ঋণের উপর যাকাত দেয়া বা না দেয়া বিষয়ে

ঋণের উপর যাকাত

যাকাত কিভাবে হিসাব করতে হয় সে বিষয়ে সবার জানা না থাকলেও যাকাতের হিসাবায়নের ক্ষেত্রে যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে ঋণের অর্থ বাদ দিয়ে হিসাব করতে হয় – এটা সবারই জানা। ঋণের বিষয়টি যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সেটা ইদানিং বুঝতে পারছি কারণ আশেপাশে ঋণী ব্যক্তির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, বিশেষতঃ, ব্যাংক বা অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি-গাড়িওয়ালাদের সংখ্য যথেষ্ট। ঋণের উপর যাকাত দেয়া-না দেয়া বিষয়ে তাই এই লিখার অবতারণা।

প্রথমেই বলে নেয়া উচিত – আমি যাকাত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই, উসুল-ফিকাহ সম্পর্কে আমি স্বচ্ছ ধারণা রাখি না এবং আমি কখনও ‘মাদ্রাসা লাইনে’ পড়াশোনাও করিনি। তবে, পেশাগত প্রয়োজনে আমি প্রায় ছয় বছর মানুষের যাকাত সংক্রান্ত প্রশ্ন শুনেছি, এ বিষয়ে সমসাময়িক বিশেষজ্ঞদের জবাব শুনেছি, যাকাত বিষয়ে বহু সভা ও সেমিনারে সশরীরে উপস্থিত থেকে অংশগ্রহণ করেছি এবং যাকাত সংক্রান্ত অন্ততঃ একটি বইয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। ফলে শিরোনামের বিষয় সম্পর্কে আলেমগণ কী বলেন সে সম্পর্কে ধারণা রেখে কোন ফতোয়া না দিয়ে সাধারণভাবে কিছু তথ্য উপস্থাপন করতে চাই, আশা করি, কারও হয়তো উপকারে লাগবে।

যাকাতের সাধারণ নিয়ম

সাধারণভাবে, কারও যদি ধার-দেনা থাকে তবে যাকাত হিসাবায়নের ক্ষেত্রে উক্ত ঋণ বাদ দেয়ার পর যদি সম্পদ নিসাব (যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত ফরজ হয়) পরিমাণ হয়, তাহলে উক্ত সম্পদের উপর যাকাত ফরজ হবে এবং আদায় করা উচিত। ধরা যাক, নিসাব হলো পঞ্চাশ হাজার টাকা। কারও যাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ হলো ষাট হাজার টাকা কিন্তু তার তার ঋণ রয়েছে পনেরো হাজার টাকা। এই পনেরো হাজার টাকা বাদ দেয়ার পর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াবে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা যা নিসাবের তুলনায় কম। সেক্ষেত্রে তার উপর যাকাত ফরজ নয়। কিন্তু যদি তার ঋণের পরিমাণ হয় পাঁচ হাজার টাকা, তাহলে পাঁচ হাজার টাকা বাদ দেয়ার পর অবশিষ্ট পঞ্চান্ন হাজার টাকার উপর যাকাত আদায় করা ফরজ।

এই জমানায় আমরা বাড়ি তৈরির জন্য, গাড়ি কেনার জন্য, বিয়ে করার জন্য, ঘরের আসবাবপত্র কেনার জন্য, বেড়ানোর জন্য ছোট, মাঝারি এবং বড় অংকের ঋণ নিচ্ছি। এই ঋণ কখনও আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে, কখনও ব্যাংক বা এ ধরণের প্রতিষ্ঠান থেকে, কখনও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। ঋণ নেয়ার সময় যে চুক্তি হয় সে অনুসারে এই অর্থ একবারে বা ধীরে ধীরে বা কিস্তি আকারে পরিশোধ করা হয়৷ যাকাত হিসাব করার সময় এই ঋণ বাদ দেই, কিন্তু সমস্যা হলো – ঋণের অংক ছোট না হয়ে বড় হলে সম্পদের চেয়ে দায়ের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কি যাকাত দেয়ার পরিবর্তে গ্রহণ করা উচিত হবে (যেহেতু যাকাত বিতরণের আট খাতের একটি হলো ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি)?

ঋণের উপর যাকাত
ঋণের উপর যাকাত দিতে হবে কিনা-প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ

ঋণের উপর যাকাত দিতে হবে কি

সুতরাং, ঋণের উপর যাকাত দেয়া না দেয়া নিয়ে সামান্য আলোচনার করা যায়। আলেমগণ ঋণকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। স্বল্প মেয়াদী ঋণ এবং দীর্ঘমেয়াদী ঋণ। যে ঋণ খুব শীঘ্রই পরিশোধ করতে হবে সেটা স্বল্প মেয়াদী ঋণ। শীঘ্রই বলতে কতটুকু সময় বোঝাবে তা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ এক মাসকে স্বল্প সময় ধরেছেন, কেউ এক বছর পর্যন্ত। এক বছরের বেশি সময়কে স্বল্প মেয়াদী হিসেবে কেউ গণ্য করেছেন এমনটা দেখিনি। অন্যদিকে, দীর্ঘমেয়াদী ঋণ হলো সেটাই যা স্বল্পমেয়াদী ঋণ নয়। অর্থ্যাৎ স্বল্পমেয়াদী ঋণের যে মেয়াদ, এক মাস বা এক বছর, তার বেশি মেয়াদের ঋণই দীর্ঘমেয়াদী ঋণ।

স্বল্প মেয়াদী ঋণের উপর যাকাত দিতে হবে না – মোটামুটি সকল আলেমই এ বিষয়ে একমত। তবে, দীর্ঘমেয়াদী ঋণের কিছু অংশের উপর যাকাত দিতে হবে না বলেও আলেমগণ মত প্রকাশ করেন। অনেকক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ কিস্তিতে পরিশোধ করা হয়। সেক্ষেত্রে ঋণের যে অংশ স্বল্পমেয়াদে বা আগামী এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করা হবে, তার উপর যাকাত দিতে হবে না বলে আলেমগণ মতামত দেন।

বোঝার জন্য ছোট্ট উদাহরণ দিচ্ছি। ধরা যাক, কারও দশ লক্ষ টাকা ঋণ আছে এবং বছরে এক লক্ষ টাকা কিস্তি হিসেবে সেই ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে, আগামী এক বছরে পরিশোধ্য এক লক্ষ টাকা বাদ দিয়ে যাকাত হিসাব করতে হবে।

আপনার যদি বড় অংকের ঋণ থাকে তাহলে উক্ত ঋণের উপর যাকাত দিতে হবে কি-না সে বিষয়ে আবশ্যিকভাবে এ বিষয়ে জ্ঞান রাখেন এমন একজন আলেমের সাথে যোগাযোগ করে পুরো বিষয়টা বুঝে নিন। যাকাতের গুরুত্বে এবং যাকাত আদায় না করার শাস্তি সম্পর্কে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারলে ঋণের উপর যাকাত ভুলক্রমে বাদ পড়ার দায়ে দায়ী হতে চাবেন না নিশ্চিত।

আমার অভিজ্ঞতায় আলেমগণ এই মতামত প্রকাশের সাথে সাথে আরও একটি বিষয়কে গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করেছেন এবং আমিও সেটা উল্লেখ করতে চাই। স্বল্পমেয়াদী ঋণ হোক বা দীর্ঘমেয়াদী, এই ঋণ যদি সুদের শর্তে নেয়া হয়, তাহলে আমাদের উচিত যত দ্রুত সম্ভব এই ঋণ পরিশোধ করে দেয়া কারণ সুদ হারাম। আমরা নানা অযুহাতে যেভাবে সুদের চুক্তিতে ক্রেডিট কার্ড বা বাড়ি-গাড়ি কেনা ও অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিচ্ছি সেটা মোটেই ভালো কাজ নয়। একই সাথে আল্লাহর বিধান অমান্য করে সুদের সাথে জড়িত থাকা এবং সেই অর্থে উপর আল্লাহর বিধান মেনে যাকাত হিসাব করে আদায় করা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

রাব্বুল আলামীন আমাদের সুদ থেকে বেঁচে থাকা এবং সঠিক উপায়ে যাকাত হিসাব করে আদায়ের তৌফিক দিন। আমীন।

রেফারেন্স: , ,

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *