একটি খুব ভালো সিনেমা দেখে উঠার পর সিনেমাটা সম্পর্কে জানার আগ্রহে আপনি যদি উইকিপিডিয়ায় ঢুঁ মারেন এবং জানতে পারেন, সিনেমাটির নির্মানের তিনভাগের দুভাগ সময়ই পরিচালক জেলে বন্দী ছিলেন, শ্যুটিং এর পুরো দৃশ্যটা তাকে দেখতে হয়েছে অন্যের চোখে, তখন আপনার কেমন লাগবে? বিস্মিত আমি হতভম্ব হলাম যখন জানলাম সিনেমাটা এমন এক দেশে নির্মিত যে দেশের সিনেমা নিয়ে সাধারণত কেউ কথা বলে না। সিনেমার নাম ইয়োল (Yol), ইংরেজিতে বলে ‘দ্য রোড’। দেশের নাম তুরস্ক, পরিচালক ইলমাজ গুনে (Yılmaz Güney)।
তুরস্কের এক জেলখানার কুর্দি কিছু বন্দীকে এক সপ্তাহের জন্য ছুটি দেয়া হল। এক সপ্তাহের মধ্যে পরিবারের সাথে দেখা করে তারপর আবার ফিরতে হবে জেলখানাতেই। অনেক বন্দীর মাঝে পাঁচজন বন্দীর এক সপ্তাহের ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়েছে সিনেমায়। তাদের মধ্যে সাইদ আলীর বউ বেশ্যা হয়ে গিয়েছিল এবং ধরা পড়েছে, মোহাম্মদ সালেহ’র অপরাধের সঙ্গী আপন শ্যালক মারা গিয়েছিল সে গ্রেফতার হওয়ার সময় এবং স্ত্রী-পরিবার সন্দেহ করে সেই দায়ী, ওমর পরিকল্পনা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পালাবে, ফিরবে না আর জেলে। এই হলো ইয়োল ছবির পটভূমি।
ইয়োল নির্মাতার কথা
কুর্দিদের সাথে সংঘর্ষ একটি চলমান ইস্যু। উইকিপিডিয়া বলে, তুরস্ক থেকে আলাদা হয়ে নিজস্ব জাতির জন্য স্বায়ত্তশাসন ও একটি আলাদা রাজ্যের জন্য লড়াই করছে কুর্দিরা – সেই ১৯৭৮ সাল থেকে। সিনেমা পরিচালক, উপন্যাসিক, অভিনেতা গুনে একজন কুর্দি। তুরস্কের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে মানবিক আবেদন নিয়ে তিনি এই সিনেমাটা নির্মান করেছিলেন।
মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি সিনেমা নির্মান প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হন, যদিও অর্থনীতি ও আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। বলা হচ্ছে, তুরস্কে সে সময় স্টুডিও ভিত্তিক সিনেমা নির্মিত হত যার কাহিনীতে মেলোড্রামা, যুদ্ধ এবং নাট্যাংশ স্থান পেত বেশী। সিনেমা শিল্পের সে অবস্থার সাথে বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পের বর্তমান অবস্থার বোধহয় খুব বেশী পার্থক্য নেই। এফডিসি-কেন্দ্রিক সিনেমা সত্যিকারভাবে দেশের ঘটনাপ্রবাহ ও সময়কে কতটুকু তুলে ধরতে পারে সে প্রশ্ন বারবারই করা হচ্ছে।
তুরস্কেরও সেরকম পরিস্থিতি গুটিকয়েক চলচ্চিত্রনির্মাতা এগিয়ে আসেন যারা সিনেমার মাধ্যমে দেশের সমস্যাগুলোকে অপেক্ষাকৃত অনেক আকর্ষণীয় করে তুলে ধরেন। এদের একজন ছিলেন আতিফ ইলমাজ, গুনে তার সহকারী ও অভিনেতা হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। ১৯৬৫ সালে গুনে তার সিনেমা নির্মান শুরু করেন। ১৯৭৪ সালের মধ্যে তিনি প্রায় সতেরোটি সিনেমা নির্মান করেন, তিনবার জেলে ঢোকেন, দুবার বের হয়ে আসেন। ১৯৭৪ এই একজন বিচারককে হত্যার অভিযোগে তাকে ১৯ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। গুনে বুঝতে পেরেছিলেন, সামরিক জান্তা তাকে বারবার আটকে দেয়ার চেষ্টা করবে। গুনের ভাষায় -“There are only two possibilities: to fight or to give up, I chose to fight”। গুনে ‘ইয়োল’ নির্মান শুরু করলেন।
১৯৮১ সালে গুনে জেল ও দেশ থেকে পালালেন। তুরস্ক থেকে পালালো তার নির্দেশনায় চিত্রায়িত সিনেমা ‘ইয়োল’ এর নেগেটিভ ফুটেজ, দুয়ের মিল হল সুইজারল্যান্ডে। সেখানে এবং পরবর্তীতে প্যারিসে সিনেমার সম্পাদনা শেষ করেন ইলমাজ গুনে। এই সিনেমা কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পাম ডি’অ পুরস্কার জিতে নিল। সারা বিশ্বের সামনে কুর্দি ফিল্ম হিসেবে তুরস্কের সামরিক জান্তার প্রভাবান্বিত কুর্দিদের অবস্থা তুলে ধরা হল। ফ্রান্স সরকার গুনে-কে সাময়িক নিরাপত্তা প্রদান করেছিল সে সময়, বডিগার্ড সহায়তা দেয়া হয়েছিল অপহরণ বা গুপ্তহত্যা থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে। গুনে যখন মঞ্চে উঠলেন, অশ্রুভেজা চোখে দর্শকরা চেঁচালো – গুনে, গুনে, গুনে!
পাঁচজন ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মাধ্যমে সে সময়কে তুলে ধরেছেন গুনে। দেখিয়েছেন, এমন একটা সময় যেখানে জেল থেকে মুক্তি সত্যিকারের মুক্তি নয়। সংস্কার, জান্তা, দারিদ্র্য ইত্যাদির শৃঙ্খল আরও আটোসাঁটো হয়ে আটকে পড়ে গলায়। চারদেয়ালের জেল সে তুলনায় অনেক বেশী নিরাপদ, আর, মৃত্যুতে মুক্তি।
ছবির অভিনেতারা অভিনয় করেছেন দারুন। ইরানী সিনেমায় অভ্যস্ত দর্শকরা তাদের অভিনয়ে সন্তুষ্ট হবেন। কুর্দিস্তানের প্রকৃতি এবং মানুষের জীবনযাত্রা অদ্ভুত প্রক্রিয়া উঠে এসেছে সিনেমায়। সব কিছুকে ছাপিয়ে ফুটে উঠেছে ব্যক্তি জীবনের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গল্পগুলো। সিক্ত হোন ‘ইয়োল’এ।
তথ্যসূত্র:
1. http://en.wikipedia.org/wiki/Kurdish%E2%80%93Turkish_conflict
2. http://themovingsilent.wordpress.com/2010/12/15/kurdish-cinema-yol-yilmaz-guney-1982/
3. http://hcl.harvard.edu/hfa/films/2011janmar/guney.html
4. http://tiff.net/filmsandschedules/tiffbelllightbox/2012/5500001140
5. http://en.wikipedia.org/wiki/Y%C4%B1lmaz_G%C3%BCney
6. http://en.wikipedia.org/wiki/Yol
ছবিসূত্র:
http://themovingsilent.wordpress.com/2010/12/15/kurdish-cinema-yol-yilmaz-guney-1982/
Valo monehochche. Dekha lagbe 😛
হুম।
তুরস্কের হাতে গোনা কয়েকটা মুভি দেখছিলাম……
কুর্দিদের নির্মিত কোন মুভি দেখছি কি না মনে করতে পারতেছিনা।
সিনেমার সাথে জড়িত থাকার কারনে অনেক ইরানি পরিচালকের জেল জুলুম সইতে হইছে…
কিন্তু এইখানের ঘটনা ভিন্ন মনে হইছে…স্নিগ রহমান নামটা বলার পরে গুগলিং করে দেখলাম…
রিভিউ ভাল্লাগছে…
তবে এই টাইপের ঘটনা নিয়া মুভি আমার পছন্দ হয়না কেন জানি…
আমাদের ৬০/৭০ তেই থাকতে মন চায় এরকম মুভি দেখার চেয়ে…
আরেকজনের স্বাধীনতা কামনা করার থেকে নিজের স্বাধীনতা নিয়া কিছু জানাই ভাল…এই ধারনা আমার মধ্যে কেন যেন কাজ করে…
তাই আর্মেনিয় আর কুর্দিদের অনেক কিছু থেকেই দূরে থাকি…একান্তই নিজস্ব মতামত দিলাম…মাইন্ডে লইয়েননা যেন!
শুকরান বস।
৬০/৭০ এ থাকতে মন চায় কেন সেইটা পুরা ক্লিয়ার না। তবে আমাদের ৬০/৭০ এও কিন্তু মেলোড্রামা সিনেমার পাশাপাশি এই ধরনের অলটারনেটিভ সিনেমা তৈরী হইছে। নিশ্চিত থাকেন, গুনে আমাদের কমার্শিয়াল সিনেমা ডিরেক্টরদের মত কেউ না, সে অফ ট্র্যাকের লোক যাকে বাংলাদেশে ‘আর্ট ফিল্ম ডিরেক্টর’ বলে। ঘুড্ডি, সূর্যদীঘল বাড়ি আর ইয়োল – মোটামুটি এক ধারার সিনেমা।
আর্মেনীয় বা কুর্দি নিয়া আমার আলাদা কোন অ্যালার্জী বা সফট কর্ণার নাই। তবে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনরত জাতিগুলার কাজকর্ম আমার কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মত মনে হয়। আমি নিশ্চিত যে ওইসব জায়গায়ও আমাদের রাজাকারের মত কিছু লোক আছে। এদের ও আন্দোলনকারীদের কিভাবে চিত্রায়িত করছে সেটা বোঝার চেষ্টা করি।
আর এই সিনেমাটা নিয়ে লেখার পেছনের গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর নির্মান। একটা পরিচালক জেলে বসে থেকে একটা সেরা সিনেমা বানিয়ে ফেলছেন – তার সহকারীর উপর নির্ভর করে – এটা আশাজাগানিয়া তথ্য। এই তথ্য আমাকে উজ্জীবিত করে, আর কাউকে করবে না সেটা কেমনে বলি?
মাইন্ড করার কিছু নাই, টেনশনবিহীনভাবে মন্তব্য কৈরেন। 🙂
পরীক্ষার পর দেখব
৬০/৭০ এ থাকার কারন হইল তখন আনাদের এখানেও স্বাধিনতার আকাংখা…এবং সেটা নিয়ে আমাদের বিভিন্ন প্রতিবাদ মুভির মাধ্যমে প্রকাশিত হত…প্রবর্তিতে যেটা নাই হয়ে গেছে…
অথবা একপক্ষিয় হয়ে গেছে বলতে পারেন…
আগেও একপক্ষের বিপক্ষেই ছিল…কিন্তু এরপরে সবার পক্ষ থাকার আশা করেছিলাম…কিন্তু সেটা হয়নাই…
৬০/০৭০/৮০ তে আমাদের একটা শিক্ষিত শ্রেনীর দর্শক ছিল…যারা সবধরনের মুভির ই সমঝদার…
রাজ্জাকের সাদাকালো মুভি দেখলেও বর্তমান জমানার পাবলিকরা সেসবরে অফট্র্যাকের ই বলবে…
মুভি হতে হবে গল্প নির্ভর…থাকতে হবে সেখানে ম্যাসেজ…উচ্চমার্গিয় ভাবধারার ম্যাসেজ সবার কাছে পৌছাবেনা…
সহজ ভাবে সেসব ম্যাসেজ সবার কাছে পৌছাইতে পারলেই না আপনে সফল…না পারলে?
এটা এই জমানার অনেকেই বুঝতে চায়না বস!
রাজাকারি কর্মকান্ড তো সবখানেই আছে…না থাকলেই বরং অবাক হবার কথা ছিল…
তবে ইরাক কুর্দিস্তান সিরিয়া আর্মেনিয়া নিয়া একটু ঘাটাঘাটির ফলে মাথা ঘোলাইয়া গেছিল…তারপর থেকে তাদের স্বাধিকার আন্দোলন নিয়া কোন কিছুতে দূরে থাকি…এইটা আমার সাবজেক্ট না…
আমার দেশের সাথে মিলাইতে যাইনা…কারন আমার দেশের খবর টা আমি জানি…সেখানে কোন জাতীয়তার পক্ষ নিমু সেইটা ঠিক করতে পারিনা কখনো…
তাই সেসব থেকে দূরে থাকা…
এই মুভি নিয়ে অনেক ক্যাচাল লাগছিল দেখা যায়…
পরিচালকের মৃত্যুর পরে এইটা মালিকানা লইয়াও ঝামেলা ভালো ই বাধাইছে!
দারুণ লিখছেন। দেখতে হবে।
জেল-জুলুম-অত্যাচার তাকে দমিয়ে রাখতে পারে নাই। যা বলতে চেয়েছেন তিনি তা জীবন বাজি রেখে বলেছেন। ভাল লাগল পরিচালকের জীবন সর্ম্পকে অল্পবিস্তর জেনে। স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য হলিউড মনে হয় খেলা ময়দান।
ভাল থাকবের দারা ভাই।