আমার শৈশবের ঈদের প্রধান আকর্ষণ ছিল ঈদের মেলা। ঈদের চাঁদ দেখার অর্থ হলো আগামীকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মেলা বসবে এবং আব্বার কাছ থেকে পাওয়া সামান্য পরিমাণ ঈদ বকশিশ (আমরা সালামি বলতাম না) দিয়ে হাজারো জিনিসের মধ্য থেকে নিজের পছন্দের দুই একটা খেলনা কিনতাম। এই খেলনার বদৌলতে আমাদের ঈদ সপ্তাহখানেক পর্যন্ত স্থায়ী হতো।
মেলার ঠিক সাথেই একটি ঈদগাহ ছিল। আব্বার সাথে আমরা সেই ঈদগাহে নামাজ পড়তে যেতাম। মেলার দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যেতে যেতেই মেলার আকর্ষনীয় খেলনাগুলোর সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যেতাম। ঈদের নামাজ শেষে বাসায় ফিরে কিছু নাস্তা-পানি খেয়ে তারপর ভাইয়ের সাথে এবং একটু বড় হবার পরে খেলার সাথী বন্ধুদের সাথে সেই মেলায় গিয়ে আমরা খেলনা কিনতাম।
টিনের তৈরী পিস্তলের তখন খুব কাটতি। ভেতরে লাল রং-এর কাগজে মোড়ানো বারুদ ভরে গুলি করলে ঠাস্ ঠাস্ করে গুলি ফুটে। প্লাস্টিকের পিস্তলও ছিল, তবে বন্দুক ছিল না। বরং কাঠের তৈরী বন্দুক ছিল যার নল টিনের তৈরী। টিনের নলে ছোট গুলি ঢুকিয়ে গুলি করলে ছুটি বেরিয়ে যেতো গুলি। এই বন্দুকের গুলি হিসেবে ইটের টুকরাও ব্যবহার করা যেতো, ফলে বন্দুকটা ব্যবহার করা যেতো এক সপ্তাহেরও বেশি। পানি বন্দুকও পাওয়া যেতো।
ওয়াটার গেম নামে এক হাতে (বা দুই হাতে) খেলার জন্য একটা খেলনা ছিল। গোলকসহ ঘড়ির আকৃতির প্লাস্টিকের একটি খেলনা, উপরে স্বচ্ছ প্লাস্টিক, ভেতরে পানি ভর্তি। দুই পাশে দুটো পকেট আর রয়েছে খুব ছোট আকৃতির কিছু বল। নিচের দিকে হাতের বুড়ো আঙ্গুলের সাহায্যে একটা রাবারের বাটন চাপলে বলগুলো ভেসে ভেসে উপরে উঠতো, খেলনাটাকে ডানে বামে কাত করে সেই বলগুলোকে পকেটে ফেলতে হতো। আপনারা যারা মোবাইলে নাড়াচাড়া করে গেম খেলেন, আমাদের সেই ওয়াটার গেম তার আদি ভার্সন।
খেলনা ছাড়াও নানা রকমের খাবারের জিনিস বিক্রি হতো। একটা হাতে চালানো নাগরদোলা থাকতো। এক দুটো বায়োস্কোপ থাকতো। কালো একটি বাক্সের চার দিকে ছোট ছোট ছিদ্র, টাকার বিনিময়ে সেই ছিদ্রে চোখ রাখা যেতো। বায়োস্কোপওয়ালা বাক্সের উপরের দিকে একটি হাতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুরে সুরে কিছু বলতো – আর ভেতরে ছবি পাল্টে যেতো। সাধারণ বেলুন, গ্যাস বেলুন, বেলুন বাঁশি, নানা রকমের ঠেলাগাড়ি ইত্যাদির কথা আর নাই বললাম।
আমি শৈশব থেকে কৈশোরে যেতে যেতেই এই মেলা বন্ধ হয়ে গেলো। ঈদের দিনে সকলের বাসায় গিয়ে নানা পদের খাবার চেখে দেখার মধ্যেই তারপর ঈদ সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো। আরও পরের ঈদ আটকে গেলো কম্পিউটারের স্ক্রিনে, এখন মোবাইলে।
ঈদের সেই মেলাকে আবার ফিরিয়ে আনা যায় না? ঢাকা শহরে প্রত্যেকটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ঈদের দিনের জন্য এই উদ্যোগটি নিলে কত চমৎকার হতো। কিংবা, কোন স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক যুব সংগঠন। মেলা ছিল আমাদের বিভিন্ন উৎসবের সাথে জড়িত সংস্কৃতির একটি অংশ। মুনাফার উদ্দেশ্যে নয়, শুধুমাত্র সংস্কৃতির একটি অংশকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, বর্তমানকালের শিশু-কিশোরদের একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা দেয়ার জন্য এই উদ্যোগ কি কেউ নিবে?
সুখ স্মৃতি বেঁচে থাক। ঈদ মোবারক।