টাকা কার ? তোমার নাকি তোমার বাবার?

১৯৩৫ সনে আমার আব্বা ময়মনসিংহের এক জমিদারের বাড়িতে জায়গীর ছিলেন। উর্দু, ফারসী, অংক ইত্যাদি বিষয়ে আব্বার ভালো দখল ছিল বলে জমিদার উনাকে খুব পছন্দ করতেন। তখন মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে উনার বেতন ছিল দশ কি পনেরো টাকা। কিন্তু জমিদার সাহেব উনাকে পছন্দ করতেন, তাই জমিদারীর টাকা পয়সার হিসাব রাখবেন এই শর্তে তাকে একশ টাকা বেতন দিয়ে চাকরীতে নিযুক্ত করেছিলেন। জমিদার সাহেব আমাদের বাড়িতেও এসেছিলেন।

জমিদার সাহেব আব্বাকে খুব বিশ্বাস করতেন। তিনি একদিন উনাকে ঘোড়া কিনার জন্য টাকা দিয়ে উড়িষ্যা পাঠালেন। তখন উড়িষ্যায় ভালো ঘোড়া বিক্রি হত। আমার আব্বা ঘোড়ার বাজারে গেলেন, দেখে শুনে একটি ঘোড়া বাছাই করলেন। ঘোড়া বিক্রেতাকে তিনি উর্দুতে জিজ্ঞেস করলেন, ঘোড়ার দাম কত? উত্তরে ঘোড়া বিক্রেতা পালটা জানতে চাইল, কার টাকা? তোমার নাকি তোমার বাবার?

এই প্রশ্নে আব্বা বেশ অপমানিত বোধ করলেন। তিনি অন্য ঘোড়া বিক্রেতার কাছে গেলেন। সেই বিক্রেতাও একই প্রশ্ন করলেন। আব্বা আরও কয়েকজন ঘোড়া বিক্রেতার কাছে গেলেন, তারা প্রায় সবাইই একই কাজ করলেন, ঘোড়ার মূল্য বলার পরিবর্তে জানতে চাইলেন, কার টাকা? তোমার নাকি তোমার বাবার?

আব্বা ঘোড়া কেনায় ইস্তফা দিলেন। ঘোড়া বিক্রেতারা কেন এই প্রশ্ন করে তা জানার জন্য তিনি একজন বৃদ্ধ লোকের সাথে সাক্ষাত করে পুরো বিষয়টা খুলে বললেন এবং জানতে চাইলেন, ঘোড়া বিক্রেতারা কেন এই প্রশ্ন করে।

উত্তরে সেই বৃদ্ধ জ্ঞানী লোকটি বললেন, ঘোড়াক্রেতা যদি ছেলে হয় এবং ঘোড়ার দাম যদি তার বাবার টাকা থেকে দেয়া হয় তাহলে সে ঘোড়ার মূল্য নিয়ে বেশি দরকষাকষি করবে না। কারণ এই টাকা তার উপার্জন নয়, এই টাকার গুরুত্ব তার কাছে বেশি নয়, ঘোড়াটাই তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ঘোড়ার ক্রেতা যদি নিজের টাকায় ঘোড়া কিনতে আসেন তাহলে তার উপার্জিত টাকার মূল্য তার কাছে বেশি বলে সে সামান্য পার্থক্যের জন্যও দর কষাকষি করবে। তাই ঘোড়া বিক্রেতারা সবার কাছে এই প্রশ্ন করে এবং এই প্রশ্ন করাটা এখানকার সংস্কৃতির অংশ।

এতদিন পরেও এই গল্প কিন্তু একটুও পুরানো হয় নি। টাকা যদি বাবার উপার্জন হয়, তাহলে ছেলে সেই টাকায় ফূর্তি করতে পারে, তার কোন কষ্ট হয় না। দেড়শ টাকার জিনিস দুইশ টাকা দিয়ে কিনলেও তার কাছে খারাপ লাগে না। কিন্তু টাকা যদি নিজে উপার্জন করে তাহলে সে জানে এই টাকার মূল্য কতটুকু। তখন প্রত্যেকটা পাই-পয়সা খরচ করার ক্ষেত্রেও সে চিন্তা ভাবনা করে, চেষ্টা করে হিসাব করে খরচ করার জন্য।

তুমিও সবসময় মনে রাখবে, যে টাকা তুমি খরচ করছো তা কি তোমার উপার্জন, নাকি তোমার বাবার (বা অন্যের)?

ছবি কৃতজ্ঞতা: art-prints-on-demand.com

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

One Comment on “টাকা কার ? তোমার নাকি তোমার বাবার?”

  1. খুব ভালো লাগলো এই মজার ঘটনা টা পড়ে, মাঝে মাঝে এরকম ভিনদেশী মজার ঘটনা শেয়ার করবেন যাতে করে তাদের দেশের কালচার আমরা খুব সহজে বুঝতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *