ঈদে যে কটা চলচ্চিত্র মুক্তি পেল তার মধ্যে ফুল অ্যান্ড ফাইনাল দেখার প্রতি আগ্রহ ছিল তুলনামূলকভাবে বেশী। আগ্রহের প্রধান কারণ হল মালেক আফসারী পরিচালিত এই সিনেমার স্টোরিলাইন কোরিয়ান সিনেমা ‘ডেইজি’র সাথে ভালোভাবে মিলে যায়। ঢালিউডের বাণিজ্যিক সিনেমা মানেই ভারতীয় সিনেমার নকল হবে এটা মোটামুটি নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া যায়। এক-দেড় দশক আগে হিন্দী চলচ্চিত্র থেকে টুকলিফাই করা হত। এখন সাবটাইটেলের কল্যাণে তামিল-তেলেগু-মারাঠি সিনেমা থেকে নকল করা হয়। জাকির হোসেন রাজুর মত স্বনামধন্য পরিচালকও তামিল ছবি থেকে কাহিনী নিয়ে ‘বান্দরবানের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে’ সিনেমা নির্মান করে নিন্দিত হয়েছেন। মালেক আফসারী যদিও বারবার দাবী করেছেন – মৌলিক সিনেমা হবে ফুল অ্যান্ড ফাইনাল, স্টোরিলাইন কোরিয়ান সিনেমার সাথে মিলে যাওয়ায় একই সাথে খুশী এবং আগ্রহ বোধ করলাম। খুশী, কারণ ভারতীয় সিনেমা থেকে কোরিয়ান সিনেমা পর্যন্ত নজর উঁচু হয়েছে নকল-ছবি নির্মাতাদের। আগ্রহ, কারণ ডেইজির মত চমৎকার চলচ্চিত্র নির্মানে কতটুকু যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন সেটা যাচাই করা।
আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সময়ের হিসেব মিলাতে না পারার কারণে ঈদের সিজনে ছবিটা দেখার সুযোগ হয় নি। জানুয়ারীর মাঝামাঝি পূর্ণিমা সিনেমাহলে চলছে দেখে আবারও দেখার পরিকল্পনা করলাম, সেটাও সময় এবং ব্যস্ততার কারণে বাদ দিতে হল। হঠাৎ করেই পাইরেটেড কপি পাওয়া গেল – বাজে প্রিন্ট। কিন্তু ক্ষুধা মেটানোর জন্য বাজে প্রিন্টেই ডুবলাম। শেষ করার পর বুঝলাম – এই ফিল্ম ভালো পরিবেশে ভালো সাউন্ড-ছবিসহ দেখতে না পারার জন্য মাঝারি মানের আফসোস বোধ হচ্ছে।
ডেইজি সিনেমার সাথে কাহিনীর বেশ ভালো মিল থেকে ধরে নিচ্ছি ডেইজি থেকেই নকল করা হয়েছে। আবার, রাস্তায় বসে ছবি আঁকার যে দৃশ্যাবলী এবং সাথে আরও কিছু দৃশ্য, ঘটনাপ্রবাহ দেখে সন্দেহ হয় – কোরিয়ান নয়, তামিল-তেলেগু-মারাঠি কোন চলচ্চিত্র থেকে নকল করা হল কিনা। কোরিয়ান সিনেমায় নায়িকা হল Hye-young – তাকে কেন্দ্র করে দুই নায়ক, একজন Park Yi যে একজন প্রফেশনাল হিটম্যান, অন্যজন ডিটেকটিভ Jeong Woo। ফুল অ্যান্ড ফাইনালে নায়িকা ববি, তাকে ঘিরে পুলিশ অফিসার কাম হিটম্যান শাকিব খান এবং আরেক পুলিশ অফিসার তানভীর খান। শাকিব খান তার বস অমিত হাসানের নির্দেশে দেশের ড্রাগ বিজনেসকে উৎখাত করার গোপন মিশনে ব্যস্ত, একে একে লিডারদের খুন করছে। অন্যদিকে আরেক পুলিশ তানভীর খানও ড্রাগ ব্যবসায়ীদের ধরার মিশনে টিম নিয়ে ব্যস্ত। দুজনের কেন্দ্রবিন্দু হয় নায়িকা ববি – শাকিব খান ববিকে ভালোবেসে প্রতিদিন ফুল পাঠায়, তার অলক্ষ্যে নজর রাখে আর তানভীর খান ববির ছবি আঁকার মডেল হয়ে ড্রাগডিলারদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালায়। অল্প কথায় এই হল ছবির বেস, তারপর নানা ঘটনার মাধ্যমে বিভিন্ন সত্য উদঘাটন হয়, প্রেম একটা পরিণতির দিকে আগায়।
এই সিনেমা আমাকে ভালো তৃপ্তি দিয়েছে – তৃপ্তিদায়ক সেই জায়গাগুলো নিয়ে বলি। শুরুতেই ছবির টাইটেল। ববি আকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে ছবি আঁকতে যায়, দূর থেকে শাকিব খান দূরবীনে চোখ বুলিয়ে যায়। তারপর গাছের গুড়ি দিয়ে তৈরী সাঁকো পার হতে গিয়ে ববির পতন, ছবি আঁকার সরঞ্জাম ভেসে গেলে শাকিব কর্তৃক উদ্ধার এবং সাঁকোর জায়গায় অত্যন্ত চমৎকার কাঠের তৈরী একটি সেতু তৈরী করে দেয়া। পরপরই যে গানটা ওটাও উপভোগ্য।
গানের শেষে দুর্দান্ত একটা অ্যাকশন সিকোয়েন্স। শুরুর সংলাপটা বলি –
“ম্যাগনাম থার্টি-টু রিভলবার, আমার বন্ধু! গুলি করার পর বুলেটের খোসাগুলো ভিতরেই থাকে, বাইরে ছড়িয়ে পড়ে না। তাই হত্যাকারী শনাক্ত হওয়ার ভয় থাকে কম। যে কোন আততায়ীর জন্য সবচে গুরুত্বপূর্ণ হল তার শিকারকে ভালোভাবে জানা ও বোঝা। তারপর শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে – মাকড়সার মত!”
সংলাপটা ডেইজি থেকে কপি করা, তবে এত বিস্তারিত না – The Magnum 357 revolver doesn’t leave shells. Hollow point bullets also leave no shells. For an assassin leaving traces means death.
এই সিকোয়েন্স অন্ধকার রাতে। হাটু পানি ভর্তি টানেলে। অ্যাকশন সিকোয়েন্সের জন্য এরকম চমৎকার জায়গার আইডিয়া কোথা থেকে পেল পরিচালম জানি না, যতটুকু মনে পড়ে মূল ডেইজি সিনেমায় এই ধরনের কোন সিকোয়েন্স নাই। সিকোয়েন্সে দড়ির ব্যবহার আছে, এবং কিছু কিছু জায়গায় সেটা মাত্রা ছাড়ালেও বাকীটা গ্রহনযোগ্য। একেকটা শরীর পানিতে পড়লে সুন্দর ইফেক্ট সাউন্ড। অ্যাকশন শব্দের সাথে পানির শব্দ দারুন মিক্স করে।
এফডিসিতে হোটেল সারিনা এবং তার আশেপাশের এলাকার একটা সেট বানানো হয়েছে। হোটেল সারিনায় বসে ছবি আঁকিয়ে ববিকে দেখে শাকিব, আর ববি পয়সার বিনিময়ে ছবি একে দেয়। এই সেটেই সিনেমার অনেকগুলো সিকোয়েন্স। সেটটা দেখে কোলকাতা বা তামিল ছবির সেট হিসেবে ভ্রম হয়। কিন্তু বাংলাদেশী সিনেমার তুলনায় এই সেট অনেক ভালো হয়েছে। বাস্তব করে তোলার জন্য প্রচুর পাসিং শট আছে, রং বেরঙের ছাতা আছে, কোকাকোলার বিজ্ঞাপন আছে, সবুজ রঙের সিএনজি আছে, দোকানপাট আছে – পারফেক্ট না হলেও কাঁচা নয়। আর আছে কবুতর। এরা উড়ে বেড়ায় আর ‘ফর ফর’ টাইপের শব্দ হয়, মাঝে মাঝে বাকবাকুম শব্দ – দুর্দান্ত সাউন্ড মিক্সিং।
কাহিনী পুরোটা ডেইজি-কে ফলে করে নি। প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করা হয়েছে। এবং, এই সকল পরিবর্তনের যথাযোগ্য ব্যাখ্যাও দেয়ার চেষ্টা করেছে নির্মাতা গোষ্ঠী। শাকিব খানের চরিত্র তৈরী করার সময় শুটে’ম আপ সিনেমার অভিনেতা ক্লাইভ ওয়েনকে এক চামচ মিশিয়ে দেয়া হয়েছে, ফলে কয়েকটা দৃশ্যে গাজরের ব্যবহার দেখা যায়। পুরো সিনেমাতেই ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর বেশ ভালো। বাংলাদেশের অ্যাকশন সিনেমায় এরকমের স্কোর আমি আগে পাই নি।
দেহস্বর্বস্ব নকল সুরের অশ্লীল গান হল এই ছবির অন্যতম বাজে দিক। সেই শুরু থেকেই নায়িকা ববির অভিনয় প্রতিভার তুলনায় শরীর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে নির্মাতাদের কাছে, এই ছবির কাস্টিং এও তাই। তবে ধন্যবাদ এজন্য যে গান ছাড়া বাকী দৃশ্যগুলোতে ববিকে বেশ ভদ্রোচিত ভাবে উপস্থাপন করার জন্য।
নকল ছবি অবশ্যই নিন্দনীয়, বর্জনযোগ্য – তবে যদি এই ছবি কোন ভারতীয় ছবির নকল না হয়ে থাকে – তাহলে নির্মাতা মালেক আফসারী, চিত্রনাট্যকার আবদুল্লাহ জহির বাবু-কে ছোট্ট করে পিঠ চাপড়ে দেয়া যেতে পারে। এর উদ্দেশ্য অবশ্যই নকল ছবি বানানোতে সমর্থন করা নয়. আরও নকল ছবি বানানোর জন্য উৎসাহ দেয়া নয় বরং পিঠে হাত বুলিয়ে বলে দেয়া – ভাইয়েরা, কি চমৎকার করে স্টোরি লিখেছেন, এবং, তাকে সিনেমাও বানিয়েছেন – এইবার চেষ্টা করে একটা মৌলিক গল্প লিখে ফেলুন না – সেই ছবিটা যে সেরা ছবি হবে সেটা তো আমরা ঠিকই জানি!
বেস্ট অব লাক টু বাংলাদেশী সিনেমা!