী এবং অনিমেষ। তাদের অস্তিত্ব বাস্তবে নয়। কল্পনায়ও বলা যায় না। বরং এক অপার্থিব জগতে তাদের বসবাস এবং মরুর উপর দিয়ে অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে তাদের সহযাত্রা। তাদের সম্পর্কটা দ্বান্দ্বিক এবং একপাক্ষিক। অনিমেষের প্রতি প্রাণময়ীর সীমাহীন আকর্ষণ থাকলেও অনিমেষ সে তুলনায় নির্লিপ্ত, কখনো কখনো বিরক্ত। এছাড়া আছে ঋতু আর লাবিব। তাদের বসবাস এই বাস্তবেই। বিবাহিত এবং সংসারী এই জুটির সম্পর্কে শারীরী প্রেম প্রকট। সর্বশেষের জুটিতে আছে অরণী এবং রুবাইয়াৎ। তারাও বাস্তবের বাসিন্দা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং গোপনে বিবাহিত। প্রায় প্লেটনিক ভালোবাসায় বাঁধা তাদের সম্পর্কের মাঝে শরীরবৃত্তীয় কিছু না থাকলেও অপ্রয়োজনীয় এবং উৎকট ইঙ্গিত আছে। তাদের সম্পর্কের মধ্যে মধ্যবিত্তের বহুল চর্বিত বেকার যুবক আর সুন্দরী যুবতীর প্রেমকাহিনীর উপস্থিতিও পাওয়া যায় যা তাদেরকে বাস্তবের যে কোন সাধারণ এক প্রেমিক জুটি হিসেবে চিহ্নিত করে।
এই তিন জুটির মধ্যে কি যোগসূত্র রয়েছে তা কাহিনীর বিভিন্ন পরতে উন্মোচন করেছে লেখক সাকিব শাহরিয়ার। যেহেতু উপন্যাসের নাম সত্তাবর্তন বা সত্তার আবর্তন, তাই ধারনা করা যেতে পারে একই সত্তার বিভিন্ন রূপ তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসে। তবে বাস্তবতা পাঠকের চিন্তার সাথে সবক্ষেত্রে ঐক্যমত্য প্রকাশ করে না। সত্বাবর্তন কি সাকিবের নিজের বিভিন্ন সত্তারই চিত্রায়ন কিনা সেই প্রশ্নও উঠতে পারে কারণ তৃতীয় প্রেমিক জুটির রুবাইয়াৎ একজন লেখক এবং দ্বিতীয় প্রেমিক জুটির লাবিব সাহেব একজন প্রতিষ্ঠিত চাকুরীজীবী। প্রথম উপন্যাসে নাকি লেখকের নিজের গল্পই প্রকাশিত হয়, তবে তার স্বীকারোক্তি পাওয়া যায় লেখকের শেষ জীবনে। সত্তাবর্তন কি সাকিবের নাকি অন্য কারও তার জবাব সাকিবের কাছেই আছে, পাঠক পর্যন্ত কখনো পৌছাবে কিনা তার উত্তর ভবিষ্যতের কাছে।
প্রায় সম্পূর্ণ উপন্যাসেই কথোপকথনের মাধ্যমে ঘটনা বিবৃত হয়েছে। সংলাপের মধ্যেই আছে দার্শনিকতা, জীবন সম্পর্কে সাকিবের চিন্তা এবং বক্তব্য। এই সংলাপ কিছু পাঠকের কাছে বাচালতা এবং কলেবর বৃদ্ধির উপায় মনে হলেও বাকী পাঠকের কাছে উপন্যাসকে প্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলবে বলে মনে করি। তবে সত্তাবর্তনের কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই সংলাপ অন্যতম কারণ এর মাধ্যমেই উপন্যাস সকল বয়সের পাঠকের পরিবর্তে নির্দিষ্ট বয়সের পাঠকের মাঝে গন্ডীবদ্ধ হয়ে থাকবে বলে আশংকা করি। এছাড়া উপন্যাস বিবেচনায় সত্তাবর্তনে ব্যাপ্তি এবং গভীরতা কম, ফলে আমার মত পাঠকদের ক্ষুধার নিবারণ ঘটে না।
জয়তী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সত্তাবর্তনের মূল্য ২০০ টাকা। অটোগ্রাফসহ কিনতে হলে বইমেলায় বিকেলে যেতে হবে। নতুন লেখকদের উৎসাহ দেয়ার অন্যতম উপায় হল বই কেনা এবং মতামত জানানো। বই কেনার সুযোগ সাকিব আমাকে দেয় নি, তাই বলে আপনারাও আমার মত সুযোগ নিবেন তা বিশ্বাস করি না। সত্বাবর্তন কিনুন, পড়ুন এবং সাকিবের পিঠ চাপড়ে দিয়ে তার এই সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখতে ভূমিকা রাখুন।
বি: দ্র: এই বইমেলায় আমারও একটি ভ্রমণগল্প প্রকাশিত হয়েছে। সস্তাদরের এই গল্প প্রকাশ করে পুঁজি খোয়ানোর ঝুঁকি নেবার মত কোন প্রকাশক বাঙলাদেশে নেই, তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই প্রকাশ করতে হল, কাগুজে বই হিসেবে নয়, ই-বই হিসেবে। নাম ‘পঞ্চগড় ভ্রমণ ও একটি খুনের রহস্যভেদ’, ডাউনলোড করা যাবে এখান থেকে। ইবুকের মূল্য টাকার অংকে নয়, মন্তব্যের মাধ্যমে পরিশোধ্য। ধন্যবাদ।