অগ্নি: বসন্তের সূচনা

থাইল্যান্ডের স্মার্ট সুদর্শন যুবক ড্রাগনের মা থাই হলেও বাবা বাংলাদেশী কিন্তু পৃথিবীতে তার একমাত্র আপনজন কাবিলা মামা একজন সিলেটি বাংলাদেশী! পরপর তিন বছর কিক বক্সিং-এ চ্যাম্পিয়ন ড্রাগনের মুষ্টিযুদ্ধ দেখা না গেলেও কয়েক দফা ট্র্যাক-রেস দেখা গেল যার সবক’টিতেই সে পরাজিত। সব ধরনের অস্ত্র পরিচালনায় প্রশিক্ষিত চৌকষ জোয়ান ড্রাগন যখন তখন তার ‘মেশিন’ বের করলেও হত্যাকারীকে তাড়া করার সময় পিস্তলের মুখ নয়, গর্জে ওঠে তার নিজের মুখ, উদগীরন করে – ‘স্টপ!’ চিৎকার।

এই ধরনের কিছু মোটাদাগের গলদ নিয়ে নির্মিত হলেও বহু-প্রতিক্ষিত সিনেমা অগ্নি খুব দ্রুতই দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সিনেমাহলগুলোতে বিপুল পরিমান দর্শকের উপস্থিতি এবং প্রথম দু দিনেই প্রায় তিন কোটি টাকার ব্যবসা তার-ই ইঙ্গিত দিচ্ছে, কিন্তু চলচ্চিত্র হিসেবে অগ্নি কতটুকু সফল সে বিবেচনা করা প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, জনপ্রিয় চলচ্চিত্র মানেই সফল চলচ্চিত্র নয়।

কাহিনী

প্রতিশোধের গল্প নিয়ে তৈরী অগ্নি নারীপ্রধান অ্যাকশন চলচ্চিত্র। তানিশা নামের বাইশ তেইশ বছরের একটি মেয়ে থাইল্যান্ডে প্রবাসী কিছু বাংলাদেশী অপরাধীদের খুঁজে বের করে মারতে চায়। কেন মারতে চায় তা অপরাধীরা না জানলেও সিনেমার শুরুতেই দর্শক জেনে যায়। ফলে, ‘কেন’ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেয়ে ‘কিভাবে’ প্রশ্নের উত্তরের জন্য প্রতিক্ষার শুরু হয়। দুটো প্রশ্নের কোনটিই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে একই চলচ্চিত্রে যদি দুটো প্রশ্নেরই সন্নিবেশ ঘটনা যায় তবে সিনেমা দেখে যাওয়া ছাড়াও দর্শকের কিছু কাজ থাকে। প্রোটাগনিস্টের সাথে মিলে ‘কেন’ প্রশ্নের উত্তর বের করতে গিয়ে দর্শক চলচ্চিত্রের সাথে গভীর বাঁধনে জড়াতে পারে।

প্রতিশোধ-প্রক্রিয়ার বাংলাদেশ চ্যাপ্টার শেষ করে তানিশা থাইল্যান্ডে হাজির হলে অপরাধীদের নিরাপত্তা রক্ষার্থে পর্দায় ড্রাগনের উপস্থিতি ঘটে। অবশ্য, তানিশার উদ্দেশ্য অর্জনে ড্রাগন খুব বেশী বাঁধা তৈরী করতে পারে নি, এমনকি তার নিরাপত্তা সেবার গ্রাহক হায়দার-কিবরিয়া গং এর চাহিদা মোতাবেক আততায়ীকে খুঁজে বের করতেও ব্যর্থ হয়ে বহুরূপী তানিশার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করে।

কাহিনীর এই দিকটা বাণিজ্যিক সিনেমার গতবদ্ধ নিয়মকে অনুসরণ করে। শুধু অ্যাকশন চলচ্চিত্র বলে কিছু হতে পারে না, সেখানে রোমান্স থাকতেই হবে এবং ভাইস-ভার্সা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কাহিনীকাররা অ্যাকশন চলচ্চিত্রে এক টেবিল চামচ রোমান্টিকতার মিশেল ঘটাতে গিয়ে এক হাতা ঢেলে দেন – অগ্নিতেও একই ঘটনা ঘটেছে। সৌভাগ্যক্রমে, কাহিনীকার আবদুল্লাহ জহির বাবু এখানে এক হাতা-র বদলে আধ হাতা রোমান্টিকতা মিশিয়েছেন। তবে ড্রাগন চরিত্রের নির্মানে পর্যাপ্ত মনযোগ না দেয়ার গুরুতর অপরাধে তাকে অভিযুক্ত করা যেতে পারে। হলিউডের চলচ্চিত্র কলম্বিয়ানার গল্প নকলের অভিযোগ করা গেলেও সম্পূর্ণ দোষী সাব্যস্ত করা যায় না কাহিনীকারকে।

অগ্নি সিনেমার পোস্টার
অগ্নি সিনেমার পোস্টার

অভিনয়

তানিশা চরিত্রে মাহি-র উপর গুরুদায়িত্ব ছিল অগ্নি-কে একটি অ্যাকশন চলচ্চিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা। তার প্রচেষ্টা খুবই প্রশংসনীয় কিন্তু পারফরম্যান্স সন্তোষজনক নয়। অ্যাকশন চরিত্রের নায়িকা হিসেবে বাংলাদেশের অন্যান্য নায়িকাদের তুলনায় মাহি অনেক বেশী ফিট, কিন্তু অ্যাকশন-লেডি চরিত্রের জন্য অপরিণত। তার চেহারার কমনীয়তার সাথে সংলাপের রুক্ষতার বেজায় পার্থক্য, আহ্লাদীপনায় সে মাত্রাছাড়া! অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে হাত-পায়ের ব্যবহারে আনাড়িপনা চোখে লাগে।

অগ্নি-তে গ্ল্যামারের প্রয়োজন পূরণ করেছে ড্রাগন চরিত্রে ‘মি. স্টপ গাই’ আরেফিন শুভ। পুরো সিনেমায় তার পুরুষোচিত উপস্থিতি, কেবল প্রেমের দৃশ্যে হাস্যকর ন্যাকামি। অগ্নির প্রধান চরিত্র যদি তানিশা না হয়ে ড্রাগন হতো, তবে কয়েকগুন বেশী তৃপ্তি নিয়ে হল থেকে ফেরা যেত। হয়তো ভবিষ্যতে কোন পরিচালক শুভকে এ ধরনের চরিত্রে কাস্ট করে চলচ্চিত্র নির্মান করবেন, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে। অভিনয়ে অন্যদের তুলনায় নজর কেড়েছে তানিশার ছোট্টবেলার চরিত্রে অভিনেত্রী পূজা। যোগ্য পরিচালকের যত্নে গড়ে উঠলে কয়েক বছর পরে তার কাছ থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ভালো কিছু আশা করতে পারে।

গান

বলতে হবে গানের কথা। চমৎকার পাঁচটি গান রয়েছে চলচ্চিত্রে, দৃশ্যায়নে টাইটেল গান বাদে বাকী সবগুলোই উপভোগ্য, ‘ভালোবাসি তোকে যে তাই’ শ্রুতিমধুর এবং চমৎকার। টাইটেল গানের দৃশ্যায়নে নিম্নমানের সম্পাদনা গানটির সৌন্দর্য্যে দারুন ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। পাঁচটি গানের মধ্যে দুটি গান বাহুল্য। তিনটি গানেও একটি ভালো চলচ্চিত্র হতে পারে – এই সত্য উপলব্ধি করার সময় হয়ে গেছে, দেরী করলে বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে।

অগ্নি সিনেমার নির্মানে কৃতিত্ব যদি কাউকে দিতে হয় তবে সে পরিচালক ইফতেখার চৌধুরী। অভিনেতা আলীরাজ দীর্ঘদিন চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন। গোল সানগ্লাস পড়ুয়া ভিলেন চরিত্রে চিত্রায়নে আলীরাজের আগে পরিচালককে বাহবা দিতে হয়। শুরু থেকেই তিনি অ্যাকশন চলচ্চিত্র নির্মানে মনযোগী ছিলেন, সীমিত সাধ্যের মধ্যে বেশ চেষ্টা করেছেন, অগ্নি-তে তার যোগ্যতার একটি পূর্ণ চিত্র পাওয়া গেল।

দড়ির খেলা

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বছর দুয়েক হল দড়ির ব্যবহার শুরু হয়েছে। এর যতটুকু ব্যবহার তার চেয়ে বেশী অপব্যবহার। দড়ির কল্যানে সিনেমার নায়ক-নায়িকা-খলনায়কেরা এখন আকাশে-বাতাসে উড়ে বেড়ান। অগ্নি সিনেমায় দড়ির যথাযোগ্য ব্যবহার পাওয়া গেল। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোকে জীবন্ত করে তোলার স্বার্থে চলচ্চিত্রের কাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে থাইল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে ইফতেখারকে ধন্যবাদ। পাশাপাশি অনুরোধ – গোলাগুলির দৃশ্যে কম্পিউটারে তৈরী আগুনের ফুলকি ভালো লাগে না, ওখানেও প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা করুন। আর অবশ্যই, গল্পের দিকে মনযোগ দিন। দুর্বল গল্পে অ্যাকশন যত ভালোই হোক না কেন অভাব ঠিকই টের পাওয়া যায়।

দৃষ্টি আকর্ষণ

গুরুত্বপূর্ন কিছু বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করাও প্রয়োজন বোধ করি। প্রথমত মাহির কস্টিউম। বাংলাদেশের আলো হাওয়ায় বড় হওয়া মাহির খাটো পোশাকে উপস্থিতি এবং গাড়ীর ভেতরে জাহাঙ্গীরের ‘শিকার ধরা’র ইঙ্গিতপূর্ণ দৃশ্য চলচ্চিত্রে অপ্রয়োজনীয়, নিতান্তই বাণিজ্যিক। অগ্নি চলচ্চিত্রের অ্যাকশন দৃশ্য দেখেই দর্শক তৃপ্তি পেতে পারে, উল্লিখিত দৃশ্যাবলী শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়, নিন্দনীয়ও। ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয় – সু-নির্মাতাদের কাছ থেকে যেন ব্যাধির সংক্রমণ না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু নির্মাতারই।

সব মিলিয়ে বলতে গেলে – অগ্নি বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বসন্তের সূচনা করেছে। বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে আধুনিক অ্যাকশন সিনেমা হিসেবে অগ্নির নাম উচ্চারিত হবে বারবার। গল্প খুব আকর্ষনীয় না হলেও শুধু অ্যাকশন দৃ্শ্যই সিনেমাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে সাফল্যের সাথে। এ ধারায় চলচ্চিত্র নির্মান পুরোদমে শুরু হলেই কেবল ভারতীয় সিনেমা আমদানীর পক্ষে সরকারী প্রচেষ্টা বানচাল করা সম্ভব। অন্যথায়, দীর্ঘদিনের অবহেলায় যে জঞ্জাল তৈরী হয়েছে তার ভারেই হারিয়ে যাবে বাংলাদেশী চলচ্চিত্র।

আধুনিক অ্যাকশন চলচ্চিত্র নির্মানের যে সূচনা করল অগ্নি, তার দীপ্তিমান শিখা ছড়িয়ে পড়ুক, পরিবর্তনের আগুনে পুড়ে যাক ব্যার্থতা আর হতাশার জঞ্জাল!

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

9 Comments on “অগ্নি: বসন্তের সূচনা”

  1. রিভিউ ভালো লাগল।
    থাই মা বাঙালী মামা বিষয়টা ইন্টারেস্টিং। স্যুরিয়েলিক কোনো ব্যাপার হতে পারে!

    ‘কেন’ এবং ‘কিভাবে’ ব্যাখ্যাটা ভালো লাগছে। ‘কেন’-র দড়িতে দর্শকদেরও ঝুলানো যেতো!

    মুভিটি দেখার বাসনা রাখছি।

  2. সিনেমা ভালো না হলেও, রিভিওটা চমতকার হয়েছে। মূল কথা হল এই ধরনের কমন ভুলগুলো বাংলাদেশের কম-বেশি সব মেকাররাই করে। তবে শিল্পের মান যাই হোক, দর্শক আসছে এটাই অনেক।
    মি। স্টপ গাই’ নামটা ভালো লেগেছে।

    আর হ্যা, আপনি সিনেমা বানাচ্ছেন কবে?

    1. সিনেমা ভালো নয় তা কিন্তু বলি নি। অবশ্যই গতানুগতিক বাণিজ্যিক বাংলা চলচ্চিত্রের তুলনায় অনেক ভালো ছবি হয়েছে কিন্তু দুর্বলতাও কম নয়। দর্শক বাড়ছে, বাড়বে, বাড়া উচিত।
      শেষে কি বললেন যেন?

  3. ‘বলা বাহুল্য, জনপ্রিয় চলচ্চিত্র মানেই সফল চলচ্চিত্র নয়’ – ভাল লাগছে

  4. ব্যাপক ভাল রিভিউ।আমার চোখে যে জিনিস গুলা দৃষ্টিকটু ছিল সেগুলা রিভিউতে বেশ ভালভাবেই তুলে ধরেছেন।মুভির ডিউরেশনের ব্য্যাপারটা আমার আসলেই মাথায় রাখা উচিত।শেষদিকে বেশ ধৈয্যর্চুত্যি হয়েছিল।আর গল্পে নজর দেওয়ার সময় চলে আসছে।এভাবে ববি,মাহিরে বেছে কয়দিন দর্শক ধরে রাখা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *