তাজমহল। পৃথিবীর সপ্তমাশ্চার্যের একটি। মোঘল সম্রাট শাহজাহানের অমর কীর্তি। সারা পৃথিবীর লাখো পর্যটক প্রতিবছর তাজমহলের স্থাপত্য-সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভারতের আগ্রায় উপস্থিত হন। তাজমহলকে পেছনে রেখে নিজেদের ছবি তুলে স্মৃতির সংগ্রহশালাকে সমৃদ্ধ করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিয়ে আসা মূল্যবান পাথরে সাজানো তাজমহলের কারুকার্যময় দেয়াল স্পর্শ করেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। ফিরে যাওয়ার সময় ইতস্ততঃ বোধও করেন, কারণ তাজমহলের রহস্যময় বাইশটি কক্ষ তালাবদ্ধ, কেন তালাবদ্ধ কেউ জানে না। জানার চেষ্টা করেন – কী রহস্য লুকিয়ে আছে সেই তালাবদ্ধ ঘরগুলোতে?
গত কয়েকমাস ধরে তাজমহলে বেড়াতে আসা পর্যটকরাই শুধু নন, সারা বিশ্বের উৎসুক মানুষেরা এই তালাবদ্ধ কক্ষগুলোর রহস্য সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করেছেন। একটি সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল কিন্তু ভারতের একটি হাইকোর্ট এই কক্ষগুলো খুলে দেয়ার আবেদনকে খারিজ করে দিয়েছেন। দীর্ঘকাল ধরে তালাবদ্ধ তাজমহলের রহস্যময় বাইশটি কক্ষ। সত্যিই কি কোন রহস্য রয়েছে এই কক্ষগুলিতে – জানবো সেই কথা।
তাজমহল ও কল্পকাহিনী
তাজমহল একটি সমাধি সৌধ। স্ত্রী মমতাজের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে তার কবরের উপর সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে আগ্রার যমুনা নদীর তীরে তৈরি করা হয়েছিল এই তাজমহল। ১৬৩২খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়ে ২০ বছর পর ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে এই ভবনের নির্মান কাজ শেষ হয়। বিভিন্ন দেশের স্থাপত্যরীতিতে তৈরী ইট, সাদা মার্বেল আর রঙ্গীন পাথরের অতিসূক্ষ্ম কারুকার্য এই সৌধটিকে অমরত্ব দান করেছে।
স্বাভাবিকভাবেই এই বিশাল স্থাপত্যের সাথে নানা কল্পকাহিনী জড়িয়ে আছে৷ যেমন, যমুনার অপর তীরে সম্রাট শাহজাহান নিজের সমাধি হিসেবে একটি কালো পাথরের তাজমহল তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিংবা, তাজমহল তৈরি শেষে এর সাথে যুক্ত শ্রমিকদের হাত কেটে দেয়া হয়েছিল যেন তারা অনুরূপ আরেকটি ভবন তৈরি করতে না পারে। আরও বলা হয়, এই সৌধের প্রকৃত নকশাকার একজন ইউরোপীয়। কিন্তু এগুলো সবই কল্পকাহিনী, সময়ের সাথে সাথে ডালপালা গজিয়ে বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছে যার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায় না।
এরকম আরেকটি গুজব হলো – তাজমহল নির্মাণ করা হয়েছে হিন্দুদের দেবতা শিব এর একটি মন্দিরের উপর। বহুবছর ধরে এই ধারণা প্রচলিত থাকলেও কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি ছিল না। গুজবকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন পি এন ওক নামের একজন ইতিহাসবিদ। ভারতের ইতিহাস নতুন করে রচনার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৬৪ সালে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ধারাবাহিকভাবে কিছু প্রবন্ধ লিখে দাবী করতে থাকেন যে, তাজমহল প্রকৃতপক্ষে একটি শিবমন্দির। পরবর্তীতে তিনি দুটি বইও প্রকাশ। এদের একটি হলো – ‘ট্রু স্টোরি অব দ্য তাজ’। অন্যটি ছিল – ‘দ্য তাজমহল ইজ তেজো মহালয়া – আ শিভা টেম্পল’।
তাজমহলের রহস্যময় বাইশ কক্ষ
ট্রু স্টোরি অব দ্য তাজ বইতে লেখক দাবী করেন, তাজমহল প্রকৃতপক্ষে একটি শিব মন্দির বা রাজপুতানা প্রাসাদ ছিল। সম্রাট শাহজাহান একজন হিন্দু জমিদারের কাছ থেকে এটি জোরপূর্বক দখল করে নেন এবং সমাধিতে রূপান্তরিত করেন। তিনি আরও দাবী করেন, তাজমহল থেকে হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি ও অন্যান্য চিহ্ন সরিয়ে ফেলা হয়, যেগুলো সরানো হয়নি, যেমন মন্দিরের প্রধান শিবলিঙ্গ, সেগুলো তালাবদ্ধ কক্ষগুলোর ভেতরে রয়েছে এবং তাজমহলের ভেতরে তদন্ত ও খনন করা হলে তার দাবীর সত্যতা পাওয়া যাবে। তিনি বইতে আরও দাবি করেছেন যে, মমতাজকে তাঁর কবরে শায়িত করা হয়নি। এই দাবির সমর্থনে ওক যমুনা নদীর পাশে তাজমহলের কাঠের দরজার কার্বন ডেটিং-এর ফলাফলও দিয়েছেন পি এন ওকে। তিনি লিখেন, তাজমহল হল “তেজোমহালয়” শব্দের অপভ্রংশ। যা শিব মন্দিরকে নির্দেশ করে।
পি এম ওকের এই দাবীকে পরবর্তীতে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক নেতারা আরও জোরালো করেছেন। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি ভারতের শাসনভার গ্রহণ করার পর এই দাবী শক্তিশালী হতে থাকে। বিভিন্ন সময়ে বিজেপির রাজনৈতিক নেতারা তাজমহলের তালাবদ্ধ কক্ষগুলো খুলে দেয়ার দাবী করেন। এর সর্বশেষ সংযোজন হয় বিজেপির একজন স্থানীয় নেতা ডাক্তার রজনিশ শিং এর মাধ্যমে। তিনি হাইকোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করে তাজমহলের তালাবদ্ধ কক্ষগুলো খুলে দেয়ার দাবী জানান।
ডাঃ রজনিশ তার পিটিশনে বলেন, তাজমহল প্ররকৃতপক্ষে রাজা মানসিংহের তৈরী প্রাসাদ। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে আগ্রায় ভ্রমণকারীদের সকলেই তাদের ভ্রমণস্মৃতিতে রাজা মানসিংহের প্রাসাদের বর্ণনা করেছেন। জয়পুরের সিটি প্যালেস মিউজিয়ামে এই সম্পর্কিত একটি শিলালিপি রয়েছে যেখানে উল্লেখ আছে যে, রাজা মানসিংহের প্রাসাদের বিনিময়ে শাহজাহান রাজা জয় সিংকে চারটি প্রাসাদ দিয়েছিলেন। ১৬৩৩ সালের ১৬ ডিসেম্বরে এই ফরমান জারি করা হয়। এতে রাজা ভগবান দাসের প্রাসাদ, রাজা মাধো সিংহের প্রাসাদ, রূপসী বৈরাগীর প্রাসাদ এবং সুরজ সিংয়ের ছেলে চাঁদ সিং-এর প্রাসাদের কথা উল্লেখ আছে। এছাড়াও, শাহজাহানের ফরমানে উল্লেখ আছে যে তিনি জয় সিংয়ের কাছ থেকে মার্বেল অর্ডার করেছিলেন।
এই পত্রটিকেই প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করে দাবি করা হয় যে, শাহজাহান যে পরিমাণ মার্বেল চেয়েছিলেন তা দিয়ে তাজমহলের নির্মাণ করা সম্ভব ছিল না। এছাড়াও সম্রাট শাহজাহানের পুত্র আওরঙ্গজেবের একটি পত্রে তাঁর মায়ের সমাধি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ পাওয়া যায়। তারিখ অনুযায়ী তাজমহল নির্মাণের পূর্বে চিঠিটি লিখিত বলে ধারণা করা হয়।
গবেষকদের বক্তব্য
ধারণা যাই হোক, কল্পকাহিনী যাই প্রচলিত থাকুক, সত্য দিয়েই তার বিচার করতে হয়। তাজমহলের রহস্যময় বদ্ধ কক্ষগুলোতে কি আছে কিংবা আদৌ কিছু আছে কিনা তার তথ্য পাওয়া যায় তাজমহলের গবেষকদের কাছ থেকে।
ভারতের একজন ঐতিহাসিক অধ্যাপক ড. এস পি ভার্মা জানিয়েছেন, ১৯৩৪ সালে তাজমহলের রহস্যময় এই বদ্ধ ঘরগুলো খোলা হয়েছিল। তালাবদ্ধ এই কক্ষগুলোর প্রায় সবকটিই ভূগর্ভে অবস্থিত৷ অন্যদিকে, দিল্লির একজন ইতিহাসবিদ রানা সাফাভি, যিনি আগ্রায় বড় হয়েছেন – বলেন, ১৯৭৮ সালে এক বন্যার আগ পর্যন্ত তাজমহলের ভূগর্ভস্থ ঐ অংশে পর্যটকরা যেতে পারতেন। ঐ বন্যায় তাজমহলের ভেতরে পানি ঢুকে গিয়েছিল এবং পানি নামার পর ঐ ঘরগুলোর মেঝেতে পলির আস্তরণ পড়েছিল। এছাড়া দেয়াল, মেঝেতে ফাটল দেখা দেয়। তাই কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের জন্য ঘরগুলোতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে ঐ ঘরগুলোতে কিছু নেই। তবে, মাঝেমধ্যে সংস্কারের জন্য ঘরগুলো খোলা হয়।
এবা কোচ নামের ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, যিনি মোঘল স্থাপত্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, তাজমহল নিয়ে গবেষণা করে বই লিখেছেন। গবেষণার সময় তিনি এই কথিত তাজমহলের রহস্যময় ঘরগুলোতে প্রবেশ ও খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি তার বইয়ে লিখেছেন – এই ঘরগুলো মূলত তাহখানা হিসেবে ব্যবহারের জন্য তৈরি। গ্রীষ্মকালে উত্তর ভারতের তীব্র গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সেখানকার অনেক বাড়িতেই এ ধরণের ব্যবস্থা ছিল। গরমের সময় এই কক্ষগুলো শীতল থাকতো।
এবা কোচ তাজমহলের রহস্যময় কক্ষগুলো সম্পর্কেও লিখেছেন। যমুনা নদীমুখী সারিবদ্ধ পনেরোটি ঘরের কথা উল্লেখ করেছেন যার অবস্থান সৌধের নীচে এবং একটি সরু করিডোর দিয়ে সেখানে যেতে হয়। কিছু ঘর বড়, কিছু ছোট। বড় ঘরগুলোর খিলান বা তোরণ রয়েছে যেখান থেকে যমুনা দেখা যায়। ঘরগুলোর দেয়াল সাদা হলেও নীচের দিকে রঙ্গীন কারুকর্যের কথা তিনি উল্লেখ করে সম্রাট ও তার সহযোগীরা যে এখানে সময় কাটাতে আসতেন সেই ধারণার উল্লেখ করেছেন। এ সকল কক্ষের অভ্যন্তরে যদি হিন্দু প্রতীমা, শিবলিঙ্গ বা অন্য কোন চিহ্ন থাকতো তবে তিনি নিশ্চয়ই তার উল্লেখ করতেন।
তাজমহলের রহস্যময় কক্ষের বিষয়ে অধ্যাপক এবা কোচের কথার সাথে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষক অমিতা বেগ-এর বক্তব্যে মিল পাওয়া যায়। অমিতা বেগ ২০ বছর আগে তাজমহলের ভূগর্ভস্থ ঐ অংশে ঢুকেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি চমৎকার কারুকার্যে মোড়া একটি করিডোরের উল্লেখ করেছেন। ঐ করিডোর দিয়ে প্রশস্ত একটি চত্বরে যেতে হয়। তিনি ধারণা করেন সম্রাট এই করিডোর দিয়ে চত্বরে প্রবেশ করতেন।
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে ভারতের হাইকোর্ট জেনেশুনে যথাযথ সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছেন। তাজমহলের ভেতরে শিবমন্দিরের ধারণা যিনি দিয়েছিলেন সেই পি এন ওক সম্ভবত তার হিন্দুত্ববাদিতার জায়গা থেকে এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সে সময় আরও কিছু ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। যেমন, আগ্রার লাল কেল্লা, মক্কার কাবাও নাকি হিন্দুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। অবশ্য এ সকল ধারণা শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকেনি।
তবে গত কয়েক দশকে ভারতে যেভাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটেছে এবং ক্রমশই মুসলমান অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন তাজমহলের ভেতরে শিবমন্দিরের অস্তিত্ব উল্লেখ করে তাজমহলের বদ্ধ বাইশ কক্ষ খুলে দেয়ার আবেদন যে আবারও করা হবে সেটা নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে তাজমহলের রহস্যময় কক্ষের সকল রহস্য উন্মুক্ত করে দেয়াই যুক্তিযুক্ত।
তবে তাই হোক, রহস্য আর কত? হা হা হা
চিল্লাইয়া বললাম – ঠিক! হা হা হা।
দারুণ একটা লেখা। ধন্যবাদ দারাশিকো ভাই।
ভালোবাসা নিবেন স্যার 🙂