পাগলা মসজিদ ও কোটি টাকার দানের তাৎপর্য

কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদ এখন প্রতি তিন মাস অন্তর দানকৃত অর্থের রেকর্ড সৃষ্টি করে টিভি-পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। এই পাগলা মসজিদে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি অর্থ দান করা হয়। দানকৃত সম্পদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা ও পয়সা, বিভিন্ন দেশীয় মুদ্রা এবং স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলংকার। সিন্দুক থেকে দানকৃত সম্পদ বস্তায় সংগ্রহ করে শত শত মানুষের সহযোগিতায় স্থানীয় প্রশাসন, সাংবাদিক, ক্যামেরার উপস্থিতিতে দানের অর্থ গণনা করা হয় যার পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা।

পাগলা মসজিদের ইতিহাস

পাগলা মসজিদ কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত। প্রায় সাড়ে তিন একর জমির উপরে প্রতিষ্ঠিত তিনতলা বিশিষ্ট পাগলা মসজিদ কমপ্লেক্সের বয়স আড়াইশ বছরের বেশি বলে দাবী করা হয়। তবে প্রাচীন সেই মসজিদের কোন চিহ্নই বর্তমানে সেখানে নেই। মসজিদ কমপ্লেক্সের মূল ভবনে তিনটি গম্বুজ এবং পাঁচ তলা উচ্চতার একটি মিনার রয়েছে যেগুলো এই শতাব্দীতেই নির্মিত হয়েছে।

পাগলা মসজিদের নির্মাণ ও নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন ধরণের গল্প প্রচলিত আছে। এইসব গল্পের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই এবং কোন ইতিহাস গবেষক গ্রহণযোগ্য কোন সূত্রের উল্লেখ করেছেন বলেও জানতে পারিনি। এইসব গল্পকে মজবুত করার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক চরিত্র ঈসা খানের নাম জড়িয়েও একটি গল্প প্রচলিত আছে। হয়বতনগর জমিদারবাড়ির ঈসা খানের বংশধর জিল কদর খান ওরফে জিল কদর পাগলা সাহেব নামের এক আধ্যাত্মিক ব্যক্তি এখানে নামাজ পড়াতেন এবং তার নামানুসারে এই মসজিদের নামকরণ করা হয় – এটি একটি গল্প।

পাগলা মসজিদ কিশোরগঞ্জ। দানবাক্সের টাকা গণনার ছবি। (সূত্র: ঢাকা পোস্ট)

অন্যান্য গল্পের মধ্যে আছে হয়বতনগরের জমিদারবাড়ির এক নিঃসন্তান বেগম, যিনি পাগলা বিবি নামে পরিচিত ছিলেন, স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে যে মসজিদ নির্মাণ করেন সেটিই পাগলা মসজিদ। পাগলা মসজিদকে বিশেষায়িত করার লক্ষ্যে একটি অবাস্তব গল্পও প্রচলিত আছে। জনৈক পাগলা সাহেব খরস্রোতা নরসুন্দা নদীতে মাদুর পেতে ভেসে এসেছিলেন। তীরে নামার পর তার আশে পাশে ভক্তকূলের সমাবেশ হলে দেওয়ান পরিবারের পক্ষ থেকে টিলার মাঝখানে একটি মসজিদ তৈরি করে দেয়া হয়। সেটিই আজকের পাগলা মসজিদ।

পড়ুন: মসজিদে মহিলাদের নামাজের ব্যবস্থা

পাগলা মসজিদের নির্মাণ কাল এবং প্রচলিত গল্পের ভিত্তিতেই সম্ভবত এই মসজিদের বয়স আড়াইশ বছর বলে ধরে নেয়া হয়। যেহেতু মসজিদটি বর্তমানে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ হয়ে উঠেছে, সেহেতু এই মসজিদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। প্রত্নতাত্ত্বিক কোন নিদর্শন না থাকায় এই অঞ্চলের প্রশাসনিক নথিপত্র ঘেঁটে কিছু উদ্ধার করা যায় কিনা সেই চেষ্টা করা উচিত। বিশেষ করে – ব্রিটিশ শাসকদের নথিতে এই মসজিদের প্রতিষ্ঠা বা উত্থান সম্পর্কে কিছু পাওয়া গেলে ইতিহাস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যেতো। জমিদারবাড়ির কোন নথিপত্র-জীবনী ইত্যাদি সংরক্ষিত থাকলে সেখানেও খোঁজ করা উচিত। সত্যিকারের ইতিহাসপ্রেমী কোন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তার অনার্স-মাস্টার্সের থিসিস হিসেবে পাগলা মসজিদকে বাছাই করলে সঠিক ইতিহাস তুলে আনার মাধ্যমে দেশ ও দশের উপকার করা যাবে।

কেরামতি

পাগলা মসজিদের জনপ্রিয়তার পেছনে প্রচলিত একমাত্র কেরামতি হলো এর বড় অংকের দানকৃত অর্থ। ভক্তদের দানের পরিমাণ সম্মিলিতভাবে কোটি টাকা ছুঁলে সংবাদের শিরোনাম হয় এবং এর ক্ষমতা সম্পর্কে সকলে জানতে পারে। এরপর দানের পরিমাণ বাড়ে এবং এই দানকৃত অর্থই এর মূল কেরামতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাগলা মসজিদে দান করলে নিশ্চয়ই উপকার পাওয়া যায়, নাহয় অন্যরা কেন নগদ টাকা-গয়নাগাটি দানবাক্সে ফেলে – এই ধারণার উপর নির্ভর করে আরও মানুষ দান করতে উৎসাহী হয় – বিধর্মীরাও আগ্রহী হয়ে যোগ দেয়। আগেরবারে দানবাক্সে ফেলা অর্থের কারণে বিপদ কেটে গেছে কিংবা দানের অর্থ কম হয়ে গেছে বলে বালা-মসিবত দূর হয় নাই – এই ধারণা থেকেও বহু মানুষ বারংবার দান করে যাচ্ছে নিশ্চিত। যেহেতু পাগলা মসজিদ শুধু না, যে কোন মসজিদেই অর্থকড়ি দান করার ফলাফল অপরিমেয়, সেহেতু পাগলা মসজিদে দান করার কারণে যদি কারও বিশ্বাস মজবুত হয়, অথবা দুর্বল, তাহলে তাকে দোষ দেয়া যায় না।

পাগলা মসজিদের কেরামতি দিনকে দিন বৃদ্ধি পাওয়ার প্রধান কারণ কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়া। এই অঞ্চলে মাজারে এবং মসজিদে দানের ইতিহাস শত শত বছরের পুরাতন। মানত পূরণের জন্য এবং বার্ষিক ওরশ আয়োজনের জন্য ভক্তদের কাছ থেকে নিয়মিত দান-খয়রাত গ্রহণ করে এমন মাজার-মসজিদের সংখ্যা হয়তো লাখের ঘরে পৌঁছুবে। কিন্তু কে কবে জানতে পেরেছে – হযরত শাহজালাল (রহ) এর মাজার কিংবা চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার শরীফ অথবা সাবেক সরকারপ্রধান এরশাদের প্রিয় আটরশির পীরের বার্ষিক দানের পরিমাণ কত? পাগলা মসজিদের আগে কোন মাজার বা মসজিদের দানের অর্থ গণনার সময় স্থানীয় প্রশাসন সহযোগিতা করেছে?

এ প্রসঙ্গে একটি শোনা গল্প বয়ান করা যাক। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ নাকি একবার ঘোষনা দিয়েছিলেন – মাজারে ভক্তদের দানের টাকার হিসাব নিয়মিতভাবে সরকারকে জানাতে হবে। মাজার কর্তৃপক্ষই সেই অর্থ ব্যয় করতে পারবে, কেবল আয়-ব্যয়ের হিসাবটুকু সরকারকে দিতে হবে। শোনা যায় এই সিদ্ধান্ত মাজার পরিচালনাকারীদের ব্যাপক রাগান্বিত করে। সে সময় এরশাদ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হচ্ছিল। এরশাদ সরকারের এমন ঘোষণায় তারাও স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

এই গল্প বয়ানের উদ্দেশ্য হলো – পাগলা মসজিদে নির্দিষ্ট সময় পর পর কত টাকা জমা হলো সেই তথ্য মিডিয়ার কল্যাণে আমরা নিয়মিতভাবে জানতে পারলেও সারা দেশের বাকী শত শত মাজারের আয় ব্যয়ের কোন তথ্য আমরা জানি না। তবে বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন মাজারের লক্ষ-কোটি টাকা খাদেমের পকেটে যাওয়ার খবর আমরা পড়েছি। ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই। পাগলা মসজিদের দানবাক্স মসজিদ ছাড়া আর কোথাও নেই বলেই জানি। কিন্তু পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ ইয়ারউদ্দিন খলিফার দরবার শরীফের দানবাক্স বোধহয় দেশের সতেরো কোটি জনগণই দেখতে পেয়েছেন। সংবাদসূত্রে জানা গেলো – সারাদেশে ত্রিশ হাজারের বেশি দানবাক্সের শুধুমাত্র ইজারা থেকে বছরে প্রায় তিন কোটি টাকা আয় করে দরবার শরীফ কর্তৃপক্ষ। বাৎসরিক আয় তবে কত হতে পারে ধারণা করে নিন।

পাগলা মসজিদে কত টাকা

পাগলা মসজিদের দানবাক্স থেকে কত টাকা পাওয়া যায় সে তথ্যটা একবার দেখা যাক। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী – ২০১৭ সালের জানুয়ারী থেকে শুরু করে ২০২৩ এর আগস্ট পর্যন্ত সর্বমোট ৪৮ কোটি টাকার বেশি দানকৃত নগদ অর্থ পাওয়া গিয়েছে। এর বাইরে আছে বিভিন্ন দেশীয় মুদ্রা, স্বর্ণ ও রৌপ্যনির্মিত অলংকার যেগুলো বিভিন্ন সময় ভাঙ্গিয়ে এবং নিলামে বিক্রি করা হয়।

জানুয়ারী/২০১৭ হতে আগস্ট/২০২৩ পর্যন্ত পাগলা মসজিদের দানবাক্সে কত টাকা পাওয়া গিয়েছে তার চিত্র।

কিভাবে ব্যয় হয়

এই যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাওয়া যাচ্ছে মানুষের কাছ থেকে তার ব্যয় হচ্ছে কিসের কল্যাণে? সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের বরাতে জানা যাচ্ছে – মসজিদের আয়ের একটা অংশ আশেপাশের শ-খানেক মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন ও সেবামূলক খাতে ব্যয় করা হয়। এ ছাড়া ২০০২ সালে মসজিদের পাশে একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ক্যান্সার, কিডনি রোগে আক্রান্ত দরিদ্র ব্যক্তিদেরও এই তহবিল থেকে সাহায্য দেওয়া হয়। গতবছর করোনা চলাকালীন এই তহবিল থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক, যারা করোনা রোগীদের সেবায় কাজ করেছেন, তাদের অনুদান দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পাগলা মসজিদে ষাট হাজার মুসল্লীর ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি দৃষ্টিনন্দন কমপ্লেক্স তৈরি করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যার বাজেট ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা।

যে প্রতিষ্ঠানে মাসে কোটি টাকার বেশি দানের অর্থ জমা হয় তাদের দায়িত্ব কি কেবল অন্যান্য মসজিদ মাদ্রাসা এতিমখানায় সহায়তা করা আর অবকাঠামো নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত? যেখানে দৈনিক ষাট হাজার মুসল্লী উপস্থিত হয় না, সেখানে ষাট হাজার মুসল্লীর ধারণক্ষমতাসম্পন্ন মসজিদ নির্মাণ প্রকৃতপক্ষেই প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে নাকি দানের অর্থে দালান নির্মাণের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা – তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে৷

কিশোরগঞ্জের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে পাগলা মসজিদের কোন কার্যক্রম রয়েছে কিনা তা জানার ওয়েবসাইট বা অন্য কোন সহজ উপায় নেই। অথচ কিশোরগঞ্জেই সুদে নেয়া মাত্র পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে জেল হাজতে গিয়েছে চায়না বেগম, পাঁচ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে সুদ সহ বাইশ লক্ষ টাকা পরিশোধ করেও ঘরছাড়া হয়েছে মোখলেসার রহমান। অন্যদিকে, সুইস ব্যাংক থেকে অর্থ আসলে বিনা সুদে ঋণ প্রদানের লোভ দেখিয়ে প্রতারণা করেছে একটি এনজিও। কিশোরগঞ্জের মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নয়নে কাজ করছে বিখ্যাত এই মসজিদ, অসহায় দরিদ্রদের আর্থিক-সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজের দায়বদ্ধতা এড়ানোর সুযোগ কি আছে?

পাগলা মসজিদ বাংলাদেশের মানুষের তাওহীদ বা একাত্মবাদ সম্পর্কে অজ্ঞতার চিত্রকেও স্পষ্ট করে তোলে৷ এই দেশের মানুষের একটি বৃহৎ অংশ যে শিরক-মুক্ত জীবন যাপন করতে সক্ষম নয়, পাগলা মসজিদে দানের ক্রমবর্ধমান পরিমাণ তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। যারা এই মসজিদে দান করতে আসছেন তারা সকলেই কোন না কোন মানত পূরণের জন্য দান করছেন। অথচ মানত তাকদীর পরিবর্তন করতে পারে না বলে হাদীসে উল্লেখ রয়েছে এবং এ ধরণের মানতকে নিষিদ্ধ বলেছেন ফিকাহবিদগণ। বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হাদীসে বলা হয়েছে, “মানত কোন কাজকে এগিয়ে আনতে কিংবা আশু সংঘটিতব্য কোন কাজকে পিছিয়ে দিতে পারে না৷ তবে এভাবে কৃপণ ব্যক্তির কিছু অর্থ -সম্পদ খরচ করানো হয়৷”

পাগলা মসজিদে মানত পূরণের জন্য, ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য, মনের বাসনা পূরণের জন্য দান-খয়রাত করা শরীয়তসম্মত কিনা সে বিষয়ে আলেম-উলামাগণ ভেবে দেখবেন এবং সে বিষয়ে দেশবাসীকে নির্দেশনা প্রদান করবেন এমনটা প্রত্যাশা করছি। একইসাথে ভক্ত-অনুরাগীদের কোটি টাকা দানের অর্থ সমাজ ও মানবের কল্যাণে ব্যয়ের উদ্যোগ নিবে পাগলা মসজিদ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন – সেই আহবানও জানাচ্ছি।

০৬/০৯/২০২৩ তারিখে সংক্ষিপ্তরূপে নয়াদিগন্তে প্রকাশিত

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *